বিজয়লক্ষ্মী বদলাপতি। দক্ষিণের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার। কিন্তু নিজের আসল নামে পরিচিত নন তিনি। লোকে তাঁকে চেনে ‘সিল্ক স্মিতা’ নামে। ২ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৬২ বছরে পা দিতেন অভিনেত্রী।
১৭ বছরের অভিনয় জীবনে ৫০০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সিল্ক স্মিতা। তেলুগু, তামিল, মালয়ালম, কন্নড় এমনকি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। আশির দশকে নামকরা দক্ষিণী অভিনেতাদের টক্কর দিতেন তিনি।
সিল্ক স্মিতার অনুরাগীর সংখ্যা ছিল অগুনতি। কিন্তু অনুরাগীদের বেশির ভাগই ছিলেন পুরুষ। অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে নয়, অভিনেত্রী বিখ্যাত ছিলেন তাঁর লাস্যময়ী শরীরী গঠনের জন্য।
বলিপাড়ার একাংশের দাবি, কোনও ছবি বাজারে চলার মতো না হলেও সেই ছবির মধ্যে যদি সিল্ক স্মিতার একখানা ‘আইটেম সং’ও জুড়ে দেওয়া যেত, তা হলেই ছবিটি জাঁকিয়ে ব্যবসা করত। তাই অনেকেই নাকি ছবি হিট করানোর জন্য সিল্ক স্মিতার কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতেন।
দূর থেকে সিল্ক স্মিতার জীবন আলোর রোশনাইয়ে ভরা মনে হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল একদমই বিপরীত। ১৯৬০ সালে ২ ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের ইলোরুর এক তেলুগু পরিবারে জন্ম এই অভিনেত্রীর।
কিন্তু তাঁর পরিবারে আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। এই কারণে স্কুলের গণ্ডিও পার করতে পারেননি সিল্ক স্মিতা। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর তিনি তাঁর শিক্ষাজীবনে ইতি টেনেছিলেন।
ছোট থেকেই ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। শরীরের গঠন আকর্ষণীয় হওয়ায় ছেলেদের কাছ থেকে অনেক রকমের কুপ্রস্তাব পেতেন তিনি। ভয়ে স্মিতার বাবা-মা তাঁকে বাড়ি থেকে বার হতে দিতেন না।
দরিদ্র বাবা-মা স্মিতার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের পরে তাঁর জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্মিতার উপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন চালাতেন।
এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চেন্নাইয়ে পালিয়ে যান স্মিতা। চেন্নাইয়ে গিয়ে এক অভিনেত্রীর বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন তিনি। ওই অভিনেত্রীর মেক আপ করতেও সাহায্য করতেন স্মিতা।
স্মিতা যে অভিনেত্রীর বাড়িতে কাজ করতেন, এক দিন তাঁর বাড়িতে এক পরিচালক দেখা করতে আসেন। বাড়ির বাইরে পরিচালকের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সে দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় অভিনেত্রী তাঁকে ব্যঙ্গও করেছিলেন। তখন থেকেই নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার জেদ চেপে যায় স্মিতার।
ছবিতে অভিনয়ের জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন স্মিতা। কাজও পেয়ে যান। কেরিয়ারের শুরুতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতেন স্মিতা।
অ্যান্থনি ইস্টম্যানের পরিচালনায় ১৯৮১ সালে ‘ইনায়ে থেড়ি’ নামে একটি মলয়ালম ছবি মুক্তি পায় এই ছবিতে মুখ্যচরিত্র হিসাবে প্রথম অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল স্মিতাকে। ছবির পরিচালক তাঁর নাম বিজয়লক্ষ্মী থেকে বদলে রাখেন স্মিতা।
স্মিতার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন পরিচালক বিনু চক্রবর্তী। তিনি স্মিতার ‘শিক্ষাগুরু’ হয়ে উঠেছিলেন। ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে গেলে কী ভাবে কথা বলতে হয়, কী ভাবে হাঁটাচলা করতে হয়— সব কিছুই হাতে ধরে স্মিতাকে শিখিয়েছিলেন বিনু এবং তাঁর স্ত্রী।
তাঁদের দৌলতেই ঝরঝরে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শিখেছিলেন স্মিতা। তাঁদের কাছে থেকে নাচও শেখেন তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা স্মিতার শরীরী ভাষাও ধীরে ধীরে বদলে যায়।
‘ইনায়ে থেড়ি’ ছবিতে স্মিতা প্রথম অভিনয় করলেও ছবি মুক্তিতে দেরি হয়েছিল। তার আগে ‘বন্দিচক্করম’ নামের একটি তামিল ছবি মুক্তি পায়। এই ছবিতেও স্মিতা অভিনয় করেছিলেন। একটি ‘বার গার্ল’-এর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। চরিত্রের নাম ছিল ‘সিল্ক’। ছবিটি মুক্তির পর দর্শকের কাছে এই চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যায়, যে চরিত্রের নামেই স্মিতার পরিচিতি তৈরি হয়। স্মিতা নয়, বরং ‘সিল্ক স্মিতা’ নামেই লোকে চিনতেন তাঁকে।
একের পর এক হিট ছবিতে অভিনয় করে সিল্ক স্মিতা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কোনও ছবির শুটিং শুরু হওয়ার আগেই তিনি সেটে পৌঁছে যেতেন। তাঁর ভক্তের সংখ্যা বেশি থাকলেও তাঁর জীবনে বন্ধু ছিল হাতেগোনা।
বলিপাড়ার অধিকাংশের দাবি, কথায় কথায় রেগে যেতেন স্মিতা। মুখের উপর কড়া কথাও শুনিয়ে দিতেন হামেশা। কিন্তু তাঁর মন ছিল শিশুদের মতো নরম। খুব কম কথা বলতেন তিনি।
স্মিতা যখন কেরিয়ারের শীর্ষে, তখনই রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। ১৯৯৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চেন্নাইয়ের বাড়ি থেকে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয় অভিনেত্রীর।
মৃত্যুর আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অনুরাধাকে ফোন করেছিলেন স্মিতা। কোনও কিছু নিয়ে তিনি অশান্তিতে রয়েছেন বলে জানান অনুরাধাকে। বান্ধবী তাঁর বাড়িতে দেখা করতে এসে দেখেন, স্মিতা তত ক্ষণে মারা গিয়েছেন।
ময়নাতদন্তে স্মিতার শরীরে প্রচুর অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছিল। অভিনেত্রী আত্মঘাতী হয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল পুলিশ। বাড়ি থেকে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই তত্ত্ব অনেকে মানতে চাননি। তাঁদের ধারণা, স্মিতাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। আজও অভিনেত্রীর মৃত্যু রহস্যে মোড়া।
২০১১ সালে স্মিতার জন্মদিন উপলক্ষে মুক্তি পায় ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ ছবিটি। ছবিটির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন একতা কপূর। তিনি জানিয়েছিলেন, সিল্ক স্মিতার জীবনকাহিনির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই ছবি। সিল্ক স্মিতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিদ্যা বালন। কিন্তু স্মিতার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ জানান।
স্মিতার ভাই অভিযোগ করে জানান, এই ছবি তাঁদের অনুমতি ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে। এতে পরিবারের সকলেই অসন্তুষ্ট। পরে অবশ্য একতা একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি নাকি সিল্ক স্মিতার জীবনের উপর এই ছবি তৈরি করেননি।
২০১৩ সালে ‘ডার্টি পিকচার: সিল্ক সক্কত মাগা’ নামে একটি কন্নড় ছবি মুক্তি পায়। সিল্ক স্মিতার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল পাকিস্তানের অভিনেত্রী বীণা মালিককে।
একই বছর ‘ক্লাইম্যাক্স’ নামের একটি মলয়ালম ছবি মুক্তি পায়। সিল্ক স্মিতার চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সানা খান।