১৯১২ সাল। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতে হিমশৈলে ধাক্কা মেরে উত্তর অতলান্তিকে ডুবে যায় সে সময়ের অন্যতম বিলাসবহুল যাত্রিবাহী জাহাজ টাইটানিক। মৃত্যু হয় প্রায় ১৫০০ মানুষের। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে ১১১ বছর। সোমবার থেকে সেই টাইটানিককে কেন্দ্র করে আবার আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনাচ্ছে আতলান্তিকে।
অতলান্তিক মহাসাগরের প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার নীচে এখনও রয়েছে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। পর্যটকদের ডুবোজাহাজে চাপিয়ে অতলান্তিকের অতলে টাইটানিকের সেই ধ্বংসাবশেষই দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল একটি পর্যটন সংস্থা। কিন্তু রবিবার থেকে নিখোঁজ সেই ডুবোজাহাজ টাইটানও। যদিও টাইটানে কত জন পর্যটক ছিলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
রবিবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন’স থেকে যাত্রা শুরু করেছিল টাইটান। পর্যটন সংস্থার দাবি, যানটির ভিতরে পাঁচ জন যাত্রীর চার দিন চলার মতো অক্সিজেন মজুত ছিল।
পর্যটন সংস্থার তরফে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, যাত্রীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী ইতিমধ্যেই ডুবোযানটির সন্ধানে নেমেছে।
যে অভিযানে গিয়ে টাইটান নিখোঁজ হল, সেটি ছিল ডুবোজাহাজটির তৃতীয় অভিযান।
টাইটান ডুবোযানটি ওসানগেট এক্সপিডিশন নামের পর্যটন সংস্থার মালিকানাধীন। ২২ ফুটের এই ডুবোজাহাজ কার্বন ফাইবারের তৈরি।
টাইটানের দৈর্ঘ্য ৬.৭ মিটার, প্রস্থ ২.৮ মিটার এবং উচ্চতা ২.৫ মিটার। সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার গভীরতা পর্যন্ত নামতে সক্ষম এই ডুবোযান।
টাইটানের ওজন ১০,৪৩২ কেজি এবং এটি সর্বোচ্চ তিন নটিকাল মাইল গতিতে ভ্রমণ করতে পারে।
টাইটানের অন্দরে রয়েছে ১০০২টি বৈদ্যুতিক থ্রাস্টার। পাশাপাশি রয়েছে সামুদ্রিক রেফিন ক্যামেরা, ৪০ হাজার লাইট এবং একটি রোবোটিক্স লেজ়ার স্ক্যানার।
জাহাজটির অন্দর ছোট হওয়ায় ইঞ্জিন এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ মূলত বাইরের দিকে রয়েছে। ডুবোজাহাজটির ভিতরে একটি শৌচালয় রয়েছে।
টাইটান একটি শক্তিশালী প্লেস্টেশন কন্ট্রোলার দ্বারা জলের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। যদিও ডুবোযানটিতে কোনও জিপিএস নেই।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেসেজের মাধ্যমে ট্র্যাকিং দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাইটান যা একটি ‘আল্ট্রা-শর্ট বেসলাইন (ইউএসবিএল)’ সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম।
ওই ডুবোজাহাজে যে ক্যামেরাগুলি লাগানো থাকে তার সাহায্যে সমুদ্রের উপর থেকে জাহাজের গতিবিধির উপর নজর রাখা হয়।
টাইটানে একটি মাত্র বোতাম (সুইচ) রয়েছে। বাকি সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ‘টাচ স্ক্রিন’ এবং কম্পিউটারের সাহায্যে।
এই ডুবোজাহাজটি সর্বাধিক ১০ দিন পর্যন্ত জলের তলায় থাকতে পারে যাত্রীদের নিয়ে। তবে বর্তমানে টাইটানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় কারণ এতে তিন দিনেরও কম অক্সিজেন মজুত রয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি সূত্রে খবর, টাইটানিক দেখতে যাওয়ার ওই যাত্রা ছিল মোট আট দিনের। পর্যটকপ্রতি টিকিটের দাম ভারতীয় মুদ্রায় দু’কোটিরও বেশি!
নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ৫৯ বছর বয়সি ব্রিটিশ কোটিপতি ব্যবসায়ী হামিশ হার্ডিং। গত রবিবারই সমাজমাধ্যমে তিনি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
টাইটান ডুবোজাহাজটি কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ইঞ্জিনিয়াররা ওসানগেটের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে যৌথ ভাবে এই ডুবোজাহাজ তৈরি করেন।
একটি সাক্ষাৎকারে ওসানগেট এক্সপিডিশনের সিইও স্টকটন রাশ জানিয়েছিলেন, সর্বাধিক পাঁচ যাত্রীকে নিয়ে ভ্রমণ করার ক্ষমতা রয়েছে টাইটানের। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ যে গভীরতায় রয়েছে, সেই গভীরতা পর্যন্তই যেতে সক্ষম জাহাজটি।
২০০৯ সালে ওসানগেট সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন স্টকটন। স্টকটন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ জেট পাইলট ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি জেট পাইলট হন। ১৯৮৯ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্লাসেয়ার-৩ নামে একটি পরীক্ষামূলক বিমান তৈরি করেছিলেন স্টকটন।