২০২২ সালে কাতারে নিজের দেশ আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। নিজের বহু বছরের স্বপ্নপূরণ করেছিলেন। ২০২৩ সালে আরও এক জনের স্বপ্নপূরণ করেছিলেন মেসি।
আর্জেন্টিনায় একটি রেডিয়ো চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মেসি। অ্যান্ডি কুশনেৎজ়ফের অনুষ্ঠান ‘পেরোস দে লা কাল’-এ। সেই সঙ্গে আরও এক জনের স্বপ্নপূরণ করেছিলেন, যিনি আর এই দুনিয়ায় নেই।
আর্জেন্টিনায় নিজের বাড়িতে বসে একটা ফোনকলের অপেক্ষা করছিলেন জুলিয়ানা ইয়াতোর্নো। কার ফোন আসতে চলেছে, কী হতে চলেছে, কোনও ধারণা ছিল না জুলিয়ানার। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি জানতে পারেন, নিজেকে আর আটকাতে পারেননি। কেঁদে ফেলেন। এটাই তো চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী টমাস।
জুলিয়ানার স্বামী টমাস ছিলেন মেসির অন্ধ ভক্ত। ২০১৮ সালে ভাই এবং তুতো ভাইদের সঙ্গে রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর।
রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপের আগে নিজের দল আর্জেন্টিনা এবং মেসির জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন টমাস। সে জন্য মেসির ছবি দিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন একটি কার্ড।
কার্ডে মেসিকে যিশুর রূপে দেখিয়েছিলেন টমাস। সাফল্য চেয়ে লিখেছিলেন প্রার্থনার বার্তা। চেয়েছিলেন, বিশ্বকাপে ফুটবল মেসি-ভক্তদের হাতে তুলে দেবেন সেই কার্ড। তখন জুলিয়ানার সঙ্গে বিয়ে হয়নি টমাসের। প্রেমিকাকে বলেছিলেন, ‘‘এমন কেউ কি থাকবেন, যিনি এই কার্ড নিতে চাইবেন না!’’
কিন্তু টমাসের সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। আট থেকে ১০ হাজার কার্ড ছাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একটাও কাজে আসেনি।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে রাউন্ড ১৬ থেকেই বাদ হয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ভেঙে পড়েন টমাস। সেই কার্ড আর বিলি করা হয়নি তাঁর। তবে মেসির জন্য তাঁর ভালবাসা এতটুকু টোল খায়নি।
এর পর জুলিয়ানার সঙ্গে বিয়ে হয় টমাসের। দু’জনে সন্তানের জন্ম দেবেন বলে স্থির করেন। ২০২০ সালে জুলিয়ানা সন্তানসম্ভবা হন।
খবরটি শোনার পর আর বেশি দিন বাঁচেননি টমাস। একটি পথ দুর্ঘটনা তাঁর প্রাণ কেড়েছিল।
জুলিয়ানা জানান, তাঁদের একটি বাইক ছিল। সেই বাইকে চেপে বন্ধুর সঙ্গে ফুটবল খেলতে যাচ্ছিলেন টমাস। পথে দুর্ঘটনা। সেই বন্ধু ফোন করে জুলিয়ানাকে খবরটা দেন।
শুনে ভেঙে পড়েন জুলিয়ানা। এক মুহূর্তে তাঁর সব কিছু হারিয়ে যান। শুধু আসন্ন সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে সামলেছিলেন জুলিয়ানা। তখনই স্থির করেছিলেন, স্বামীর স্বপ্নপূরণ করবেন।
২০২১ সালে কোপা আমেরিকার সময় জুলিয়ানা সন্তানসম্ভবা। এক বারও খেলা দেখেননি। স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। জাতীয় দলের খেলা দেখলেই টমাসকে আরও বেশি করে মনে পড়ে যেত জুলিয়ানার। তাঁর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াত। সে কারণে আর দেখতেন না ফুটবল ম্যাচ।
২০২১ সালের ১০ জুলাই কোপা আমেরিকা কাপ হাতে তুলে নেন মেসি। পরের দিনই ছেলে অরেলিয়ানোর জন্ম দেন জুলিয়ানা।
২০২২ সালে কাতারে আয়োজিত হয় ফুটবল বিশ্বকাপ। জুলিয়ানার এক বন্ধু দেখতে যাচ্ছিলেন সেই বিশ্বকাপ। যাওয়ার আগে তাঁর হাতে টমাসের তৈরি সেই কার্ড তুলে দিয়েছিলেন জুলিয়ানা। বলেছিলেন, এই কার্ড অবশ্যই সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
এর পরে দলের যে দিন খেলা ছিল, তার মাঝেই বিভিন্ন বন্ধুদের সেই কার্ডের ছবি তুলে মেসেজ পাঠাতে শুরু করেছিলেন জুলিয়ানা। সেই মেসেজ পাঠানোর পরের মুহূর্তেই গোল করে আর্জেন্টিনা।
এ ভাবে আর্জেন্টিনার প্রতি ম্যাচে সেই কার্ডের ছবি মেসেজ করে পাঠাতে থাকেন জুলিয়ানা। ২০২২ সালে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জয় করে তাঁর দলই। জুলিয়ানা এবং অসংখ্য ফুটবল ভক্তের ধারণা, টমাসের সেই কার্ড ‘পয়মন্ত’।
সেই জয়ের এক মাস পরে রেডিয়োর অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসেন মেসি। সব শুনে তিনি নিজেই ফোন করেন জুলিয়ানাকে। ফোনটা পেয়ে প্রথমে বুঝতেই পারেননি তিনি। যখন বুঝতে পারেন, কেঁদে ফেলেন।
মেসির হাতে তখন টমাসের তৈরি সেই কার্ড। তিনি বলেন, ‘‘আমার হাতে সেই কার্ড। কিন্তু আমি দুঃখিত। তবে আমি নিশ্চিত, কোথাও থেকে টমাস আমাকে অবশ্যই কাপ নিতে দেখেছে।’’ একেই বলে স্বপ্নপূরণ!