কম বয়সেই ডাকসাইটে সুন্দরী বলে বলিপাড়ায় নিজের পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছিলেন পুনম ধিলঁ। যশ চোপড়ার হাত ধরে অভিনয় শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথম ছবিতেই অমিতাভ বচ্চন, শশী কপূরের মতো অভিনেতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন পুনম। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব তাঁর কাজের মধ্যে পড়তে থাকে। ফলে সাফল্যের স্বাদ চেখে দেখা অভিনেত্রীর কেরিয়ারের প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে যায়।
পুনমের জন্ম কানপুরে হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা চণ্ডীগড়ে। পুনমের বাবা সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ করতেন। মা ছিলেন স্কুলের অধ্যক্ষ। দুই ভাইবোন-সহ চণ্ডীগড়েই থাকতেন পুনম। তিন ভাইবোনই পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন। তবে, ভাগ্যের ফেরে পুনম অভিনয়ে নামেন। তাঁর ভাইবোনেরা দু’জনেই পেশায় চিকিৎসক।
চণ্ডীগড়ের কার্মেল কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করতেন পুনম। এক দিন হঠাৎ তিনি জানতে পারেন যে, তাঁর স্কুলের পাশে রাজেশ খন্না একটি ছবির শুটিং করতে এসেছেন। সরাসরি শুটিং দেখবেন বলে পুনম এবং তাঁর বন্ধুরা সকলে দল বেঁধে শুটিংয়ের জায়গায় পৌঁছন। শুটিংয়ের ফাঁকে হঠাৎ পুনমের দিকে চোখ পড়ে রাজেশের।
পুনমকে ডেকে রাজেশ বলেন, ‘‘তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর। ছবিতে অভিনয় করতে চাও তুমি?’’ অভিনেতার প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দেন পুনম। জানান যে, তিনি এখনও স্কুলে পড়ছেন। পড়াশোনাই করতে চান, অভিনয় করবেন না বলেও রাজেশকে জানিয়েছিলেন পুনম।
কিন্তু রাজেশের কথা মনে থেকে যায় পুনমের। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপের ছটাও বাড়তে থাকে তাঁর। তাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নামার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। কিন্তু চণ্ডীগড়ের মতো জায়গায় সেই সময় ফ্যাশন, মডেলিংয়ের বেশি চল ছিল না। তাই পুনম তাঁর বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।
সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার পর একে একে প্রতিটি পর্ব জিততে শুরু করেন পুনম। একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর বিভিন্ন নামী সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিততে থাকেন তিনি। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নামী পত্রিকায় পুনমের ছবি ছাপা হয়।
পুনমের ছবি নজরে পড়ে পরিচালক যশ চোপড়ার। ‘ত্রিশূল’ ছবির জন্য নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন তিনি। পুনম চণ্ডীগড়ের বাসিন্দা জানার পর যশ তাঁর বন্ধু বলবন্ত গর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পঞ্জাব ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন বলবন্ত। তাঁকে পুনমের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন যশ।
তবে, যশের প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হননি পুনম। তিনি ভেবেছিলেন যে, অভিনয় করলে তাঁর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। কিন্তু পুনমের বাবা-মাকে যশ আশ্বাস দেন যে, শুটিং খুব কম দিনেই শেষ হয়ে যাবে। যশের কথায় রাজি হয়ে মেয়েকে অভিনয়ের জন্য অনুমতি দেন পুনমের বাবা-মা।
১৯৭৮ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘ত্রিশূল’ ছবিটি। এই ছবিতে অমিতাভ বচ্চন, সঞ্জীব কুমার, শশী কপূর, রেখা, হেমা মালিনী, ওয়াহিদা রহমানের মতো তারকাদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন ১৬ বছর বয়সি পুনম। পুনমের অভিনয় মনে ধরে যশের।
‘ত্রিশূল’ ছবিতে ‘গাপুচি গাপুচি গাম গাম’ নাচের দৃশ্যে সচিন পিলগাঁওকরের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন পুনম। এই গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেই সময়। পুনমকে পরবর্তী ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যশ।
যশের প্রস্তাবে পুনম রাজি থাকলেও পরিস্থিতি তাঁর পক্ষে ছিল না। শুটিংয়ের তারিখের দিনগুলিতেই পুনমের পরীক্ষা ছিল। এই অবস্থায় কোনও ভাবেই পুনম শুটিং করতে পারতেন না। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করলেন যশ। পুনমের পরীক্ষার তারিখের দিকে খেয়াল করে শুটিংয়ের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছিলেন।
দিল্লিতে পরীক্ষা দিয়ে বিমানে উড়ে মুম্বইয়ে শুটিং করতে গিয়েছিলেন পুনম। কম বাজেটের ছবি ‘নুরী’ ছবিতে ফারুক শেখের বিপরীতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এই ছবির শুটিংয়ের জন্য কাশ্মীরেও গিয়েছিলেন অভিনেত্রী। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর এই ছবিটি বক্স অফিসে সুপারহিট হয়। পুনমের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে ওঠে।
পুনমকে নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন যশ। অভিনেত্রীর কেরিয়ার নিজের হাতে গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুনম ইন্ডাস্ট্রিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন বলে পুনমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন যশ। যশের সঙ্গে কাজ করার সময় পরিচালকের সহকারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পুনম।
যশের শুটিং সেটে বেশির ভাগ সময় উপস্থিত থাকতেন রমেশ তলওয়ার। কর্মসূত্রে পুনমের সঙ্গে আলাপ হয় রমেশের। ক্রমে এই আলাপ প্রেমে পরিণত হয়। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেননি। বলিপাড়া থেকে তাঁদের সম্পর্কের কথা গোপন রেখেছিলেন পুনম এবং রমেশ। কিন্তু গোল বাধালেন ঋষি কপূর।
‘ইয়ে ওয়াদা রহা’ ছবির জন্য পুনমের সঙ্গে ফোটোশ্যুট করছিলেন ঋষি। ছবি যেন আরও ভাল আসে সেই কারণে ঋষি এবং পুনমকে আরও কাছাকাছি আসতে বলেন আলোকচিত্রীরা। কিন্তু ফোটোশ্যুটের মাঝে হঠাৎ ঋষি বলে বসেন, ‘‘মাথাখারাপ নাকি! রমেশ তলওয়ারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।’’ ঋষির এমন মন্তব্যে ঝড় ওঠে বলিপাড়ায়।
কানাঘুষো শোনা যায়, পুনম এবং রমেশ বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন। বিয়ের পর একসঙ্গে থাকবেন বলে পুনমের জন্য মুম্বইয়ের জুহু এলাকায় একটি বাংলোও নাকি কিনেছেন রমেশ। পুনম এবং রমেশের সম্পর্কের কথা জানার পর যশ রেগে গিয়েছিলেন। পুনম নিজের কেরিয়ার ছেড়ে অন্য দিকে মন দিয়েছেন শুনে যশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পুনমের সঙ্গে আর কোনও ছবিতে কাজ করবেন না তিনি।
শুধুমাত্র রমেশই নন, যশের সঙ্গেও পুনমের অন্য রকম সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করতে শুরু করে বলিপাড়ার একাংশ। পুনম এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, যশ তাঁর কাছে গুরুর সমান। এ সব ভুয়ো খবর রটানো হচ্ছে বলে জানান পুনম। তার পর যশের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেন তিনি। রমেশের সঙ্গে পরে দু’টি ছবিতে কাজ করলেও রমেশের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেন অভিনেত্রী।
কিন্তু এত বিতর্কের পরেও জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র আঁচ পড়েনি পুনমের। একের পর এক হিন্দি ছবিতে নামকরা তারকাদের সঙ্গে কাজ করছিলেন তিনি। শুধু হিন্দি ছবিতেই নয়, ‘ন্যায়দণ্ড’ নামের বাংলা ছবি থেকে শুরু করে কন্নড়, তামিল এবং তেলুগু ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
অভিনয়ের পাশাপাশি স্নাতক স্তরের পড়াশোনাও শেষ করেন পুনম। কিন্তু সিনেমা করতে গিয়েই আবার প্রেমে পড়েন অভিনেত্রী। পরিচালক রাজ এন সিপ্পির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পুনম।
পুনমের সঙ্গে সম্পর্কে থাকলেও রাজ তখন বিবাহিত ছিলেন। পুনম চাইছিলেন রাজের সঙ্গে সংসার করতে। কিন্তু রাজ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদে নারাজ ছিলেন। অন্য দিকে পুনমও দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে থাকতে রাজি ছিলেন না। তাই রাজের সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানেন পুনম। বিচ্ছেদের কিছু দিন পর বাবা মারা যান পুনমের।
বাবাকে হারানোর পর ধীরে ধীরে নিজেকে একা করে ফেলেছিলেন পুনম। সেই সময় উমেশ মেহরা নামে পুনমের এক বন্ধু লোনাভলার একটি ফার্মহাউসে হোলির জন্য পার্টির আয়োজন করেন। পুনমের মন যেন ভাল হয়, তাই তাঁকে জোর করে অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলেন উমেশ। কিন্তু পুনম শর্ত রেখেছিলেন যে, পার্টিতে গেলেও রং খেলবেন না তিনি।
হোলির অনুষ্ঠানে এক জায়গায় চুপচাপ বসেছিলেন পুনম। হোলির পার্টিতে রং নিয়ে খেলতে না দেখে পুনমের সঙ্গে কথা বলতে আসেন অশোক ঠাকেরিয়া। আসল কারণ শুনে অশোক জিজ্ঞাসা করেন যে, রং না মাখলেও হোলির দিনে জলে তো ভিজতে পারেন পুনম? সেই মুহূর্ত থেকেই অশোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় পুনমের। বন্ধুত্ব ভালবাসায় গড়ালে পুনমকে প্রেম নিবেদন করেন অশোক।
পুনম যত দিন প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, তত দিন অভিনেত্রীকে নিয়মিত ফুল পাঠাতেন অশোক। অশোকের প্রস্তাবে রাজি হলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন দু’জনে। ১৯৮৮ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন পুনম এবং অশোক। এক পুত্র এবং কন্যাসন্তানের জন্ম দেন পুনম। অভিনেত্রী ভেবেছিলেন যে, এ বার সংসারেই মন দেবেন তিনি। অভিনয় থেকে সাময়িক বিরতি নেন পুনম। কিন্তু অশোকের সঙ্গে ক্রমশই দূরত্ব বাড়তে থাকে তাঁর।
পুনমের দাবি, সংসারে বিন্দুমাত্র সময় দিতেন না অশোক। এমনকি, ছুটির দিনেও বাড়িতে থাকতেন না তিনি। পুনম খবর পান যে, অন্য এক মহিলার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছেন অশোক। এই প্রসঙ্গে সরাসরি অশোককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি পুনমের কথায় কোনও পাত্তা দেন না। বরং পরকীয়া সম্পর্কটি আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে পুনমও পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান। দুবাইয়ের এক ব্যবসায়ী কিকুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। মাঝেমধ্যেই দুবাইয়ে যেতেন তিনি। পুনমের সঙ্গে দেখা করতে কিকুকেও মুম্বইয়ে আসতে দেখা যেত। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। অন্য দিকে, ১৯৯৭ সালে অশোকের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর দুই সন্তান নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন অভিনেত্রী।
দীর্ঘ বিরতির পর আবার বড় পর্দায় ফিরে আসতে চাইলে ভাল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাননি পুনম। তাই ছোট পর্দায় বিভিন্ন ধারাবাহিকে অভিনয় করতে শুরু করেন তিনি। এমনকি, থিয়েটারেও অভিনয় করেন তিনি। পুনম অভিনীত ‘দ্য পারফেক্ট ওয়াইফ’ নাটকটি বহুল প্রশংসা কুড়োয়। ‘বিগ বস’ রিয়্যালিটি শোয়ের তৃতীয় পর্বে প্রতিযোগী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
সমাজসেবার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হন পুনম। ২০০৪ সালে বিজেপি দলের সদস্য হিসাবে যুক্ত হন তিনি। মেকআপ ভ্যানের ব্যবসাও শুরু করেন।
শুধু তা-ই নয়, ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস নিয়ে এমবিএ পড়ার এক বছর পর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থাও খোলেন। ওই সংস্থার তরফে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
পরে ‘রামাইয়া শ্রীবাস্তবা’, ‘জয় মাম্মি দি’, ‘প্ল্যান এ প্ল্যান বি’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আবার বড় পর্দায় ফিরছেন পুনম। ইনস্টাগ্রামে নিজের অনুরাগীমহলও তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই অনুরাগীর সংখ্যা তিন লক্ষের গণ্ডি ছাড়িয়েছে অভিনেত্রীর।