সরকারি চাকরি, থিয়েটারশিল্পী হিসাবে পরিচিতি, হিন্দি ছবিতে মুখ্যচরিত্র থেকে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়, হিন্দি ধারাবাহিকেও কাজ করেছিলেন অভিনেতা নির্মল পাণ্ডে। কিন্তু কেরিয়ারে সাফল্যের স্বাদ বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি তিনি। ৪৭ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই অভিনেতা। একাংশের অনুমান নির্মলের মৃত্যুর জন্য দায়ী মুম্বইয়ের বলিউডজগতের ছবি নির্মাতারা।
১৯৬২ সালের ১০ অগস্ট উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালে জন্ম নির্মলের। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রাজকুমার পাণ্ডে। পরবর্তী কালে পেশার খাতিরে নিজের নাম বদলে ফেলেন তিনি।
নির্মলের বাবা পেশায় সরকারি কর্মী ছিলেন। তিনি চাইতেন, নির্মলও যেন পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করেন। কিন্তু নির্মলের মন ছিল অন্য দিকে। পড়াশোনার চেয়ে তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল অভিনয়ের প্রতি।
নৈনিতালের একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয় নির্মলকে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে নাটকও করতেন তিনি। এমনকি, আশপাশের কোনও গ্রামে ‘রামলীলা’ মঞ্চস্থ করা হলে সেখানেও অভিনয় করতেন নির্মল।
স্কুলের গণ্ডি পার করে নৈনিতালের একটি কলেজে ভর্তি হন নির্মল। নাটকের একটি দলের সঙ্গেও যুক্ত হন তিনি। বহু নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনার দায়িত্বও সামলাতে শুরু করেন নির্মল। স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ হলে নির্মলের পরিবার বার বার তাঁকে সরকারি দফতরে চাকরি করার জন্য অনুরোধ করতে থাকে।
পরিবারের সদস্যদের কথা মেনে সরকারি চাকরিও জোগাড় করে ফেলেন নির্মল। কিন্তু কোনও ভাবেই কাজে মন বসাতে পারছিলেন না তিনি। হঠাৎ দিল্লির ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’য় ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি।
পরিবারের বারণ সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালে দিল্লি চলে যান নির্মল। তিন বছর অভিনয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সেখানেই চুটিয়ে থিয়েটার করতে শুরু করেন তিনি। সেই সময় লন্ডনের একটি বিশেষ থিয়েটার দলের তরফে ডাক পান নির্মল।
লন্ডনের থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থিয়েটারে অভিনয় করে নিজের পরিচিতি গড়তে শুরু করেন নির্মল। সেই সময় ১০০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করে ফেলেছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় তাঁর অভিনয়জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়।
১৯৯৪ সালে শেখর কপূরের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘ব্যান্ডিট কুইন’ ছবিটি। এই ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় সীমা বিশ্বাস, গজরাজ রাও, মনোজ বাজপেয়ী এবং রঘুবীর যাদবের মতো তারকাদের। এই ছবিতে অতিথিশিল্পী হিসাবে অভিনয় করেন শেখর নিজেও।
‘ব্যান্ডিট কুইন’ ছবিতে মান সিংহের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় মনোজকে। কিন্তু প্রথমে বিক্রম মাল্লা চরিত্রের জন্য মনোজকে পছন্দ করেছিলেন শেখর। কথাবার্তাও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কিন্তু শেখরের মতবদল হয় তাঁর সঙ্গে এক আত্মীয়ের দেখা হওয়ার পর।
দিল্লির ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’য় শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শেখরের এক আত্মীয়। শেখরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ‘ব্যান্ডিট কুইন’ ছবির খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা হয়। তখনই শেখরের আত্মীয় তাঁর কলেজের ছাত্র নির্মলের কথা বলেন। আত্মীয়ের কথা অনুযায়ী, নির্মলের সঙ্গে দেখাও করেন শেখর।
নির্মলের অডিশন নেওয়ার পর তাঁর অভিনয় ভাল লেগে যায় শেখরের। মনোজের পরিবর্তে বিক্রম মাল্লার চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় নির্মলকে। বড় পর্দায় প্রথম অভিনয়, তাও আবার মুখ্যচরিত্রে— নিজগুণে দর্শকের মনে জায়গা করে ফেলেছিলেন নির্মল।
বলি পরিচালক সুধীর মিশ্রের নজরে পড়েন নির্মল। ১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইস রাত কি সুভা নেহি’ ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন নির্মল। কম বাজেটের ছবি হলেও নির্মলের অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়।
একই বছরে মুক্তি পাওয়া অমোল পালেকর পরিচালিত ‘দায়রা’ ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় নির্মলকে। এই ছবিতে রূপান্তরকামীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। পর্দায় নিজের চরিত্রটি এমন নিপুণ ভাবে নির্মল ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে বিদেশেও তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। এমনকি, এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিদেশের এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ‘সেরা অভিনেত্রী’র শিরোপাও পেয়েছিলেন নির্মল।
পর পর তিনটি ছবিতে অভিনয় করে বলি ইন্ডাস্ট্রিতে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে নির্মলের। বলিপাড়ার একাংশের অনুমান, এই কারণেই কেরিয়ার তৈরির সময় কেরিয়ারে পতন শুরু হয়ে যায় নির্মলের।
বলিপাড়ার একাংশের দাবি, পরিচিতদের সাহায্য ছাড়া কেউ যদি নিজ দক্ষতায় হিন্দি ফিল্মজগতে নিজের জায়গা তৈরি করে ফেলতেন, তা হলে সেই তারকাকে যে কোনও ভাবে একঘরে করে দেওয়া হত। নির্মলও এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন।
ধীরে ধীরে নির্মলের কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব আসা কমতে শুরু করে। যে অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন, তাঁকে শুধুমাত্র পার্শ্বচরিত্র এবং খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে শুরু করলেন বলিপাড়ার ছবি নির্মাতারা।
‘হম তুম পে মরতে হ্যায়’, ‘হদ কর দি আপনে’র মতো বহু হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন নির্মল। কিন্তু কাজ করে কখনও শান্তি খুঁজে পেতেন না অভিনেতা। হিন্দি ছবির পাশাপাশি ছোট পর্দা এবং দক্ষিণী ছবিতেও অভিনয় করা শুরু করেন নির্মল।
ভাল কাজের অভাবে ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে প়ড়েন নির্মল। মদের প্রতিও আসক্তি জন্মায় তাঁর। ১৯৯৭ সালে কৌসর মুনির নামে এক লেখিকাকে বিয়ে করেন নির্মল। কৌসরের সঙ্গে একটি গানের অ্যালবামও তৈরি করেন নির্মল।
অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মল ভাল গান গাইতে পারতেন। কৌসরও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থাকায় গানের বাণী লিখে ফেলেন তিনি। ওই গানগুলি গেয়ে একটি অ্যালবামও তৈরি করেন নির্মল। কিন্তু মদের প্রতি আসক্তির জন্য গায়ক হিসাবেও কেরিয়ার গড়তে পারলেন না নির্মল।
তিন বছর এক ছাদের তলায় থাকার পর নির্মলকে বিচ্ছেদ দেন কৌসর। বড় পর্দায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ছোট পর্দাতেও কাজ শুরু করেন নির্মল। ২০০৩ সালে সম্প্রচারিত ‘হাতিম’ ধারাবাহিকে দজ্জাল চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়োন নির্মল।
টেলিভিশনে অভিনয়ের সময় লখনউয়ের অর্চনা শর্মা নামে এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয় নির্মলের। ২০০৫ সালে সাত পাকে বাঁধা পড়েন নির্মল এবং অর্চনা। পেশায় এক জন শিক্ষিকা ছিলেন অর্চনা।
বিয়ের পর লখনউয়ে থাকতেন নির্মল। কাজের প্রস্তাব পেলে মাঝেমধ্যে মুম্বইয়ে যেতেন তিনি। ২০১০ সালে ‘লাহোর’ ছবিতে শেষ অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে। এর পরই মানসিক অবসাদ এবং অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে।
৪৮তম জন্মদিনের ছ’মাস আগে এক দিন সকালে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন নির্মল। বুকে ব্যথার পাশাপাশি শ্বাসকষ্টও শুরু হয় তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
হাসপাতাল যাওয়ার পথে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নির্মল। বলিপাড়ার একাংশের দাবি, কেরিয়ারে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন বলেই মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে যান তিনি। এই কারণে অতিরিক্ত মদ্যপানও শুরু করেন নির্মল। নির্মলের মৃত্যুর পর টুইটারে পরিচালক সুধীর মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন শেফালি বৈদ্য নামে এক নেটব্যবহারকারী। শেফালির অভিযোগ, প্রথম ছবিতে কাজ দেওয়ার পর আট বছর নির্মলের সঙ্গে দেখা করেননি সুধীর। সুধীরের মতো মানুষ নির্মলকে এড়িয়ে গিয়েছেন।
শেফালির অভিযোগের পর নেটপাড়া উত্তাল হয়ে পড়ে। যদিও তাঁর জবাবে সুধীর টুইট করে লেখেন, ‘‘আমি কখনওই নিজের ঢাক নিজে পেটাই না। কিন্তু সকলে জানেন আমি কত নবাগত শিল্পীকে ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে দিয়েছি। যে চরিত্রের জন্য যে শিল্পীকে মানাবে, আমি তাঁর কাছেই প্রস্তাব নিয়ে যাব।’’ হনসল মেহতা এবং অনুরাগ কশ্যপের মতো বলিপাড়ার অন্যান্য ছবি নির্মাতা সুধীরের পাশে এসে দাঁড়ান। হনসল এবং অনুরাগ দু’জনের মতে, শেফালির মতামতকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাঁদের মতে, মূল বিষয়কে অন্য ভাবে দেখাচ্ছেন শেফালি। তবে এই কাদা ছোড়াছুড়ি থেমে গেলেও নির্মলের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে পড়েছিল বলিপাড়া।