দুবাই-কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির থেকে নেওয়া অর্থ এবং উপহারের বিনিময়ে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র লোকসভায় প্রশ্ন করেছেন— এমন অভিযোগ তুলে গত রবিবার লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি পাঠান বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। স্পিকারের কাছে মহুয়াকে সাংসদ পদ থেকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করার আর্জিও জানান।
আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাই মহুয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলে সিবিআই প্রধানকে চিঠি দিয়েছেন। লোকসভা স্পিকার মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কতটা সত্যি, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে লোকসভার এথিক্স কমিটিকে।
নিশিকান্ত এবং দেহাদ্রাইয়ের একই অভিযোগ। তাঁদের দাবি, ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির থেকে অর্থ, উপহার নিয়ে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন মহুয়া। সেই সঙ্গে মোদী এবং শাহেরও নাম জড়িয়েছেন।
এই সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সোমবার আইনি চিঠিও পাঠিয়েছেন মহুয়া। তাতে নিশিকান্ত এবং দেহাদ্রাইয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা বিস্তর অভিযোগ তুলেছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ। দু’জনেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে জানিয়ে মহুয়ার দাবি, প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে সেই বিতর্ককে উস্কে দিয়ে বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে এসেছে ব্যবসায়ী হীরানন্দানির ‘হলফনামা’। হীরানন্দানি ‘হলফনামা’য় স্বীকার করেছেন, তিনি মহুয়াকে ব্যবহার করে লোকসভায় আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলেছেন সংসদে। মহুয়া শিল্পপতিকে সংসদের লগ-ইন আইডি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন নিশিকান্ত। সেটাও স্বীকার করেছেন হীরানন্দানি। মহুয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উপহার নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তাতেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে হীরানন্দানির ‘হলফনামা’য়।
‘হলফনামা’য় আরও বলা হয়েছে, মাঝেমাঝেই নানা আব্দার আসত ব্যবসায়ীর কাছে। দাবি থাকত বিলাসবহুল সামগ্রী, দিল্লির সরকারি বাসভবন সংস্কার করিয়ে দেওয়া, ছুটি কাটানো বা বেড়ানোর খরচের।
হীরানন্দানি এ-ও জানিয়েছেন, মহুয়ার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ২০১৭ সালে। বেঙ্গল বিজ়নেস সামিটে যোগ দিতে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। পরবর্তী কালে মহুয়ার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। মনে হতে থাকে যে মহুয়ার মাধ্যমে তিনি বিরোধী দলশাসিত রাজ্যগুলিতে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। কারণ শ্রী গান্ধী, শশী তারুর, পিনাকি মিশ্রের সঙ্গে মহুয়ার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
মহুয়া অবশ্য আগেই এই সব অভিযোগকে অসত্য বলে দাবি করেছেন। প্রথম থেকেই তাঁর অভিযোগ, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। পাশাপাশি হীরানন্দানির ‘হলফনামা’ নিয়ে শোরগোল পড়তেই পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করেছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া।
মহুয়া প্রশ্ন তুলেছেন, হীরানন্দানির যে বয়ান প্রকাশ্যে এসেছে, তা কি আদৌ তাঁর লেখা? না কি সেই বয়ানের খসড়া তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দফতর (পিএমও) থেকে? মহুয়ার বক্তব্য, হীরানন্দানির ‘হলফনামা’ সাদা কাগজে লেখা হয়েছে। তাতে কোনও ‘অফিশিয়াল লেটারহে়ড’ বা ‘নোটারি’ করা নেই। তৃণমূল সাংসদের প্রশ্ন, মাথায় বন্দুক ঠেকানো না হলে কি হীরানন্দানির মতো এক জন সম্মাননীয় এবং শিক্ষিত ব্যবসায়ী কখনও এ রকম সাদা কাগজে সই করবেন?
‘টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন’ নিয়ে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ গত রবিবার থেকে চলছেই। কিন্তু যে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ এবং উপহার নিয়ে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার অভিযোগ মহুয়ার বিরুদ্ধে উঠেছে, সেই দর্শন হীরানন্দানির পরিচয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কৌতূহল জন্মেছে অনেকের মনেই।
৪২ বছর বয়সি দর্শন সমগ্র হীরানন্দানি গোষ্ঠীর সিইও। হীরানন্দানি গোষ্ঠীর রিয়েল এস্টেট এবং নির্মাণ শিল্পের ব্যবসা। দর্শনের বাবা তথা রিয়েল এস্টেট ‘টাইকুন’ নিরঞ্জন হীরানন্দানি এবং কাকা সুরেন্দ্র হীরানন্দানি ১৯৭৮ সালে হীরানন্দানি গোষ্ঠী শুরু করেন। তখন থেকে হীরানন্দানি গোষ্ঠী পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের হাতেই। সেই হীরানন্দানি গোষ্ঠীরই উত্তরসূরি দর্শন।
হীরানন্দানি পরিবারের অফিস নিডর গোষ্ঠীরও সিইও দর্শন। সংবাদমাধ্যম মানি কনট্রোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দর্শন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘ইয়োটা ডেটা সার্ভিসেস’-এর চেয়ারম্যান।
তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিকাঠামো সংস্থা ‘এইচ-এনার্জি’রও চেয়ারম্যান দর্শন। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
দর্শনের লিঙ্কডিন প্রোফাইল অনুযায়ী, তিনি নিউ ইয়র্কের ‘রচেস্টার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ থেকে প্রথমে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। পরে এমবিএ করেন।
দর্শনের লিঙ্কডিন প্রোফাইলে লেখা, “দর্শন হীরানন্দানি গ্রুপের রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, তথ্য, ক্লাউড কম্পিউটিং, শক্তি এবং লজিস্টিক্সের মতো উদীয়মান শিল্পেও বৈচিত্র এনেছেন।’’ দর্শন দেশের পরিকাঠামো এবং আর্থিক বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছেন বলে সেখানে দাবি করা হয়েছে।
২০০৪ সালে নিজেদের নির্মাণ শিল্পকে বিদেশের মাটিতে পৌঁছে দেন দর্শন। দুবাইয়ে ২৩ মেরিনা নামে একটি বহুতল আবাসন তৈরি করে হীরানন্দানি গোষ্ঠী। এটি বিশ্বের উচ্চতম বহুতল আবাসনগুলির মধ্যে অন্যতম।
২০১৭ সালে ‘এইচ-এনার্জি’ সংস্থা শুরু করেন দর্শন। সেই সংস্থার প্রকল্প হিসাবে মহারাষ্ট্রে ভারতের প্রথম ভাসমান তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন তৈরি করেন।
দর্শন ২০২০ সালে ‘ইয়োটা ডেটা সার্ভিসেস’ শুরু করেন। ২০২০ সালে আমেরিকার বিনিয়োগকারী সংস্থা ‘ব্ল্যাকস্টোন’-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে ‘গ্রিনবেস’ নামে একটি শিল্প উদ্যান তৈরি করেন তিনি।
‘দ্য অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’র অন্যতম সদস্য দর্শন। তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছেন, সেই ‘রচেস্টার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য।
হায়দরাবাদের একটি অসরকারি সংস্থা ‘সিন্ধ ন্যাশনাল কলেজিয়েট বোর্ড’-এর উপদেষ্টা বোর্ডেও রয়েছেন এই শিল্পপতি। এই সংস্থার অধীনে ১৭টি কলেজ রয়েছে।
হীরানন্দানি গোষ্ঠীর পরিচালনা পর্ষদের অংশ হিসাবে দর্শন একটি হাসপাতালও তৈরি করেছেন। ভারতের অন্যতম ‘সেরা হাসপাতাল’-এর তকমাও পেয়েছে সেই হাসপাতাল।
বহু বছর ধরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু আবাসন, বিলাসবহুল অট্টালিকা, রিসর্ট, পার্ক তৈরি করেছে হীরানন্দানি গোষ্ঠী।
চলতি বছরের এপ্রিলে দর্শনের বাবা নিরঞ্জন জানিয়েছিলেন, হীরানন্দানি গোষ্ঠী এ বার বিভিন্ন পুরনো আবাসন এবং বহুতল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যবসাতেও ঢুকতে চলেছে। সেই গোষ্ঠীরই উত্তরসূরি দর্শন জড়িয়ে গেলেন ‘টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন’ বিতর্কে।