সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে হুমা কুরেশি অভিনীত ছবি ‘তরলা’। ভারতের বৈগ্রাহিক রন্ধনশিল্পী তরলা দলালের জীবনের নানা মুহূর্ত, নানা লড়াইয়ের কথা ফুটে উঠেছে এই ছবিতে।
রন্ধন নিয়ে চর্চা করেন অথচ তরলার নাম জানেন না, এমন লোক বিরল। ভারতে রন্ধনচর্চাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর।
তরলা ভারতের অন্যতম নামী রন্ধনশিল্পী। রান্না সংক্রান্ত বহু বই-ও তিনি লিখেছেন। নিরামিষ পদ রান্নার ক্ষেত্রে ভারতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আমেরিকার রন্ধনশিল্পী জুলিয়া চাইল্ডের সঙ্গেও তুলনা করা হয় তরলাকে।
এক জন সাধারণ গৃহবধূ থেকে ভারতের সেই সময়ের ‘সেরা’ রন্ধনশিল্পী হয়ে ওঠার তরলার যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। রন্ধনশিল্পে কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ভারত সরকারের তরফে ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়া হয়। তরলা ভারতীয় রন্ধনশিল্পে বিপ্লব এনেছিলেন বলেও অনেকে মনে করেন।
১৯৩৬ সালে ঔপনিবেশিক ভারতে মহারাষ্ট্রের পুণেতে তরলার জন্ম। ১৯৬০ সালে মুম্বইয়ের বাসিন্দা নলিন দলালের সঙ্গে বিয়ের পর তরলাও মুম্বই চলে আসেন।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইতেন তরলা। চাইতেন নিজের চেষ্টায় কিছু করতে। ছোট থেকেই রান্নাবান্নার প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকায় সিদ্ধান্ত নেন, রন্ধনশিল্পী হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করবেন নিজেকে।
১৯৬৬ সালে প্রতিবেশীদের নিয়ে রান্নার ক্লাস শুরু করেন তরলা। তাইল্যান্ড, মেক্সিকো এবং ইটালির বিভিন্ন পদের সঙ্গে ভারতীয় মশলা এবং সব্জি মিশিয়ে রান্না করতে শুরু করেন নতুন নতুন পদ।
খুব শীঘ্রই মুম্বইয়ের বুকে নাম ছড়িয়ে যায় তরলার। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলারা তাঁর রান্নার ক্লাসে যোগ দিতে শুরু করেন।
তরলার ক্লাসের জনপ্রিয়তা দেখে ভারতের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা ‘ভাকিল অ্যান্ড সন্স’ তরলাকে রান্না সংক্রান্ত একটি বই লেখার পরামর্শ দেয়।
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তরলার লেখা প্রথম বই ‘দ্য প্লেজার অফ ভেজিটেরিয়ান কুকিং’। ভারতীয় নিরামিষ পদের পাশাপাশি চিন এবং আমেরিকার বহু নিরামিষ পদ তৈরির রন্ধনপ্রণালীও এই বইয়ে ছিল।
তরলার এই বই গুজরাতি, মরাঠি, বাংলা ভাষার পাশাপাশি ডাচ এবং রুশ ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়েছিল।
একটি বই লিখেই থেমে থাকেননি তরলা। এক এক করে ১৭০টি রন্ধনপ্রণালী সংক্রান্ত বই লিখে ফেলেন তিনি।
বিভিন্ন ধরনের অভিনব প্রাতরাশ এবং কম তেল যুক্ত খাবার রান্নার প্রক্রিয়া তরলা তাঁর বইগুলিতে উল্লেখ করেছেন। কোন খাবার খেলে গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুদের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, তা নিয়েও বই লিখেছেন তিনি।
বছরের পর বছর ধরে, তরলার বইগুলির লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এই সব বইয়ের মাধ্যমেই এক জন সাধারণ গৃহবধূ থেকে ভারতীয়দের হেঁশেলে পৌঁছে যান তরলা।
‘তরলা দলাল ফুডস (টিডিএফ)’ নামে একটি রান্নার মশলার সংস্থাও শুরু করেছিলেন তরলা। মুম্বইয়ের অম্বরনাথ এলাকায় তিনি সেই সংস্থার কারখানা তৈরি করেন।
যদিও ২০১৩ সালে তাঁর এই সংস্থাটি কিনে নেয় ‘কর্ন প্রোডাক্টস কোং (ইন্ডিয়া) লিমিটেড’ নামের একটি সংস্থা।
রান্না সংক্রান্ত একটি দ্বিমাসিক পত্রিকাও ছাপাতে শুরু করেছিলেন তরলা। রান্না সংক্রান্ত একাধিক শোয়ের সঞ্চালনাও শুরু করেন তিনি।
রন্ধনশিল্পে অবদানের জন্য ২০০৭ সালে তরলাকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেয় ভারত সরকার।
১৭ হাজারেরও বেশি রেসিপি দিয়ে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন তরলা। এই ওয়েবসাইটটিকে ভারতের সব থেকে বড় রান্নার ওয়েবসাইট বলে মনে করা হয়। তরলার পুত্র সঞ্জয় দলালের মতে, ওয়েবসাইটটিতে বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার রেসিপি রয়েছে।
২০১৩ সালে ৭৭ বছর বয়সে, মুম্বইয়ের বাসভবনে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তরলা।