পেরিয়ে গিয়েছে অনেকখানি সময়। কিন্তু এখনও নিখোঁজ পাঁচ যাত্রী নিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনে যাওয়া ডুবোযান ‘টাইটান’। রবিবার পাঁচ কোটিপতি যাত্রী নিয়ে অতলান্তিকের অতলে নেমেছিল ডুবোজাহাজটি। কিন্তু যাত্রা শুরু করার ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর টাইটানের ‘মাদারশিপ’ পোলার প্রিন্সের সঙ্গে তার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
‘সাবমার্সিবল’ জলযানটিতে মোট পাঁচ জন যাত্রী ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কোটিপতি ব্যবসায়ী হ্যামিশ হার্ডিং থেকে শুরু করে শাহজাদা দাউদ।
পাঁচ জন যাত্রীই নিজের নিজের ক্ষেত্রে অতি পরিচিত নাম। প্রত্যেকেই বিপুল সম্পত্তির মালিক।
এরা সকলেই ধনী, কারণ টাইটানে চেপে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চাক্ষুষ করা মুখের কথা ছিল না। এই অভিযানে যেতে হলে খসাতে হয় প্রচুর টাকা। সংবাদমাধ্যম বিবিসি সূত্রে খবর, টাইটানিক দেখতে যাওয়ার ওই যাত্রায় পর্যটকপিছু টিকিটের দাম ছিল ভারতীয় মুদ্রায় দু’কোটিরও বেশি!
নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ কোটিপতি ব্যবসায়ী হ্যামিশ। গত রবিবারই সমাজমাধ্যমে তিনি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
৫৯ বছর বয়সি হ্যামিশ বিমান সংস্থা ‘অ্যাকশন অ্যাভিয়েশনের’ চেয়ারম্যান। এ ছাড়াও তিনি এক জন বিখ্যাত অভিযাত্রী। তাঁর তিনটি ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ রয়েছে। সমুদ্রের গভীরতায় সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়ে নজির গড়েছিলেন হ্যামিশ।
হ্যামিশ সমাজমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তিনি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাচ্ছেন। তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘নিউফাউন্ডল্যান্ডে খারাপ আবহাওয়ার কারণে, এই সমুদ্রযাত্রা ২০২৩ সালে টাইটানের প্রথম এবং একমাত্র মানব যাত্রা হতে পারে।’’
যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ। পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলির মধ্যে শাহজাদার পরিবার অন্যতম। পুত্র সুলেমানের সঙ্গে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন শাহজাদা। তবে দু’জনেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
এ বিষয়ে শাহজাদার পরিবার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘এখনও পর্যন্ত টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সীমিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।’’
বাবার সঙ্গে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে সমুদ্রের গভীরে গিয়েছেন শাহজাদার পুত্র সুলেমান দাউদ। তিনি বাবাকে পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর কাজে সাহায্য করেন। সুলেমানের দাদু হোসেন দাউদ বিশ্বের অন্যতম পরিচিত একটি অসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।
নিখোঁজ কোটিপতি যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন পল-হেনরি নারজিওলেট। ৭৭ বছর বয়সি নারজিওলেট এই অভিযানের নেতৃত্বও দিচ্ছিলেন। তিনি ফরাসি নৌবাহিনীর প্রাক্তন ডুবুরি।
নারজিওলেট পরিচিত ‘মিস্টার টাইটানিক’ নামেও। ১৯৮৭ সালে প্রথম টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়ার অভিযান হয়। সেই অভিযানের অংশ ছিলেন তিনি।
নারজিওলেট টাইটানিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত। এর আগেও নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপের দিকে বেশ কয়েকটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারজিওলেট এর আগে কমপক্ষে ৩৫ বার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
এই অভিযানের পঞ্চম যাত্রী ‘ওশানগেট এক্সপিডিশন’-এর সিইও স্টকটন রাশ। তাঁর সংস্থার তরফেই এই অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
একটি সাক্ষাৎকারে ওশানগেট এক্সপিডিশনের সিইও স্টকটন রাশ জানিয়েছিলেন, সর্বাধিক পাঁচ যাত্রীকে নিয়ে ভ্রমণ করার ক্ষমতা রয়েছে টাইটানের। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ যে গভীরতায় রয়েছে, সেই গভীরতা পর্যন্তই যেতে সক্ষম ডুবোযানটি।
২০০৯ সালে ওশানগেট সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন স্টকটন। স্টকটন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ জেট পাইলট ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি জেট পাইলট হন। ১৯৮৯ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্লাসেয়ার-৩ নামে একটি পরীক্ষামূলক বিমান তৈরি করেছিলেন স্টকটন।
১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল মধ্যরাতে হিমশৈলে ধাক্কা মেরে উত্তর অতলান্তিকে ডুবে যায় সে সময়ের অন্যতম বিলাসবহুল যাত্রিবাহী জাহাজ টাইটানিক। মৃত্যু হয় ১৫০০-রও বেশি মানুষের। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে ১১১ বছর। অতলান্তিক মহাসাগরের প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার নীচে এখনও রয়েছে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ।
সোমবার থেকে সেই টাইটানিককে কেন্দ্র করে আবার আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনাচ্ছে অতলান্তিকে। পর্যটকদের টাইটানে চাপিয়ে অতলান্তিকের অতলে টাইটানিকের সেই ধ্বংসাবশেষই দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল পর্যটন সংস্থা ওশানগেট। কিন্তু রবিবার থেকে নিখোঁজ সেই ডুবোযান।
রবিবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন’স থেকে যাত্রা শুরু করেছিল টাইটান। পর্যটন সংস্থার দাবি, যানটির ভিতরে পাঁচ জন যাত্রীর চার দিন চলার মতো অক্সিজেন মজুত ছিল।
টাইটান ডুবোযানটি কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ইঞ্জিনিয়াররা ওশানগেটের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে যৌথ ভাবে এই ডুবোজাহাজ তৈরি করেন।
পর্যটন সংস্থার তরফে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, যাত্রীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী ইতিমধ্যেই ডুবোযানটির সন্ধানে নেমেছে। যে অভিযানে গিয়ে টাইটান নিখোঁজ হল, সেটি ছিল ডুবোযানটির তৃতীয় অভিযান।