টেলিভিশনে ধারাবাহিকে অভিনয় থেকে কেরিয়ারের শুরু। তার পর থিয়েটার। থিয়েটারের পর বড় পর্দায় আসা অরুণ বক্সীর। অভিনয়ের পাশাপাশি অজয় দেবগন এবং গোবিন্দের মতো অভিনেতাদের কণ্ঠে গানও গেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই অর্থে বলিপাড়ায় পরিচিতি গড়ে ওঠেনি অরুণের।
পঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম অরুণের। তাঁর বাবা পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। অরুণের মা কীর্তন এবং ভজন গাইতেন। জন্মের পর অরুণকে নিয়ে এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। অরুণকে দেখে ওই জ্যোতিষী নাকি জানিয়েছিলেন যে, সমুদ্রের ধারের কোনও শহরে অরুণ তাঁর কেরিয়ার তৈরি করবেন।
জ্যোতিষীর কথা মনে রেখেছিলেন অরুণ। লুধিয়ানায় স্কুল এবং কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। লুধিয়ানার আর্য কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করছিলেন অরুণ। কলেজে পড়াকালীন দারিদ্রের মুখ দেখতে হয় অরুণের পরিবারকে।
চিকিৎসকের পেশায় থেকেও যথেষ্ট রোজগার করতে পারছিলেন না অরুণের বাবা। সংসারে আর্থিক টানাপড়েন দেখা দেওয়ায় অরুণের মা গানকে পেশা বানিয়ে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কীর্তন গেয়ে অর্থ উপার্জন করতেন তিনি।
কলেজে পড়ার সময় অরুণ ভেবেছিলেন যে, অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি সেই ক্ষেত্রেই পেশাদার হবেন। কিন্তু পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় লুধিয়ানায় একটি রেডিয়ো স্টেশনে কণ্ঠশিল্পীর কাজে যুক্ত হন।
কণ্ঠশিল্পী হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি লুধিয়ানায় থিয়েটারের দলেও যোগ দেন অরুণ। অভিনয় নিয়ে এগিয়ে যাবেন বলে লুধিয়ানার রেডিয়ো স্টেশন থেকে মুম্বইয়ে বদলি নিতে চান তিনি। শৈশবে ওই জ্যোতিষীর বলা কথাগুলোও মনে ছিল তাঁর।
অরুণ বিশ্বাস করতেন যে, মুম্বইয়ে যাওয়ার পর তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই আশায় মুম্বইয়ের রেডিয়ো স্টেশনে যুক্ত হন তিনি। বলিপাড়ার খোঁজখবর রাখার জন্য তিনি সবসময় নিজের কাছে খবরের কাগজ রাখতেন।
খবরের কাগজ পড়ে অরুণ বুঝতে পারেন কী ভাবে সহজে অভিনয়ে নামা সম্ভব। রেডিয়ো স্টেশনে কাজ করার সূত্রে আমীন সাইনীর সঙ্গে পরিচয় হয় অরুণের।
অরুণকে ফিল্ম জগৎ এবং থিয়েটারে নামার উপদেশ দিয়েছিলেন আমীন। আমীন জানিয়েছিলেন যে, অরুণ যা চাইছেন তা রেডিয়ো স্টেশনে কাজ করে পাবেন না। ফিল্মজগ এবং থিয়েটারের মঞ্চ থেকে অরুণ কেরিয়ারের ধাপে উঠতে পারবেন বলে জানান আমীন।
আমীনের উপদেশ মেনে থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন অরুণ। তার পর একটি থিয়েটার দলে অভিনয় করতে শুরু করেন তিনি। দিন প্রতি ৫ টাকা পারিশ্রমিক পেতেন অরুণ। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি অরুণকে এক কাপ কাটিং চা এবং বড়া পাও খেতে দেওয়া হত।
তবে নাটক করে নিজের পরিচয় তৈরি করেছিলেন অরুণ। প্রথম নাটকে অভিনয় করেই বাজিমাত করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রচুর শো করতে হয়েছিল তাঁকে। এমনকি, ওই নাটকে গানও গেয়েছিলেন অরুণ।
কিন্তু নাটক করে নিজের নাম হলেও সে ভাবে উপার্জন হচ্ছিল না অরুণের। তাই তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁকে এত ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে দেওয়া হত যে, দর্শক তাঁকে বড় পর্দায় চিহ্নিত করে উঠতে পারতেন না।
১৯৮১ সালে ‘সাজায়ে মত’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করতে দেখা যায় অরুণকে। বিআর চোপড়ার ‘মহাভারত’ ধারাবাহিকে ‘ধৃষ্টদ্যুম্ন’ চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর পরিচিতি বেড়ে ওঠে।
বড় পর্দায় অরুণকে অভিনয়ের ভাল সুযোগ দিয়েছিলেন কে বালাচন্দর। ১৯৮৩ সালে কমল হাসনের সঙ্গে ‘জ়ারা সি জিন্দেগি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তার পর গোবিন্দ এবং রাজেশ খন্নার সঙ্গে ‘স্বর্গ’ ছবিতেও কাজ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
‘বোল রাধা বোল’, ‘চমৎকার’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অরুণ। আশির দশকে বেশির ভাগ ছবিতেই পার্শ্বচরিত্রে কাজ করে বলিপাড়ায় তাঁর পরিচিতি আরও বেড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু কেরিয়ারের সিড়ি বেয়ে আরও উপরে উঠতে চাইছিলেন অরুণ। বড় পর্দায় ভাল মানের কাজ খোঁজার জন্য ক্লাবে স্কোয়াশ খেলাও শুরু করেছিলেন তিনি। আশির দশকে বলিপাড়ার নামকরা ছবি নির্মাতা থেকে শুরু করে তারকারা নিয়মিত ওই ক্লাবে যেতেন। তাঁদের নজরে পড়তেই রোজ ক্লাবে যেতেন অরুণ।
এক দিন ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় গজল গেয়ে শোনান অরুণ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল সুরকার জুটির লক্ষ্মীকান্ত। অরুণের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। সেই মুহূর্তে ‘কর্ম’ ছবির জন্য কাজ করছিলেন লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল। অরুণকে ওই ছবির প্রথম গানটি গাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা।
এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি অরুণকে। সঞ্জয় দত্ত, অজয় দেবগন, গোবিন্দের মতো অভিনেতাদের কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে আড়াইশোর বেশি ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। হিন্দি, ভোজপুরী এবং পঞ্জাবি ভাষার ১০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন অরুণ।
অভিনেতা এবং সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে সফল হলেও বলিপাড়া থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করেছেন অরুণ। এখন আর কাজের তেমন সুযোগ পান না বলে দাবি করেছেন অরুণ নিজেই।
এক সাক্ষাৎকারে অরুণ বলেছিলেন যে, তিনি এই জীবন নিয়েই খুশি। তাঁর জীবনে যশ চাই না। যতটুকু পেয়েছেন, যতটুকু রয়েছে তা নিয়ে আনন্দেই আছেন অরুণ।