তাঁর নির্দেশেই চাকরি গিয়েছে মন্ত্রীকন্যার। তাঁর নির্দেশেই চাকরি গিয়েছে স্কুল নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম থাকা বহু চাকরিপ্রাপকের। তিনি বলেছিলেন, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়েও তাঁকে রোখা যাবে না। দুর্নীতি দেখলে তিনি আওয়াজ তুলবেনই। কলকাতা হাই কোর্টের সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে মামলা সরানোর নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। তবে নিয়োগ দুর্নীতির সব মামলা থেকেই তাঁকে সরানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে।
নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় একের পর এক রায় দিয়ে মামলাকারী চাকরিপ্রার্থীদের ‘ভগবান’ হয়ে উঠেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর এজলাসে এসে তাঁকে ‘গরিব মানুষের ত্রাতা’ বলে সম্বোধন করতেও দেখা গিয়েছে।
কিন্তু কী ভাবে উচ্চ আদালতের বিচারপতি থেকে ‘সাধারণের ভগবান’ হয়ে উঠেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়? রাজ্যে স্কুলের নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে অভিযোগ এনে বহু মামলাকারী কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার পর থেকে এর সূত্রপাত।
২০২১ সালে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত পর পর অনেকগুলি মামলার তদন্তভার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই মামলাগুলি ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার পর আবার তাঁর এজলাসেই ফিরে আসে নিয়োগ মামলা। বহাল থাকে তাঁর সিবিআই তদন্তের নির্দেশও। মাদ্রাসা নিয়ে ওঠা নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তভারও তিনি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দেন।
তিনিই সেই বিচারপতি, যাঁর নির্দেশে পার্থের পর বিপাকে পড়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য-সহ শিক্ষা দফতরের অনেক আধিকারিক। ফাঁপরে পড়েন নিয়োগ দুর্নীতির ‘এজেন্ট’রাও। এখন তাঁরা প্রত্যেকেই জেলবন্দি।
পার্থ-মানিকের গ্রেফতারির পর থেকে রাজ্যে ইতিমধ্যেই তোলপাড় শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাঁকে নিয়ে কৌতূহল বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।
তবে আদালতে বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয়েছিল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে। আইনজীবীদের একাংশ তাঁর এজলাসে এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। আদালতের বাইরে তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ করেন রাজ্যের একাধিক নেতামন্ত্রীও। তাঁকে নিয়ে ‘বিরূপ’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছিল এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে। তবে সে সবে তিনি বিশেষ তোয়াক্কা করেননি।
অগস্ট মাসে হাই কোর্টের আইনজীবীদের একাংশ হাই কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে চিঠি (সেই চিঠির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) লেখেন। সেখানে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলা হয়।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্যে স্কুল নিয়োগে যে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে তা ‘শিউরে’ ওঠার মতো। এবং তা নিয়ে একের পর এক রায় দেওয়ার জন্যই তাঁকে নিশানা করছেন অনেকে।
তদন্ত চলাকালীন নিয়োগ দুর্নীতি মামলার জট ধীরে ধীরে আরও খুলতে থাকে। একে একে অনেকগুলি নিয়োগে অসঙ্গতির অভিযোগ এনে আদালতের দ্বারস্থ হন আন্দোলনকারী বহু চাকরিপ্রার্থী। এঁদের মধ্যেই এক জন ছিলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা ববিতা সরকার। তাঁর দাবি ছিল, রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর স্কুলশিক্ষকের চাকরি পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। মন্ত্রীকন্যার নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সরব হন তিনি।
সেই মামলা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ওঠার পর তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি। তদন্তে সেই নিয়োগে অসঙ্গতি উঠে আসে। এর পর মন্ত্রীকন্যার চাকরি বাতিল করে সেই চাকরি ববিতাকে দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানিতে রাজ্যের প্রাথমিক এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদকেও একাধিক কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কত জন অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ম ভেঙে চাকরি দেওয়া হয়েছিল, সেই খতিয়ানও আদালতে পেশ করতে বলেন তিনি। তিনি এ-ও মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘দুর্নীতির ছটা থেকে বেরোতে আরও খানিকটা সময় লাগবে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের।’’
নবম-দশমে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করার পর স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর বক্তব্য জানতে চেয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে দেখা গিয়েছিল, অনেক চাকরিপ্রার্থী উত্তরপত্রে (ওএমআর শিট) ১-২ করে নম্বর পেলেও কমিশনের সার্ভারে সেই নম্বরই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এরও বেশি।
এই প্রসঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ ছিল, উত্তরপত্রে ৩ নম্বর আর স্কুল সার্ভিস কমিশনের সার্ভারে নম্বর বেড়ে হয়েছে ৫৩! পিসি সরকার জুনিয়র না সিনিয়িরের ছোঁয়ায় হঠাৎ এত নম্বর বেড়ে গেল, তা কমিশনের আইনজীবীর কাছে জানতে চান তিনি।
এর মধ্যে নবম-দশমে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের পাশাপাশি ইডিকেও যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
আরও এগিয়ে যায় নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্ত। হাই স্কুলের ১,৯১১ গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। চাকরি যায় নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ থাকা অনেক প্রাথমিক এবং হাই স্কুল শিক্ষকেরও।
নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তকারী কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও তদন্তের গুণমান নিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। সিবিআই-ইডির তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। তদন্তে গতি বাড়ানোর নির্দেশও দেন। আবার তদন্ত ঠিক গতিতে এগোচ্ছে মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির প্রশংসা করতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে ‘মানবিকতা’র দেখা পাওয়া গিয়েছে বলেও রাজ্যের সাধারণ মানুষের একাংশের দাবি।
বীরভূমের নলহাটির বাসিন্দা সোমা রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত। তা সত্ত্বেও তিনি ২০১৯ সাল থেকে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সোমাকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শিক্ষকতার চাকরির বদলে অন্য সরকারি চাকরি গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সোমা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে বিচারপতি তাঁকে জানান, ভবিষ্যতে যদি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার কোনও শূন্য পদ থাকে তবে সোমাকে তা দেওয়া হবে। এর পর সোমাকে অবিলম্বে সহকারী শিক্ষিকার পদে চাকরি দিতে এসএসসিকে নির্দেশ দেয় নবান্ন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে প্রতিবন্ধী শিশুর চিকিৎসার টাকাও পেয়েছেন মিতালি দাস নামে বীরভূমের এক মহিলা। মিতালির বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদ-সহ মোট ১৮টি মামলা দায়ের করেছিলেন তাঁর স্কুলশিক্ষক স্বামী। মিতালি আদালতের দ্বারস্থ হলে তাঁর স্বামীকে ছেলের চিকিৎসা বাবদ মাসিক ১০ হাজার টাকা মিতালির হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। এর পর বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করা তো দূরঅস্ত, সৎছেলের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার দায়িত্বও নেননি তিনি। চাকরি পেয়েই বাড়ি ছেড়ে দেন। অর্থাভাবে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও পাতে পড়ত না পরিবারের। মাধ্যমিকে ভাল ফল করা সত্ত্বেও বাবা-মা হারা ছোট্ট ছেলেটার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ছোট্ট নাতির হাত ধরে বিচারের আশায় কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা ৭৮ বছর বয়সি দয়ানন্দ টিঙ্গুয়া। সেই মামলায় অভিযুক্ত সৎমা পিঙ্কিরানি টিঙ্গুয়ার বেতন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে আনন্দবাজার অনলাইন বইমেলায় প্রশ্ন করেছিল তিনি বই লিখবেন কি না? জবাবে বিচারপতি বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই লিখব। আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা রয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতির কথা অবশ্যই থাকবে। ওই নিয়ে একাধিক মামলা রয়েছে আমার। সেগুলোর কথা থাকবে।’’
সেই ‘গরিব মানুষের ভগবান’ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকেই মামলা সরানোর নির্দেশ দিল শীর্ষ আদালত।
গত বছর একটি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। গত সোমবারই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে অভিযোগ উঠেছিল, কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি স্কুলে নিয়োগের দুর্নীতির মামলা শোনার সময় সেই মামলা নিয়ে টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
এই অভিযোগ শুনে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জানিয়েছিলেন, বিচারপতিরা কোনও ভাবেই তাঁদের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন না। উনি যদি সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি ওই মামলা শোনার অধিকার হারিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে নতুন কোনও বিচারপতিকে দায়িত্ব দিতে হবে। শুক্রবারের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেও তারই প্রতিফলন দেখা গেল।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে যাঁদের স্কুলের বিভিন্ন স্তরে চাকরি গিয়েছে, তাঁদের অনেকে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। চাকরিহারাদের হয়ে আইনজীবী মীনাক্ষী অরোরা জানান, হাই কোর্টের বিচারপতি গত সেপ্টেম্বরে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এ বিষয়ে কী বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ, নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তিনি আগেই বিচার করে ফেলেছিলেন।
শুধুমাত্র তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা মামলা থেকেই সরানো হল, না কি নিয়োগ সংক্রান্ত সব মামলা থেকে, এখনও স্পষ্ট না। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মামলা শোনার অধিকার হারালে তাঁর রায়গুলির কী হবে?