আয়কর জনসাধারণের উপর সরকারের চাপানো একটি কর। সাধারণ মানুষের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ এবং বিধিসম্মত নিয়মের ভিত্তিতে এই কর নেয় সরকার। আয়কর সরকারি রাজস্ব বা আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ভারতে আয়কর চালু করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। কিন্তু তার নেপথ্যে ছিলেন স্কটল্যান্ডের এক ব্যবসায়ী, যাঁর স্মৃতিচিহ্ন এখনও রয়েছে কলকাতায়।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ রাজের ভিত খানিকটা হলেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের অর্থনীতি। যা ব্রিটিশদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল।
সেই সময় ঔপনিবেশিক ভারতকে আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্ত করে অর্থনীতি চাঙ্গা করার ভার দেওয়া হয় স্কটল্যান্ডের ব্যবসায়ী জেমস উইলসনকে। ১৮৫৯ সালে তাঁকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের প্রথম অর্থমন্ত্রী করে কলকাতায় পাঠানো হয়।
১৮৬০ সালে উইলসন ভারতে প্রথম বাজেট পেশ করেন। বাজেটে আয়করের প্রবর্তন করেন তিনি। ভারতে ২৪ জুলাই আয়কর দিবস হিসাবে পালিত হয়। কারণ, ১৮৬০ সালের এই তারিখেই দেশে প্রথম বার আয়করের ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছিল।
১৮০৫ সালের ৩ জুন স্কটল্যান্ডের একটি ছোট শহর হাউইকে জন্মগ্রহণ করেন উইলসন। তবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায়। ১৮৬০ সালের ১১ অগস্ট তিনি মারা যান।
অর্থনীতিতে অগাধ জ্ঞান ছিল উইলসনের। পাশাপাশি বাণিজ্য বিষয়েও তাঁর পাণ্ডিত্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের ভরসার পাত্র করে তুলেছিল।
উইলসন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং চিনের চার্টার্ড ব্যাঙ্কও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৯ সালে সেই ব্যাঙ্ক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে একত্রে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক তৈরি করে।
পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের অন্যতম অর্থনীতিবিদ হিসাবে নামডাক হলেও উইলসন তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এক জন টুপি প্রস্তুতকারক হিসাবে। পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা চালাতে থাকেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকারের নজরে পড়েন উইলসন।
উইলসন ব্রিটেনের অর্থ দফতরের সচিব এবং ‘বোর্ড অফ ট্রেড’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যও হন তিনি।
উইলসন প্রথম ভারতে এসেছিলেন ১৮৫৯ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক পরে। সেই সময় ভারতীয় সিপাহিদের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল ব্রিটিশদের। পাশাপাশি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অত্যধিক ব্যয় সামলাতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল সরকারকে। বাড়ছিল ঋণের বোঝাও। সেই সময়ই ভারতের অর্থনীতির হাল ধরতে ব্রিটিশদের পরিত্রাতা হিসাবে কলকাতায় আসেন উইলসন।
সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে কর কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে এবং নতুন কাগজের মুদ্রার প্রচলন করে ভারতের অর্থব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের কাউন্সিলে অর্থমন্ত্রী করে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে।
উইলসনই ১৮৬০ সালে ভারতে প্রথম বার ব্রিটিশ মডেলের আদলে বাজেট পেশ করেন। প্রথম বারের জন্য দেশবাসীর কাছে আয়করের ধারণা তুলে ধরেন তিনি।
আয়কর নিয়ে উইলসনের যুক্তি ছিল— ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করার জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছে ব্রিটিশ সরকার। তার পরিবর্তে ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং উচ্চবিত্তদের আয়কর হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সরকারের হাতে তুলে দেওয়া উচিত এবং তা ‘ন্যায়সঙ্গত’।
তবে উইলসনের পেশ করা বাজেটে থাকা আয়করের বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কের জন্ম দেয়। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জমিদার এবং উচ্চবিত্তরাও আয়কর নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন।
আয়কর আইনের পাশাপাশি ভারতে লাইসেন্স কর এবং তামাক শুল্কও চালু করেছিলেন উইলসন।
ভারতীয় অর্থনীতির হাল ধরতে ভারতে এলেও আর নিজের দেশে ফেরা হয়নি উইলসনের। কলকাতায় আসার পর থেকেই তিনি শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। কলকাতার গরমের কারণেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পর আমাশয়ে আক্রান্ত হওয়ার পরে ১৮৬০ সালের অগস্ট মাসে কলকাতাতে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর।
ব্রিটিশ সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও উইলসনকে মল্লিক বাজারের একটি অজানা সমাধিস্থলে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের কর ইতিহাসের উপর একটি বই নিয়ে গবেষণা করার সময় আয়করের যুগ্ম কমিশনার সিপি ভাটিয়া ২০০৭ সালে সেই সমাধিস্থল আবিষ্কার করেন। ভাটিয়ার প্রচেষ্টাতেই কলকাতায় উইলসনের শেষ স্মৃতি হিসাবে সমাধিপ্রস্তরটি পুনরুদ্ধার করা হয়।