আমেরিকার সমাজে বর্ণবিদ্বেষের ক্ষত দীর্ঘ দিনের। বহুকাল ধরেই উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়েছে বর্ণভিত্তিক বিদ্বেষের বিষ। কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণা ছিল নিতান্তই সহজাত।
আমেরিকার এই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচার, প্রতিবাদ, মিটিং, মিছিল কম হয়নি। পথে নেমেছেন বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শ্বেতাঙ্গ নাগরিক। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ আজও রয়ে গিয়েছে।
আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৫৮ সাল। উত্তর ক্যারোলিনা প্রদেশ সে বছর সাক্ষী থেকেছিল মহাদেশের অন্যতম নিষ্ঠুর এবং ঘৃণ্য বিদ্বেষের। কৃষ্ণাঙ্গের বিচারের বাণী যেন নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছিল।
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের শেষ লগ্ন। মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছিল ছোট্ট সিসি মার্কাস। বয়স ৭ কিংবা ৮ বছর। গল্পের ছলে শিশুটি তার মাকে জানায় তার আরও দুই বন্ধুর কথা।
সিসির সেই বন্ধুদের নাম জেমস থম্পসন এবং ডেভিড সিম্পসন। বয়স যথাক্রমে ৯ এবং ৭ বছর। মাকে সিসি জানায়, খেলার ছলেই এই বন্ধুদের গালে সে চুম্বন করেছে।
জেমস এবং ডেভিড, দু’জনেই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। তাদের চামড়ার রং কালো। কৃষ্ণাঙ্গ বালকদের গালে চুমু খাওয়ার কথা শুনে ‘শ্বেতাঙ্গ’ সিসির মা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন।
চুম্বনের কথা শোনামাত্র সিসির মা সাবান দিয়ে ভাল করে ঘষে ঘষে মেয়ের মুখ ধুইয়ে দেন। তার পর কৃষ্ণাঙ্গ দুই বালকের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন। সিসির বাবা এবং অন্য আত্মীয়েরা পিস্তল হাতে নিয়ে জেমস, ডেভিডকে খুঁজতে বেরোন।
সিসির মা বের্নিস মার্কাসের অভিযোগ পেয়ে তৎপর হয়ে ওঠে আমেরিকার পুলিশ। তারা অন্যায় ভাবে বালক দু’টিকে গ্রেফতার করে। বাবা, মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তাদের।
থানায় জেমস এবং ডেভিডের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় আমেরিকার পুলিশ। মারধর করে তাদের মুখ থেকে ধর্ষণের স্বীকারোক্তি আদায় করাই ছিল উদ্দেশ্য। শারীরিক অত্যাচারের পাশাপাশি চলে মানসিক নির্যাতন।
টানা ৬ দিন হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ হেফাজতে রেখে দেওয়া হয় দুই বালককে। বাবা, মা বা কোনও পরিচিতের মুখ তাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি আইন অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ।
উত্তর ক্যারোলিনার বিচারব্যবস্থায় কিছু দিনের মধ্যেই শ্লীলতাহানির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় জেমস, ডেভিড। অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের সংশোধনাগারে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারক জানান, হয়তো ২১ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে পর্যন্ত দু’জনকে সংশোধনাগারে থাকতে হবে।
উত্তর ক্যারোলিনার ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালারড পিপল (এনএএসিপি) নামের সংগঠনের তরফে কৃষ্ণাঙ্গ বালকদের প্রতি এই অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়। তারা চাঁদা তুলে জেমস এবং ডেভিডের সমর্থনে আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টা করে।
জেমস এবং ডেভিডের গ্রেফতারির পর তাদের পরিবারের উপরেও নেমে আসে সামাজিক শোষণ। তাদের বাবা, মা চাকরি হারান। এমনকি, প্রাণসংশয়ও তৈরি হয়। এনএএসিপি-র তরফে তাদের দেশের বাইরে নিরাপদে থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়।
কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষার্থে সক্রিয় কনরাড লিনকে এই মামলায় নাবালকদের পক্ষে আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ করা হয়। দেশের নানা প্রান্তে জেমস এবং ডেভিডের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। আমেরিকার প্রাক্তন ‘ফার্স্ট লেডি’ তাদের মুক্তির আবেদন জানাতে উত্তর ক্যারোলিনার প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেন।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও আমেরিকার এই কৃষ্ণাঙ্গ নিপীড়নের কথা ছড়িয়ে পড়ে। দেশ, বিদেশের নামী সংবাদমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা প্রকাশিত হয়। লন্ডনের এক সাংবাদিক পুলিশি হেফাজতে থাকা দুই বালকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছেলেদের কাছে গিয়েছিলেন জেমস এবং ডেভিডের মা। সেই সময় বন্দি বালকদের ছবি প্রকাশ্যে আসে। যাতে পুলিশি অত্যাচারের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
জেমস, ডেভিডের মুক্তি চেয়ে আমেরিকার প্রশাসনের কাছে সে সময় অন্তত ১২ হাজার চিঠি জমা পড়েছিল। দেশ এবং বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার নাক কাটা গিয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে অবশেষে পিছু হটে আমেরিকার প্রশাসন। তিন মাস জেলে থাকার পর মুক্তি পায় জেমস, ডেভিড। তাদের ‘ক্ষমা প্রদর্শন’ করলেও মুক্তির পর প্রশাসনের তরফে কোনও ব্যাখ্যা বা দুঃখপ্রকাশ করা হয়নি।
জেমস, ডেভিডের গ্রেফতারির পর তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের সংগঠন ‘ক্লু ক্লুক্স ক্ল্যান’ বা ‘কেকেকে’। তারা দেশের নানা প্রান্তে শ্বেতাঙ্গদের জড়ো করে দুই নাবালকের বিরুদ্ধে সকলকে সংগঠিত করার কাজ করছিলেন। বিচারব্যবস্থার উপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব ছিল।
জেমস, ডেভিডের গ্রেফতারি এবং তিন মাসের কারাবাস আমেরিকার ইতিহাসে ‘কালো অধ্যায়’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুক্তি পেলেও এই চূড়ান্ত হেনস্থা এবং নির্যাতনের গভীর এবং চিরস্থায়ী প্রভাব পড়েছিল দুই বালকের মনে। ছোটবেলার এই দুঃস্বপ্নের মতো অধ্যায় তারা কখনও ভুলতে পারেনি।