মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (অজিত পওয়ার গোষ্ঠী)-র নেতা বাবা সিদ্দিকি হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে এসেছে গ্যাংস্টার লরেন্স বিশ্নোইয়ের নাম। খুনের দায় স্বীকার করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে কুখ্যাত এই দুষ্কৃতীর দল। পাশাপাশি, বাবা হত্যার পর থেকে লরেন্স গ্যাংয়ের তরফে একাধিক বার হুমকি দেওয়া হয়েছে অভিনেতা সলমন খানকে।
বাবা খুনের দায় স্বীকারের পরে সমাজমাধ্যমে করা একটি পোস্টে বিশ্নোই গ্যাং বলেছে, ‘‘আমাদের কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা নেই। দাউদ ইব্রাহিমের গ্যাং ও সলমন খানকে সাহায্য করলে কোনও ছাড় পাওয়া যাবে না। যাঁরা সাহায্য করছেন তাঁরা সমস্ত হিসাব করে রাখুন।’’
এর পর বৃহস্পতিবার আবারও সলমন নিয়ে হুমকিবার্তা পৌঁছয় মুম্বই পুলিশের কাছে। হুমকি দেওয়া হয় লরেন্স গ্যাংয়ের নাম করে। সেই হুমকিবার্তায় বলা হয়েছে, সলমন খান পাঁচ কোটি টাকা না দিলে তাঁর পরিণতিও হবে বাবার মতো। হুমকিবার্তা পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। হুমকিবার্তা কারা পাঠালেন, এর নেপথ্যে লরেন্স বিশ্নোই গোষ্ঠীই রয়েছে কি না, তা যেমন খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তেমনই বলিউড তারকার নিরাপত্তাও নিশ্ছিদ্র রাখতে চাইছে পুলিশ।
সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মুম্বই ট্র্যাফিক পুলিশের হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে হুমকিবার্তাটি পাঠানো হয়। সেখানে লেখা হয়, “সলমন খানের পরিণতি বাবা সিদ্দিকির চেয়েও খারাপ হবে। বিষয়টি হালকা ভাবে নেবেন না। যদি সলমন খান বেঁচে থাকতে চান আর লরেন্স বিশ্নোইয়ের সঙ্গে শত্রুতার অবসান চান, তবে তাঁকে ৫ কোটি টাকা দিতে হবে।” একই সঙ্গে হুঁশিয়ারির সুরে ওই বার্তায় লেখা হয়েছে, “যদি টাকা না দেওয়া হয়, তবে সলমন খানের অবস্থা বাবা সিদ্দিকির চেয়েও খারাপ হবে।”
কিন্তু কেন বার বার সলমনকে খুনের হুমকি দিচ্ছে বিশ্নোই গ্যাং? এর নেপথ্যে রয়েছে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা। ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের জোধপুরে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ ছবির শুটিং করতে যান সলমন খান। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ ওঠে।
এই ঘটনায় বিশ্নোই সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে আঘাত লাগে। কারণ কৃষ্ণসার হরিণকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন তাঁরা। ২০১৮ সালে গ্রেফতারির পর আদালতে দাঁড়িয়ে লরেন্স বিশ্নোই হুমকির সুরে বলেছিলেন, ‘‘জোধপুরে আমরা সলমন খানকে হত্যা করব। আমরা ব্যবস্থা নিলেই সবাই জানতে পারবে। আমি এখনও পর্যন্ত কিছুই করিনি। ওরা বিনা কারণে আমার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এনেছে।’’
এই আবহে প্রশ্ন উঠছে, বিষ্ণোই গ্যাংয়ের হুমকি থেকে পরিত্রাণের উপায় কি কিছু আছে?
গত বছর পঞ্জাবের ভাটিন্ডার জেল থেকে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্যাংস্টার লরেন্স বলেছিলেন, ‘‘সলমন খানের আমাদের (বিষ্ণোই) মন্দির পরিদর্শন করা উচিত এবং সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।’’ বাবা হত্যার পর সলমনকে একই পরামর্শ দিয়েছেন এক বিজেপি নেতাও।
বিশ্নোইরা মনে করেন যে, কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা করে গর্হিত অপরাধ করেছেন সলমন। বিশ্নোই আচারবিধিও সেই কথা বলে।
সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘অল ইন্ডিয়া বিশ্নোই সমাজ’-এর সম্পাদক হনুমানরাম বিশ্নোই জানিয়েছেন, বিশ্নোই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী যদি কোনও ব্যক্তি অপরাধ করেন, তবে তাঁর মধ্যে অবশ্যই অনুশোচনা বোধ থাকতে হবে। যা তাঁকে প্রায়শ্চিত্তের পথে নিয়ে যাবে।
হনুমানরাম আরও জানিয়েছেন, বিশ্নোই সমাজের ক্ষমা পেতে হলে এক জনকে অবশ্যই রাজস্থানের বিকানেরে অবস্থিত মুক্তিধাম মুকামে যেতে হবে। উল্লেখ্য, মুক্তিধাম মুকাম বিশ্নোই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা গুরু জম্ভেশ্বরের শেষ বিশ্রামস্থল এবং বিশ্নোইদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান।
হনুমানরাম ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, ‘‘সলমন খান প্রকৃতি থেকে দু’টি সুন্দর জীবন কেড়ে নিয়েছেন। কেউ অপরাধ করলে তাঁর মধ্যে অনুশোচনাবোধ থাকতে হয়। ক্ষমা চাওয়ার সত্যিকারের তাগিদ থাকতে হয়।’’
বিশ্নোই সমাজের নেতা হনুমানরাম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেউ যদি বিশ্নোই সম্প্রদায়ের প্রতি কোনও অন্যায় করেন তা হলে মুক্তিধাম মুকামে গিয়ে তাঁকে পুরো সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
এক বার নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষমা চাওয়া হলে, তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবে সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে।
হনুমানরামের কথায়, “কেউ পুরো সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চাইলে তখন ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হতে পারে। এই সিদ্ধান্তটি নির্ভর করে সম্পূর্ণ সম্প্রদায়ের উপর, যেখানে মোট ৭০ লাখেরও বেশি সদস্য রয়েছেন।’’
পাশাপাশি হনুমানরাম উল্লেখ করেছেন, যত ক্ষণ না সলমন ক্ষমা চাইছেন, তত ক্ষণ তিনি ‘শাস্তির প্রাপক’।
হনুমানরামের কথায় সায় দিয়ে বিশ্নোই সমাজের সভাপতি দেবেন্দ্র বিশ্নোই বলেছেন, ‘‘যদি সলমন ক্ষমা চান তা হলে আমরা তা পুরো সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করব।’’
তবে এখন যদি সলমন বিশ্নোই সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমাও চান, তা হলে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে কৃষ্ণসার শিকারের মামলায় সলমনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল নিম্ন আদালত। যদিও সলমনের দাবি, তিনি নির্দোষ। এই নিয়ে রাজস্থান হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় সলমন। মামলাটি বর্তমানে সেখানেই বিচারাধীন।
উল্লেখ্য, কৃষ্ণসার হত্যায় নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে একাধিক বার হামলার ছক কষা হয় সলমনের উপর। ২০১৮ সালে সম্পথ নেহরা নামের এক সুপারি কিলারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ব্যক্তি সলমনকে খুনের জন্য তাঁর বাড়ি রেকি করছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিশ্নোইয়ের নির্দেশেই নেহরা ওখানে গিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন তদন্তকারীরা।
২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল সলমনের বান্দ্রার বাড়ির সামনে বাইকে করে এসে গুলি চালায় দুই দুষ্কৃতী। তবে তাতে অভিনেতার কোনও ক্ষতি হয়নি। ওই ঘটনার সঙ্গেও বিশ্নোই গ্যাং জড়িত ছিল বলে সন্দেহ পুলিশের।