নব্বইয়ের দশকে বলিপাড়ায় ডাকসাইটে সুন্দরী এবং ব্যস্ততম অভিনেত্রীদের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছিলেন আয়েশা জুলকা। শুধু হিন্দি ছবিই নয়, বাংলা, ওড়িয়া,কন্নড় এবং তেলুগু ভাষার ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।
সলমন খান, আমির খান, গোবিন্দ, অক্ষয় কুমার, মিঠুন চক্রবর্তী, নানা পটেকরের মতো তারকাদের সঙ্গে একের পর এক হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির লোকজন তাঁকে বার বার এমন ভাবে ঠকিয়েছিলেন যে, বলিপাড়া থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিরতি নিতে বাধ্য হন নায়িকা।
১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে জন্ম আয়েশার। তাঁর বাবা ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন। বাবার চাকরিতে বদলির কারণে শ্রীনগর থেকে দিল্লি চলে আসে আয়েশার পরিবার।
দিল্লিতে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন আয়েশা। ছোটবেলা থেকেই মডেলিংয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু সাহস জুগিয়ে উঠতে পারতেন না তিনি। প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর আয়েশা দিল্লি ছেড়ে মুম্বই চলে যান।
মুম্বইয়ে গিয়ে মডেলিং শুরু করেন আয়েশা। মডেলিংয়ের পাশাপাশি বড় পর্দায় অভিনয়ের জন্যও অডিশন দিতে শুরু করেন তিনি। মডেল হিসাবে ভালই নামডাক হয়েছিল তাঁর।
অডিশন দেওয়ার পর ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্যায়সে ক্যায়সে লোগ’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করার সুযোগ পান আয়েশা। তার পর ১৯৯১ সালে ‘মীত মেরে মন কে’ ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। কিন্তু দু’টি ছবির মধ্যে একটিও সফল হয়নি।
কেরিয়ারের শুরুতেই বড় সুযোগ পান আয়েশা। ১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কুরবান’ ছবিতে সলমন খানের বিপরীতে কাজ করেন তিনি। ওই ছবিতে আয়েশার অভিনয় সকলের মনে ছাপ ফেলে।
‘খিলাড়ি’, ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’, ‘ওয়াক্ত হমারা হ্যায়’, ‘এক্কা রাজা রানি’র মতো হিট ছবিতে অভিনয় করেছেন আয়েশা। আমির খান, অক্ষয় কুমার, নানা পটেকরের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি বাংলা ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল আয়েশাকে। অভিনেত্রী যখন তাঁর কেরিয়ারের মধ্যগগনে, তখন একটি ছবিতে নগ্ন দৃশ্যের ব্যবহার আয়েশার কেরিয়ারে কালো ছাপ ফেলে দেয়।
প্রকাশ মেহরার প্রযোজনায় ১৯৯৩ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ‘দালাল’ ছবিটি। এই ছবিটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন পার্থ ঘোষ। মিঠুন চক্রবর্তী, রাজ বব্বরের সঙ্গে পর্দা ভাগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন আয়েশা।
প্রকাশ জানিয়েছিলেন যে, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে নগ্ন অথবা অর্ধনগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে আয়েশাকে। কিন্তু অভিনেত্রী এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তাঁর মনে হত, দর্শক যদি তাঁকে এমন দৃশ্যে কাজ করতে দেখেন তা হলে তাঁকে ‘বি গ্রেড’ নায়িকাদের মতো ভাবতে শুরু করবেন। তিনি এমন দৃশ্যে অভিনয় করবেন না বলে জানিয়ে দেন।
আয়েশার শর্ত মেনে নেন ছবি নির্মাতারা।কোনও রকম খোলামেলা দৃশ্য ছাড়াই ছবির শুটিং চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। কিন্তু শুটিং চলাকালীন আয়েশা ফ্লোরে কানাঘুষো শুনতে পান যে, নায়িকার এক ‘বডি ডবল’কে দিয়ে নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করানো হচ্ছে। এই খবর শোনার পর সরাসরি প্রযোজক এবং পরিচালকের কাছে ছুটে যান তিনি।
আয়েশাকে আড়ালে রেখে কোনও শুটিং করানো হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করেন ছবি নির্মাতাদের। ছবি নির্মাতা-সহ প্রকাশের স্ত্রী অভিনেত্রীকে আশ্বাস দেন যে, আলাদা ভাবে কোনও দৃশ্য শুট করা হচ্ছে না।
কিন্তু ছবি মুক্তি পাওয়ার পর অবাক হয়ে যান আয়েশা। তিনি দেখেন যে, ছবিতে একটি নগ্ন দৃশ্যে তিনি অভিনয় করছেন। আসলে অভিনয় করেছেন তাঁর ‘বডি ডাবল’। তবে, দর্শকের পক্ষে তা বোঝার সাধ্যি নেই। এই নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানান আয়েশা। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
বলিপাড়ায় প্রকাশের প্রভাব থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাইছিলেন না। এর পর আয়েশা প্রকাশের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। আয়েশাকে তিনি জানান যে, প্রকাশ মাঝেমধ্যেই দর্শকের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এমন পথ নেন।
ছবি থেকে দৃশ্যটি সরিয়ে ফেলার জন্য প্রকাশ এবং পার্থকে অনুরোধ করেছিলেন আয়েশা। কিন্তু প্রকাশ জানান যে, তা সম্ভব নয়। সিনেমাটি বাজারে বিক্রি করার জন্য তাঁকে এই দৃশ্যটি রাখতেই হবে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুখ খুলতে থাকেন আয়েশা।
প্রকাশ এবং পার্থ মিলে কী ভাবে আয়েশাকে ঠকিয়েছেন, গণমাধ্যমের কাছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন অভিনেত্রী। পার্থ এর জন্য চিঠি লিখে আয়েশার কাছে ক্ষমা চাইলেও প্রকাশ তাঁকে হুমকি দিতে শুরু করেন বলে অভিযোগ।
ছবির প্রস্তাব গ্রহণ করার সময় যে কাগজে আয়েশা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাতে প্রথম শর্ত হিসাবে লেখা ছিল যে, ছবির প্রয়োজনে ছবি নির্মাতারা যা যা করতে বলবেন, অভিনেত্রী তা করতে বাধ্য। স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র অভিনেত্রীকে পাঠানোর পর প্রকাশ বলেন, ‘‘তুমি এ বার থেমে যাও। না হলে পারিশ্রমিক হিসাবে যে আরও এক লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা আর পাবে না।’’
প্রকাশের হুমকিতে ভয় পেয়ে যান আয়েশা। হাজার অনুরোধের পরেও ছবি থেকে দৃশ্যটি সরিয়ে নেননি নির্মাতারা। অভিনেত্রীর কেরিয়ারের গ্রাফও এর পর নীচের দিকে নামতে থাকে। এক সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী বলেছিলেন, ‘‘আমি এ বার বলিপাড়া থেকে বিরতি নেব। এত মানসিক চাপ আর সহ্য করতে পারছি না।’’
কেরিয়ারের শুরুতেও বাধা এসেছিল আয়েশার জীবনে। ‘নরসিংহ’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন আয়েশা। পরে তিনি সংবাদপত্র থেকে জানতে পারেন যে, তাঁর পরিবর্তে ঊর্মিলা মাতন্ডকর এই ছবিতে অভিনয় করছেন।
কিন্তু আয়েশাকে ছবি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রযোজক বা পরিচালক তাঁকে কেউ কিছু জানাননি। এই ঘটনায় আঘাত পেয়েছিলেন অভিনেত্রী। তবে, আয়েশার ব্যক্তিগত জীবনও চলচ্চিত্রের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না।
শোনা যায় আয়েশা তাঁর সহ-অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী এবং অক্ষয় কুমারের সঙ্গে সম্পর্কে এসেছিলেন। কিন্তু কোনও সম্পর্কই বেশি দূর এগোয়নি। পরবর্তী কালে নানা পটেকরের সঙ্গেও তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু নানার খারাপ আচরণের কারণে তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় আয়েশার। ২০০৩ সালে ব্যবসায়ী সমীর ভাশীকে বিয়ে করেন তিনি।
বলিপাড়া থেকে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আয়েশা। তার পর ১২ বছরের বিরতি নিয়ে ২০২২ সালে ‘হাশ হাশ’ ওয়েব সিরিজ়ের মাধ্যমে ক্যামেরার সামনে ফিরে আসেন তিনি।
শুক্রবার ‘হ্যাপি ফ্যামিলি: কনডিশনস অ্যাপ্লাই’ ওয়েব সিরিজ়টি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। এই সিরিজ়ে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে আয়েশাকে। এই ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করেছেন রত্না পাঠক শাহ, রাজ বব্বর, অতুল কুলকার্নির মতো তারকারাও।