আফগানিস্তানের তালিবানে বড় ভাঙন? মতাদর্শগত পার্থক্যের জেরে দু’টুকরো হতে চলেছে দল? তালিবানের প্রতিষ্ঠাতার পুত্রের সঙ্গে আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবাদের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এ ব্যাপারে পিছনে থেকে কলকাঠি নাড়াতে পারে পাকিস্তান। হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে দিল্লির জন্য সেটা যে মোটেই শুভ হবে না, তা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন তাঁরা।
হিবাতুল্লাহ আখুন্দজ়াদা বনাম সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। বর্তমানে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকা সশস্ত্র সংগঠনটির মাথায় রয়েছেন আখুন্দজ়াদা। তাঁর নির্দেশ ছাড়া তালিবানে একটি পাতা পর্যন্ত নড়ে না। দ্বিতীয় জনের পরিচয় আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে। পাশাপাশি হাক্কানি নেটওয়ার্ক নামের একটি পৃথক সংগঠন চালান তিনি।
আফগান সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দু’জনের মধ্যে রয়েছে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ফলে তালিবানের মধ্যেই দু’টি গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গিয়েছে। আখুন্দজ়াদা এবং তাঁর অনুগামীরা সিরাজুদ্দিনকে দেশ ছাড়া করতে পারলে বাঁচেন। অন্য দিকে তালিবানের শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েক জনকে নিজের দিকে টেনে এনে পাল্টা ঘোঁট পাকানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান।
সূত্রের খবর, গত কয়েক মাসে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, দল আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে যাওয়ার জোগাড়! এই পরিস্থিতিতে সব কিছু মিটমাট করতে চলতি বছরের মার্চে কন্দহরে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে বৈঠক করেন আখুন্দজ়াদা। সেখানে প্রকাশ্যেই তালিবানের এই শীর্ষ নেতার কট্টরপন্থী মৌলবাদী নীতির সমালোচনা করেন আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আফগান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কন্দহরের বৈঠকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিলেন তালিবানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহম্মদ ইয়াকুব মুজ়াহিদ এবং গোয়েন্দাপ্রধান আব্দুল হক ওয়াসিক। সেখানে কোনও সমাধানসূত্র বার হয়েছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনার জন্য বৈঠকটি ডাকা হয়েছিল বলে জানিয়েছে আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী।
সূত্রের খবর, কন্দহরের বৈঠকে শুরু থেকে তাঁর ‘ডানা ছাঁটা’ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন সিরাজুদ্দিন। পাশাপাশি আখুন্দজ়াদাকে নাকি হুমকিও দিয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তালিবানের ‘টপ বস্’কে কট্টরপন্থী মৌলবাদী মতাদর্শ থেকে অবিলম্বে সরে আসতে বলেন হাক্কানি। নইলে শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ অচিরেই দলত্যাগ করবেন বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি।
হাক্কানির এই রাগ একেবারে অমূলক নয়। কিছু দিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরব সফরে যান তিনি। সূত্রের খবর, তাঁর এই অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পদ কেড়ে নেন আখুন্দজ়াদা। আফগানিস্তান তো বটেই, একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় সেই খবর।
পরে অবশ্য সিরাজুদ্দিন দেশে ফিরলে এ ব্যাপারে ঢোক গেলে তালিবান। বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে মোটেই হাক্কানিকে সরানো হয়নি। কিন্তু এই ঘটনাকে ভাল চোখে দেখেননি সিরাজুদ্দিন। আখুন্দজ়াদা এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে ওঠে তাঁর। কন্দহরের বৈঠকে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সূত্রের খবর, তালিবান প্রধানের মুখোমুখি হয়ে আরও একটি বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা। তাঁর অভিযোগ, সুনির্দিষ্ট কিছু সহযোদ্ধার মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখেছেন আখুন্দজ়াদা। এতে দলের মধ্যেই অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। অবিলম্বে সেটা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন সিরাজুদ্দিন।
বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে হাক্কানি গোষ্ঠীর ভিত তালিবানের অন্দরে আরও পোক্ত করতে চাইছেন আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর তাই কন্দহরের বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘আখুন্দজ়াদার নীতির ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাবুল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এ দেশের দেশবাসীর মধ্যে কমছে তালিবানের জনসমর্থন।’’ এ ভাবে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় টিঁকে থাকা কঠিন হবে বলে সতর্ক করে দেন তিনি, খবর সূত্রের।
সিরাজুদ্দিনের অনুপস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব সদর ইব্রাহিম নামের এক ঘনিষ্ঠ নেতার হাতে তুলে দেন আখুন্দজ়াদা। কন্দহরের বৈঠকে অবশ্য তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তালিবানের শীর্ষনেতার যুক্তি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কাজকর্ম নেতার অভাবে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকতে পারে না। তাই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ইব্রাহিমকে অতিরিক্ত কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। ওই সময়ে সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে হাক্কানি গোষ্ঠীদের নেতাদের সঙ্গে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের উপর চাপ সৃষ্টি করে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স’ বা আইএসআই। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই সিরাজুদ্দিন হাক্কানিকে মন্ত্রিসভায় জায়গা ছেড়ে দেন আখুন্দজ়াদারা।
তালিবানের কাছে হাক্কানিকে নিয়ে চলাটা ছিল প্রথম থেকেই সাপের ছুঁচো গেলার মতো। সিরাজুদ্দিনকে কখনওই বিশ্বাস করেননি তাঁরা। তা ছাড়া মতাদর্শগত দিক থেকে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সিরাজুদ্দিন একটা সময়ে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন। তাঁর কট্টর ভারত-বিরোধী মনোভাবের সঙ্গেও সহমত নন তালিবান নেতৃত্ব।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেশ কয়েক বার তাঁদের উপর আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএস-কে) নামের জঙ্গি গোষ্ঠী। আখুন্দজ়াদা এবং তাঁর অনুরাগীরা মনে করেন, ওই ঘটনার নেপথ্যে হাত রয়েছে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তাঁর প্রছন্ন মদত না থাকলে আইএস-কের পক্ষে হিন্দুকুশের কোলে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা একেবারেই সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, বর্তমানে তালিবানের মধ্যে ভাঙন ধরানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। সৌদি আরবে থাকাকালীন গোপনে সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। ওই হাক্কানি গোষ্ঠীকে শিখণ্ডি খাড়া করে কাবুলে ক্ষমতার হাতবদলের পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের।
সিআইএর এ-হেন পদক্ষেপের নেপথ্যে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সম্প্রতি তালিবানকে জঙ্গি সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে রাশিয়া। ফলে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে মজবুত হচ্ছে মস্কোর। দ্বিতীয়ত, চিনের সঙ্গে অহরহ যোগাযোগ রাখছেন তালিবানের নেতা-মন্ত্রীরা। এতে আমু দরিয়ার তীরে অবস্থান মজবুত হচ্ছে বেজিঙের।
তৃতীয়ত, দু’দশক থাকার পর আফগানিস্তান ত্যাগের সময়ে বিপুল পরিমাণ হাতিয়ার সেখানে ফেলে আসে মার্কিন ফৌজ। ক্ষমতায় এসে সেগুলি হস্তগত করেন তালিবান নেতৃত্ব। সম্প্রতি ওই সমস্ত অস্ত্র ফেরত চেয়ে হুঙ্কার দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তাতে একেবারেই আমল দেয়নি কাবুল। এতে বেজায় চটেছে ওয়াশিংটন।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আফগানিস্তানে বসে আখুন্দজ়াদার মুখের উপর কথা বলা বা তাঁর সামনে চোটপাট করার ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু কন্দহরের বৈঠকে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি সেটাই করেছেন বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, বৈঠকের পর আর নিজের দফতরে ফিরে যাননি তিনি, যা এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তালিবানের মধ্যে যে ভাঙন ধরেছে তা অন্য একটি ঘটনাতেও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। গত প্রায় তিন মাস ধরে দেশেই নেই তাঁদের উপ-বিদেশমন্ত্রী শের মহম্মদ আব্বাস স্ট্যানিকজ়াই। সূত্রের খবর, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে আখুন্দজ়াদার দূত হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে যান কন্দহরের গভর্নর মোল্লা শিরিন হাক্কানি। কিন্তু খালি হাতে ফিরতে হয় তাঁকে। এ ক্ষেত্রেও মতাদর্শগত বিরোধ অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে বলে জানা গিয়েছে।
আফগানিস্তানে দ্বিতীয় দফায় তালিবান শাসন শুরু হওয়া ইস্তক কাবুল এবং ইসলামাবাদের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের অভিযোগ, জঙ্গি গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) ক্রমাগত মদত দিয়ে চলেছে আখুন্দজ়াদার সরকার। আর তাই কাবুলের কুর্সি বদলের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছে পাকিস্তান।