সুতপা চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক সুশান্ত চৌধুরীকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত। বৃহস্পতিবার ওই মামলার সাজা ঘোষণা হল।
এর আগে বহরমপুরের কলেজছাত্রী খুনে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সুশান্তের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী। চাওয়া হয়েছে ফাঁসি। অন্য দিকে, সুশান্তের আইনজীবীর দাবি, আবেগের বশে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাঁর মক্কেল। তাঁর বয়স কম। তাই তাঁকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হোক।
সুতপা হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৫ মাস পরে এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া সুশান্তের সাজা ঘোষণা হল। ২০২২ সালের ২ মে প্রকাশ্যে রাস্তার উপরে খুন করা হয় সুতপাকে।
২০২২ সালের ২ মে বহরমপুরের শহিদ সূর্য সেন রোড দিয়ে মেসে ফিরছিলেন সুতপা। সিসি ক্যামেরাতে দেখা যায়, তাঁকে অনুসরণ করছেন এক যুবক। পরে ওই যুবকের পরিচয় প্রকাশ্যে আসে। তিনি সুতপারই প্রাক্তন প্রেমিক সুশান্ত।
মেসের দরজার সামনেই সুতপার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপান কলেজছাত্রীকে। এমন নৃশংস ঘটনায় রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়।
খুনের ঘটনার পরের দিন, অর্থাৎ ৩ মে সমশেরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হন সুশান্ত। জানা যায়, সুতপার পূর্ব পরিচিত তিনি। সম্পর্কের জটিলতা থেকে খুন করেন প্রেমিকাকে।
ওই ঘটনার ৭৫ দিনের মাথায় বহরমপুর আদালতে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। অভিযুক্ত সুশান্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন)-সহ একাধিক আইনের ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালতে জমা পড়ে ৩৮৩ পাতার চার্জশিট। তাতে ৫৪ জন সাক্ষীর বয়ান ছিল।
সুতপা এবং সুশান্তের বাড়ি মালদহের ইংরেজবাজারে। সুশান্ত দাবি করেন, স্কুলজীবন থেকেই সুতপার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এক সময় তা প্রেমের সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। সুতপার বাড়িতেও নিয়মিত যাতায়াতও ছিল তাঁর।
সুশান্ত এ-ও দাবি করেন যে, তাঁদের সম্পর্কের কথা সুতপার বাড়ির লোকজনও জানতেন। যদিও এ দাবি অস্বীকার করেন সুতপার বাবা স্বাধীন চৌধুরী। স্বাধীনের দাবি, গত বছর পঞ্চমীর রাতে তাঁদের বাড়িতে বহিরাগত যুবকদের নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন সুশান্ত।
২০২২ সালের মে মাসে পুলিশকে স্বাধীন জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে এক বার পুলিশের কাছে গিয়ে সুশান্তের বিরুদ্ধে সুতপাকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ জানিয়ে এসেছিলেন তিনি। যদিও সেই অভিযোগ এফআইআর আকারে দায়ের করা হয়নি।
এই তথ্য তিনি এত দিন কেন তদন্তকারীদের দেননি, তা জানতে চাওয়ায় স্বাধীনের জবাব ছিল, ‘‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম এই ঘটনার কথা। এখন মনে পড়ায় পুলিশকে তা জানিয়েছি।’’
পুলিশের কাছে স্বাধীন দাবি করেন যে, সুতপা বহু বার মোবাইলের নম্বর বদলেছিল সুশান্তের কাছ থেকে রেহাই পেতে। নম্বরও ব্লক করে দিয়েছিল। তার পরেও কোনও না কোনও ভাবে সুতপার নম্বর পেয়ে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন সুশান্ত।
ঘটনাচক্রে, সেই সময় সুশান্তের পরিবারও সুতপার বিরুদ্ধে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগ তোলে। খুনের কারণ হিসাবে পুলিশকে সুশান্ত বলেছিলেন, সুতপার ‘অন্য কারও’ সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ গড়ে ওঠা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।
পুলিশি তদন্তে জানা যায়, ভয় দেখানোর জন্য একটি ই-কমার্স সংস্থার কাছ থেকে খেলনা বন্দুক কিনেছিলেন সুশান্ত। গত ৩ জানুয়ারি সুতপা হত্যা মামলার শুনানিতে ওই সংস্থাটির নোডাল অফিসার রবি কুমারকে বহরমপুর আদালতে তলব করা হয়।
সুতপাকে খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, খুনের সময় সুশান্ত সেই বন্দুক দেখিয়ে স্থানীয়দের ভয় দেখান। সুশান্তকে গ্রেফতারের পর ওই খেলনা বন্দুকটি বাজেয়াপ্ত করেছিল পুলিশ।
পুলিশি তদন্তে উঠে আসে সুতপার উপর রাগ ও হতাশা থেকে এই খুন করেন অভিযুক্ত। পাশাপাশি পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে বার বার মিথ্যা বয়ান দেওয়ার চেষ্টা করেন বলেও সুশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
তদন্তকারীদের তরফে জানানো হয়, সুশান্তর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল সুতপা চৌধুরীর। সুতপা সেই সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসায় এই কাণ্ড ঘটান অভিযুক্ত।
অভিযুক্ত সুশান্তকে খুনের পর নিজের চোখে পালাতে দেখেন দুই সাক্ষী। জানা যায়, খুনের পর পাঁচিল টপকে পালিয়েছিলেন তিনি। এর পর মেসে যান। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।
তদন্তে উঠে আসে, খুন করার লক্ষ্যে ২০২২ সালের ২ মে সন্ধ্যা ৬টায় মেস থেকে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্ত। তিনি মেসে ফিরে আসেন সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ। তার পর পালানোর চেষ্টা করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সুতপার দেহে ছিল ৪২টি আঘাতের চিহ্ন। আঘাত গুরুতর ছিল বলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। প্রত্যক্ষদর্শীরা সুতপাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখান বলেও সুশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
সুতপা চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সুশান্ত চৌধুরীকে ফাঁসির সাজা শোনাল আদালত। বৃহস্পতিবার বহরমপুরের তৃতীয় দ্রুত নিষ্পত্তি (ফাস্ট ট্র্যাক) আদালতের অতিরিক্ত ও জেলা দায়রা বিচারক সন্তোষকুমার পাঠক সুশান্ত চৌধুরীকে ফাঁসির সাজা শোনান। সুশান্তের আইনজীবী পীযূষ ঘোষ বলেন, “আমার মক্কেল একজন মেধাবী ছাত্র। তার বৃহত্তর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অন্ততপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রার্থনা করেছিলাম। মহামান্য আদালত তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছে। রায়ের কপি পাওয়ার পর মক্কেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”