বেঙ্গালুরুর আত্মঘাতী ইঞ্জিনিয়ার অতুল সুভাষকে নিয়ে দেশ জুড়ে হইচই পড়েছে। নেটাগরিকদের একাংশ অতুলের জন্য ‘বিচারের’ দাবিতে সরব হয়েছেন। অনেকে আবার নিজ নিজ যুক্তিতে বিভিন্ন প্রশ্নও তুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু কেন অতুলের ঘটনা নিয়ে দেশ জুড়ে এত আলোড়ন? কেন এত হইচই?
বেঙ্গালুরুতে থাকলেও অতুল আসলে বিহারের সমস্তীপুরের বাসিন্দা। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে কাজ করতেন তিনি। চাকরি সূত্রে থাকতেন বেঙ্গালুরুতে।
বেঙ্গালুরুর যে অ্যাপার্টমেন্টে অতুল থাকতেন, সোমবার সেখান থেকেই তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সঙ্গে উদ্ধার হয় ২৪ পাতার একটি সুইসাইড নোট। ২৪ পাতার মধ্যে চারপাতা হাতে লেখা, বাকি ২০ পাতা টাইপ করা। প্রতিটি পাতায় লেখা, “বিচার এখনও বাকি!”
সেই নোট পরিচিতদের পাঠিয়ে দেন ওই ব্যক্তি। পাশাপাশি, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপেও দিয়েছিলেন। বাড়িতে কোথায় কী রয়েছে, গাড়ির চাবি কোথায়, তার একটি তালিকা তৈরি করে আলমারিতে সেঁটে রেখেছিলেন সুভাষ।
পাশাপাশি ঘণ্টা দেড়েকের একটি ভিডিয়োও রেকর্ড করেছিলেন অতুল। ওই ভিডিয়োবার্তায় তাঁকে বার বার বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘বিচার না মেলা পর্যন্ত তোমরা যেন আমার অস্থি বিসর্জন কোরো না!’’
সুইসাইড নোটে অতুলের অভিযোগ, স্ত্রী এবং স্ত্রীর পরিবারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই চরম পদক্ষেপ নিচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেই সুইসাইড নোট। চলছে চর্চা।
অতুলের পরিবারও বৌমা এবং ছেলের শ্বশুরবাড়ির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। পুলিশ অতুলের স্ত্রী এবং তাঁর পরিজনদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে। তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার ধারায় মামলাও রুজু করেছে পুলিশ।
অতুলের পরিবার এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালে নিকিতা সিংহানিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় অতুলের। নিকিতাও একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার চাকুরিজীবী। তাঁদের এক সন্তানও রয়েছে।
সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদের মামলা হয়। সেই মামলা চালকালীন মাসিক ৪০ হাজার টাকা খোরপোশ দিতে হত অতুলকে। দীর্ঘ দিন দু’জনে আলাদা থাকতেন।
এর পরেও অতুলের স্ত্রী ও তাঁর পরিবার আরও ২-৪ লাখ টাকা দাবি করছিল বলে অভিযোগ। অতুলের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের আদালতে মামলা করেছিলেন নিকিতা। হত্যা, অস্বাভাবিক যৌনতা, টাকার জন্য হয়রানি, গার্হস্থ্য হিংসা এবং পণের দাবিতে চাপ সৃষ্টি-সহ একাধিক অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি।
অভিযোগ, অতুলের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছিল। অতুলের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা’র নিষ্পত্তির জন্য তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের লোকেরা তিন কোটি টাকাও নাকি দাবি করেছিলেন। পুলিশের এক বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা এএনআই এ কথা জানিয়েছে।
ওই মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য প্রায়ই বেঙ্গালুরু থেকে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের পারিবারিক আদালতে ছুটতে হত অতুলকে। অন্তত ৪০ বার তাঁকে এমন যাতায়াত করতে হয়েছে বলে দাবি অতুলের পরিবারের।
এমনকি, আদালতের বিচার প্রক্রিয়াও সঠিক ভাবে এগোয়নি বলে অতুলের পরিবারের দাবি। সেই মামলায় সম্প্রতি সুভাষের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল আদালত। তিনি ভেঙে পড়েছিলেন বলে খবর। এর পরে তিন দিন আগে বেঙ্গালুরুর ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়।
এর পরেই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অতুলের স্ত্রী নিকিতা, শাশুড়ি নিশা সিংহানিয়া, শ্যালক অনুরাগ সিংহানিয়া-সহ পাঁচ জনর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে অতুলের পরিবার।
অতুলের ভাইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মামলা রুজু করে। অতুলের স্ত্রী নিকিতা এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার একাধিক ধারায় মামলা হয়েছে। রয়েছে ১০৮ নম্বর ধারাটিও, যা আত্মহত্যায় প্ররোচনার ধারা এবং জামিন-অযোগ্য। নিকিতা এবং তাঁর পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে উত্তরপ্রদেশে যায় বেঙ্গালুরু পুলিশের একটি দল।
এই আবহে পারিবারিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মৃতের ভাই প্রশ্ন তুলেছেন, আইন কি শুধু মহিলাদের জন্য? পুরুষদের জন্য নয়? সমাজমাধ্যমেও চর্চা শুরু হয়েছে। পারিবারিক আদালত নিয়ে মুখ খুলেছে কেন্দ্রও। মঙ্গলবার রাতে আইন ও বিচার মন্ত্রকের তরফে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করা হয়েছে পারিবারিক আদালতের বিষয়ে।
কেন্দ্র জানিয়েছে, বিবাহ, সম্পত্তির উত্তারাধিকার, সন্তান কার সঙ্গে থাকবে— এ সব মামলাগুলি দেখে পারিবারিক আদালত। যথেষ্ট যত্ন নিয়ে, সংবেদনশীলতার সঙ্গে এবং প্রয়োজনে প্রথাগত রীতির বাইরে গিয়েও মামলাগুলি বিবেচনা করে পারিবারিক আদালত। সময়ের মধ্যে পক্ষপাতহীন সমাধান খুঁজে বার করে পারিবারিক আদালত। শুধু তা-ই নয়, সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টাও করা হয়।
প্রশ্ন উঠছে পারিবারিক আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা-সহ একের পর এক অভিযোগ ওঠে অতুলের বিরুদ্ধেও। সম্প্রতি দাম্পত্য কলহের সেই মামলায় রায়ও গিয়েছে তাঁর বিপক্ষে। সেই চাপেই কি আত্মঘাতী হলেন তিনি? আর তার জন্যই কী এত অভিযোগ?
নিকিতার পরিবারের দাবি, এই বিষয়ে যা কথা বলার তাঁদের আইনজীবীই বলবেন। তাঁর এক কাকা সুশীল সিংহানিয়ার দাবি, অতুলের সুইসাইড নোটে তাঁদের পরিবারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তা ভিত্তিহীন এবং নিকিতার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে।
আত্মহত্যার আগে ২৪ পাতার সুইসাইড নোটের মধ্যে চার বছরের পুত্রের জন্য একটি চিঠিও লিখে যান অতুল। তাঁর সন্তান থাকে স্ত্রী নিকিতার সঙ্গে। সেই চিঠিতে অতুল লিখেছেন, কেন তিনি নিজেকে শেষ করলেন, তা এক দিন তাঁর সন্তান ঠিক বুঝতে পারবে।
সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই চিঠিতে লেখা, ‘‘তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন ভেবেছিলাম তোমার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারব। কিন্তু দুঃখের বিষয় তোমার জন্যই আমি আমার জীবন দিয়ে যাচ্ছি। তোমার এক বছর বয়সের ছবি না দেখলে আমি তোমার মুখ মনে করতে পারি না।... তুমি আমার কাছে সেই হুমকি, যা দিয়ে আমার কাছ থেকে আরও আরও টাকা নেওয়া যায়। তোমার কষ্ট হলেও তোমার জানা উচিত যে আমার মনে হয়, তুমি আমার জীবনের ভুল।’’
সুইসাইড নোটে মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অতুল। যদিও নেটাগরিকদের একাংশের দাবি, মনে অনেক কষ্ট চাপা নিয়ে এমনটা লিখে গিয়েছেন তিনি।