জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার বা এনএসএ) পদে টানা তৃতীয় বার অজিত ডোভালকে পুনর্বহাল করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বৃহস্পতিবার সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ৭৭ বছরের ডোভালের পুনর্নিয়োগের কথা জানানো হয়েছে। গত ১০ জুন থেকেই কার্যকর হয়েছে ওই নির্দেশিকা।
অজিত কেরিয়ার শুরু করেছিলেন এক জন আইপিএস অফিসার হিসাবে। তবে তিনি ‘ভারতীয় জেমস বন্ড’ নামেও পরিচিত। কী ভাবে এক জন আইপিএস অফিসার থেকে ভারতের অন্যতম গোয়েন্দা হয়ে উঠলেন অজিত?
অজিতের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি, উত্তরাখণ্ডের পাউরি গাড়োয়ালের ঝিরি বানেলসুন গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন রাজস্থানের অজমেরের সেনা স্কুল থেকে।
প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের পর অজিত উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৬৭ সালে আগরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এর পর ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৮ সালে আইপিএসে যোগ দেন অজিত। সূত্রের খবর, কেরিয়ারের শুরুতেই অজিতকে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসাবে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল ভারত।
পাকিস্তানের লাহোরে এক জন মুসলিম ব্যক্তির ছদ্মবেশে সাত বছর কাটান তিনি। ওই সময় পাক সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতের হাতে তুলে দেন। পাকিস্তানে থাকা ভারতীয় দূতাবাসেও কাজ করেন।
পাকিস্তান অভিযান সফল করে ভারতে ফিরে আসেন অজিত। উত্তর-পূর্ব ভারত এবং পঞ্জাবে সন্ত্রাস দমনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেয় সরকার।
১৯৮৮ সালে খলিস্তানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার’-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অজিত। কৌশলগত ভাবে আরও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
মিজ়োরামে শান্তি ফেরাতেও অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন অজিত। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড’কে দমন করতেও তিনি বিভিন্ন সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
১৯৯৯ সালে কন্দহরে অপহৃত হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান আইসি-৮১৪ থেকে যাত্রীদের মুক্তির বিষয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা করার ক্ষেত্রেও অজিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পাশাপাশি, ইরাকে বন্দি ভারতীয় নার্সদের মুক্তি এবং পাকিস্তানে আটক ভারতীয় মৎস্যজীবীদের ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
অজিত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র অপারেশন শাখার প্রধান ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি আইবি-র ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৪-য় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই প্রাক্তন গোয়েন্দাকর্তা ডোভালকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে নিয়ে এসেছিলেন মোদী। তার পর একে একে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জঙ্গিদমনে তাঁর নেতৃত্বেই পদক্ষেপ করে সরকার।
২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গি হানার পর তাঁর নেতৃত্বেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছিল বলে দাবি। সেই সময় যা মোদী সরকারের পক্ষে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।
এর পর ২০১৭ সালে ডোকলামে ভারত-চিন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মূলত ডোভালের হস্তক্ষেপেই পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে জঙ্গিহানার পরে পাকিস্তানের বালাকোটে জঙ্গিশিবিরে বিমানহানার নেপথ্যেও ডোভালের মস্তিষ্ক ছিল বলে সরকারের একটি সূত্রের খবর।
পাঁচ বছর দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব সামলানোর ‘পুরস্কার’ হিসাবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে পুনর্নিয়োগ পেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই আইপিএস আফিসার। শুধু আরও পাঁচ বছর স্বপদে পুনর্বহালই নয়, তাঁর পদমর্যাদাও বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় মোদী সরকার।
মোদীর প্রথম বারের প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে ডোভালের পদমর্যাদা ছিল কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর সমান। সেই পদমর্যাদা বাড়িয়ে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা।
দ্বিতীয় দফার মেয়াদে ডোভালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ৩৭০ ধারা রদের পর অশান্ত হয়ে ওঠা কাশ্মীর উপত্যকায় আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর ক্ষেত্রে। পাশাপাশি, ২০২০-র জুনে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার চিনা ফৌজের সঙ্গে ভারতীয় সেনার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে দফায় দফায় বেজিংয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। যদিও সে সময়ই বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে ডোভালের ‘দূরত্বের’ খবর নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল। ফলে তৃতীয় দফায় মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি পুনর্নিয়োগ পাবেন কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংশয়। বৃহস্পতিবার সেই সংশয়ে ইতি টেনে দিলেন মোদী।
উল্লেখ্য, অজিত ভারতের বীরত্ব পুরস্কার ‘কীর্তি চক্র’-এর প্রাপক।