রাজ্যের আরও একটি বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের জেরে বেশ কয়েক জন মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিল। রবিবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দত্তপুকুরের মোচপোল এলাকার একটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে।
বিস্ফোরণের অভিঘাতে বাজি কারখানাটি তো বটেই আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মৃতের সংখ্যা নিয়ে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু জানা না গেলেও ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বেশ কিছু দেহাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আশপাশে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মোচপোলের বাসিন্দা সামসুল আলি ওই বেআইনি বাজির কারবার চালাতেন। শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই পুলিশ-প্রশাসন বেআইনি বাজি কারখানা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল মোট এগারো জনের। এই ঘটনাকে ঘিরে সেই সময় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি।
এগরার ঘটনার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ। সেখানেও এই বিস্ফোরণের নেপথ্যে ছিল বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণ। মৃত্যু হয়েছিল এক বালিকা-সহ তিন জনের।
অবশ্য তালিকায় রয়েছে আরও অজস্র এমন ঘটনা। ২০২২ সালের শেষ দিকে কাঁথির ভগবানপুর-২ ব্লকের ভূপতিনগর থানার অর্জুননগর গ্রাম পঞ্চায়েতের নাড়য়াবিলা গ্রামেও বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয় এক তৃণমূল নেতা-সহ তিন জনের।
তার আগে ওই বছরেই পূর্ব মেদিনীপুরেরই পশ্চিম ভাঙনমারি গ্রামে এক তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়। তার জেরে মৃত্যু হয় এক তৃণমূল কর্মীর। জখম হন অনেকে।
গত ১৬ মে এগরার খাদিকুল গ্রাম হঠাৎই তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে। ওই ঘটনায় মোট এগারো জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পরে পলাতক ছিলেন বেআইনি বাজি কারখানাটির মালিক কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগ। পরে তাঁরও মৃত্যু হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজি তৈরি করতেন ভানু। তাঁর তৈরি বাজির চাহিদাও নাকি ছিল বিপুল। ভানুর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে। ক্রমেই ভানু হয়ে ওঠেন এলাকার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীদের অন্যতম!
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেন, ভানু ‘তৃণমূলের বড় নেতা’। বিরোধী দলগুলির তরফে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)কে দিয়ে তদন্তের দাবি তোলা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, অগ্নিদগ্ধ অবস্থাতেই ওড়িশায় পালিয়ে গিয়েছিলেন ভানু। গত ১৮ মে রাত ২টো নাগাদ কটকের রুদ্র হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
এগরা বিস্ফোরণ মামলায় ভানু, তাঁর পুত্র ও ভাইপো— তিন জনকে মূল অভিযুক্ত হিসাবে রেখে মামলা দায়ের হয়। ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। গত ২৪ মে সিআইডির হাতে গ্রেফতার হন প্রয়াত ভানু বাগের স্ত্রী গীতা বাগ।
অন্য দিকে, গত ২১ মে বজবজের চিংড়িপোতা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় তিন জনের। পর পর রাজ্যের দুই জায়গায় বিস্ফোরণের ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতর শুরু হয়ে যায়।
গত ২৭ মে খাদিকুল গ্রামে গিয়ে এগরাকাণ্ডের জন্য ‘মাথা নত করে ক্ষমা’ চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে একগুচ্ছ পদক্ষেপের কথা বলেন তিনি।
ওই দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “অবৈধ বাজি কারখানায় কাজ করে জীবন নষ্ট যেন না হয়। শুধুমাত্র গ্রিন ফায়ার ক্র্যাকারের ক্লাস্টার তৈরি হবে ফাঁকা জায়গায়। তাতে চাকরিটা বাঁচবে। এমন দুর্ঘটনাও হবে না।’’
অবৈধ বাজি কারখানা বন্ধ করতে পুলিশকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, যিনি রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও বটে। তিনি অভিযোগ করেন, ভিন্রাজ্য থেকে অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে বাংলায়। ওড়িশার মতো পড়শি রাজ্যে শব্দবাজি যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বর্ডারগুলো সিল করুন। যে ছেলেমেয়েরা হোমগার্ডে চাকরি পেয়েছেন, এঁদের ওই বর্ডারে নিযুক্ত করুন।”
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বেআইনি বাজি রুখতে রাজ্য জুড়ে তল্লাশি অভিযানে নামে পুলিশ। সেই সময় দত্তপুকুরেও পুলিশি অভিযানে অন্তত ২০০ কুইন্টাল বাজি মেলে।
দত্তপুকুর থানার নীলগঞ্জ ফাঁড়ির নীলগঞ্জ ইছাপুর পঞ্চায়েত এলাকায় সে সময় পুলিশের তল্লাশি অভিযান চলে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গোপন সূত্র মারফত খবর মেলে, কাঠুরিয়া এলাকায় ইবাদত মণ্ডল নামে এক জনের বাড়িতে প্রচুর বাজি মজুত রয়েছে। সেখান থেকেই উদ্ধার হয় বেআইনি বাজি।
গত ২৩ মে মালদহের ইংরেজবাজারেও একটি বাজির গুদামে আগুন লেগে মৃত্যু হয় দু’জনের। ওই দিনই বেআইনি আতশবাজি রুখতে প্রশাসনিক আধিকারিক এবং কয়েকটি বাজি ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী।
গত ২১ মে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে আতশবাজি নিয়ে ক্লাস্টার গড়তে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্থির হয় ওই কমিটি আগামী ২ মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে একটি রিপোর্ট দেবে। তার ভিত্তিতে ক্লাস্টার গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে বেআইনি বাজি রোখার বার্তা দেওয়া সত্ত্বেও এগরাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে কেন, তা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন উঠছে। বাজি প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশের কারণেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।