একাধিক দাবি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বালুচিস্তানের মানুষ। সেখানে চলল পুলিশের গুলি। যার জেরে উত্তেজনা ছড়ায় পাকিস্তানের গ্বদর এলাকায়। বালুচিস্তানের পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়।
ঘটনার সূত্রপাত শনিবার। বালুচ ইয়াকজেহতি কমিটি (বিওয়াইসি)-র নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর গ্বদরে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ দেখানোর জন্য জড়ো হতে শুরু করেন। রবিবার থেকে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
গ্বদর একটি অবরুদ্ধ শহর। ফলে পাকিস্তানের মানুষেরাও ঠিক মতো জানেন না যে সেখানে কী চলে। বালুচিস্তানের মানুষদেরও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
বিওয়াইসির নেতা মাহরাং বালুচের নেতৃত্বে বালুচিস্তানের বহু মানুষ রবিবার গ্বদরের উপান্তে জড়ো হয়েছিলেন। মূল উদ্দেশ্য, পাকিস্তানি পুলিশের হাতে আটক প্রতিবাদীদের মুক্তি এবং বালুচিস্তানের উপর দিয়ে যাওয়া চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি)-এর বিরোধিতা করা। পাশাপাশি গ্বদরে বালুচদের অবাধে প্রবেশের দাবি তুলেও রাস্তায় নামেন তাঁরা।
সমাবেশ চলাকালীন মাহরাং বলেন, “গ্বদর বালুচদের জায়গা। আমাদের শহরে প্রবেশে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।”
অভিযোগ, এই নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালীন প্রতিবাদীদের উপর চড়াও হয় নিরাপত্তবাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। বিক্ষোভ দমন করতে সমাবেশ থেকে বহু মহিলা এবং পুরুষকে আটক করার অভিযোগও উঠেছে সে দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর পরে উত্তেজনা আরও ছড়ায়। বালুচিস্তানের মানুষের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়। মাস্তুং থেকে তুরবত এবং খুজদার থেকে কোয়েটা পর্যন্ত প্রতিটি শহরই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
ভাইরাল কয়েকটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। মানবাধিকার কর্মী সামি দ্বীন বালোচ, সিবাগতুল্লাহ শাহ, সাবেহা বালোচ এবং অগণিত বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করার ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, তাঁদের সঙ্গে আলোচনার জন্য গ্বদরে দল পাঠানোর পরিবর্তে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী হামলা চালিয়েছে তাদের উপর। যার ফলে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। বিওয়াইসি নেতাদেরও গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি।
পুরো ঘটনার একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। ভিডিয়োয় ওয়ালিদ নামে এক জন দাবি করছেন যে, পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিওয়াইসি নেতৃত্বের উপর গুলি চালানোর জন্য পাঠিয়েছে। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল এবং একটি ওয়াকিটকিও উদ্ধার হয়েছে। তবে সেই ভিডিয়োটিরও সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
এই নিয়ে বালুচিস্তানে উত্তেজনা এখনও অব্যাহত। গ্বদর এবং চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) নিয়ে বিতর্কও অনেক দিনের।
বছর দুয়েক ধরে পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে চলেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছে। ইসলামাবাদের উপর ভারী হয়েছে ঋণের বোঝা। এই পরিস্থিতিতে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছিল। তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় চিন। তারা পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য করেছে। সে দেশে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প শুরু করেছে বেজিং।
পাকিস্তানের উপর দিয়ে তিন হাজার কিলোমিটারের চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) তৈরি করছে বেজিং। এই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশে রাস্তা এবং রেলপথ নির্মিত হবে। চিনের কাশগড় থেকে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর হয়ে ইসলামাবাদ, লাহোর পেরিয়ে আরব সাগরের তীরে গ্বদর পর্যন্ত বিস্তৃত সিপিইসি। এই করিডর নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে চিন।
তবে চিন অবশ্য নিঃস্বার্থে কিছু করছে না। পাকিস্তানে সিপিইসি তৈরি হলে আখেরে বেজিংয়ের লাভ। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত অবাধে যাতায়াত করতে পারবে তারা। তবে পাকিস্তানের দাবি, চিনের পাশাপাশি এতে লাভ হবে তাদেরও।
সিপিইসির অধিকাংশই কিন্তু পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের উপর দিয়ে পরিকল্পিত। আর এখানেই ধাক্কা খাচ্ছে চিন। পাকিস্তানের এই বিশেষ প্রদেশটিতে তারা পদে পদে প্রতিহত হচ্ছে।
বালুচিস্তানের মানুষের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। এই অঞ্চলের মানুষ পাক সরকারকে স্বীকার করে না। বরং তাদের দাবি, জোর করে তাদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বালুচিস্তানের দাবি, পাকিস্তানের জন্মের পর ১৯৪৮ সালের ২৭ মার্চ অন্যায় ভাবে বালুচিস্তান দখল করে পাক সেনা। তার আগে এটি একটি স্বাধীন প্রদেশ ছিল।
বর্তমানে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বালুচিস্তান। এটি নানা সম্পদের খনি। বালুচিস্তানের মাটিতে লুকিয়ে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সাফল্যের বীজ। অথচ, এই বালুচিস্তানকেই সবচেয়ে অবহেলা করা হয় বলে অভিযোগ। এখানে পাক সরকারের কোনও উন্নয়নমূলক কাজ হয় না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই এখনও অনেক পিছিয়ে বালুচিস্তান। অভিযোগ, এই প্রদেশের মানুষকে পিছনে রেখে কেবল এখানকার সম্পদ ব্যবহার করে কার্যসিদ্ধি করে পাক সরকার।
গ্বদর বন্দরও সিপিইসির গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। এই বন্দরকে ঘিরে অনেক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক লাভের অঙ্ক কষেছে চিন। এখানে চিনের অনেক মানুষ এসে বাস করছেন। অথচ বালুচিস্তানের লোকেদেরই এই বন্দরশহরে ঢুকতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ।
বস্তুত, পাকিস্তানের অন্দরে সিপিইসি নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে চিন। ইতিমধ্যে অনেক টাকা ঢালা হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পিছনে ফিরতে হলে তাদেরও অনেক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই সহজে পাকিস্তান ছাড়তে চায় না বেজিং।
এ নিয়ে বহু দিন ধরে প্রতিবাদ চলছে। কোনও কোনও সংগঠন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালালেও পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার দাবিতে বালুচিস্তানে গড়ে উঠেছে বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)।
বিএলএ একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যার প্রধান এবং একমাত্র দাবি, পাকিস্তানের বশ্যতা ছিন্ন করে বেরিয়ে যাওয়া। বিএলএ পাকিস্তানের সেনার সঙ্গে হামেশাই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
বিএলএ-র তরফে বার বার চিনকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। চিনা আধিকারিকদের উপর একাধিক বার হামলাও চালানো হয়েছে। তবে এ বার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশি ‘হামলা’র মুখে পড়তে হল বালুচিস্তানের বহু মানুষকে।