২২ বছর আগে ১৩ ডিসেম্বর সংসদে হামলার স্মৃতি ফিরল বুধবার। ২০০১ সালে পাক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান ন’জন। বুধবারের অভিঘাত সেই তুলনায় নগণ্য। দুই যুবকের সংসদে ঢোকা এবং গ্যালারি থেকে ভবনে ‘রং বোমা’ নিয়ে ঢুকে পড়া উস্কে দিল ভয়ঙ্কর স্মৃতি। সে দিন ছিল ১৩ ডিসেম্বর। বুধবারও ১৩ ডিসেম্বর। মিল আরও একটা। দুই হানাই বিজেপি জমানায়।
বুধবার জি়রো আওয়ারে দু’জন ঢুকে পড়েন সংসদের নতুন ভবনে। ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’— স্লোগান দিতে দিতে ঢোকেন দু’জন। হাতে ছিল রং বোমা। ওই সময়ে সংসদে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। ধোঁয়া দেখে চকিতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়।
সাংসদদের মধ্যে দু’জন ধরে ফেলেন হানাকারীদের। পরে তাঁদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিম্হার অতিথি হয়ে ঢুকে পড়া ওই প্রবেশকারীরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন।
অনুপ্রবেশকারীদের এক জন অমল শিন্ডে। তাঁর বাড়ি মহারাষ্ট্রে। অন্য জনের নাম নীলম সিংহ। তিনি হরিয়ানার বাসিন্দা। দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন সাগর শর্মা নামে আরও এক জন। তিনিই পুরো ঘটনায় ‘নেতৃত্ব’ দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সাগর একটি ভিজিটর পাস জোগাড় করেন বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিম্হার অতিথি বলে।
এমন একটি ঘটনায় বিস্মিত এবং আতঙ্কিত সাংসদেরা। বস্তুত, বুধবার সংসদে হানার ২২ বছরে মৃত নয় নিরাপত্তারক্ষীকে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, কংগ্রেস চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধী। তাঁরা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর এক শীতের সকাল। ঘড়ির কাঁটায় ১১টা ৪০ মিনিট। পাঁচ জঙ্গি ঢুকে পড়েছিলেন সংসদে। কেন্দ্রীয় সরকারের ভুয়ো স্টিকার দেওয়া গাড়ি নিয়ে সংসদের সামনে ঢুকে পড়েন তাঁরা। সন্দেহ হয় নিরাপত্তারক্ষীদের।
গাড়িটিকে আটকাতেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সংসদের ঘরে ঘরে বেজে ওঠে অ্যালার্ম। ওই সময় সংসদে মন্ত্রী এবং সাংসদ মিলিয়ে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১০০ জন।
গুলির জবাব দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। প্রায় ৩০ মিনিট চলে গুলির লড়াই চলে। মৃত্যু হয় আট নিরাপত্তারক্ষী এবং এক মালির। মারা যায় পাঁচ সন্ত্রাসবাদী। আহত হন অন্তত ১৫ জন।
২০০১ সালের সংসদে হানায় পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম জড়ায়। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আডবাণী জানান, লস্কর-ই-তইবা এবং জইশ-ই-মহম্মদ নামে দুই জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে হামলার মূলে। তদন্ত প্রক্রিয়ার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘পাঁচ সন্ত্রাসবাদী মিলে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ তৈরি করে। এরা সবাই পাকিস্তানের বাসিন্দা।’’ তিনি জানান, ওই জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ দেশে কেউ থাকলে তাদের ধরা হবে।
বস্তুত, হামলার দু’দিনের মধ্যেই কাশ্মীর থেকে ধরা পড়েন আফজল গুরু এবং তাঁর এক সঙ্গী৷ বারামুলায় জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা আফজলের। পড়াশোনায় ভাল ছিলেন। ডাক্তারির ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এমবিবিএস কোর্স শেষ হওয়ার আগেই আফজল নাম লেখান জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টে। সেখানেই জঙ্গি প্রশিক্ষণের হাতেখড়ি।
এলকে আডবাণী ওই হামলাকে ‘সবচেয়ে দুঃসাহসী’ বলে আখ্যা দেন। তিনি এ-ও বলেন, ‘‘পাকিস্তানের স্পনসর করা সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মধ্যে দুই দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হানা।’’
ওই হামলার ঘটনায় দিল্লি পুলিশ এফআইআর করে। আফজলের পাশাপাশি শওকত হোসেন গুরু, আফসান গুরু এবং অধ্যাপক এসএআর গিলানিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আফজল, গিলানি এবং শওকতকে মৃত্যুদণ্ড দেয় পুলিশ। তবে তাঁরা তিন জন রায়কে চ্যালেঞ্জ করেন। ২০০১ সালের ১ ডিসেম্বর বেকসুর খালাস করা হয় আফসানকে। ২০০৩ সালে গিলানিও ছাড়া পান। শওকতকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত।
বার বার খারিজ হয় আফজলের প্রাণভিক্ষার আবেদন। এক দিন ধৈর্য হারিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘আমাকে ফাঁসি দিয়ে কিচ্ছু হবে না, কারণ, আজাদ কাশ্মীর না হওয়া পর্যন্ত এমন হানা আরও হবে। অনেক আফজল আছে, একটা আফজলকে মেরে কী হবে?’’ বস্তুত, জম্মু-কাশ্মীর লিবারশন ফ্রন্টের জীবন ভাল লাগেনি বলে বিএসএফের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন আফজল। মূলস্রোতে ফিরতে চেয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
কিন্তু ব্যবসার সূত্রেই আফজলের পরিচয় হয় তারিকের সঙ্গে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি নেতা তারিক আফজলকে ‘আজাদ কাশ্মীর’ মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। সংসদ-মামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন আফজল। তার পর থেকে ঠিকানা ছিল তিহাড় জেল।
২০১৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আফজলের স্ত্রীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। খারিজ হয় প্রাণভিক্ষার আর্জি। ২০১৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে ফাঁসি হয় আফজলের। কবর দেওয়া হয় তিহাড়েই।
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানা। আবার একটি হানার মুখে পড়ল সংসদ। অটল জমানায় সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালায় সংসদের ঠিক বাইরে। এ বার নিরাপত্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুই হানাদার ঢুকে পড়লেন সংসদে।
লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা কার্যপ্রণালী পুনরায় শুরু করার পরে সংসদে জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে ক্যানিস্টার থেকে ধোঁয়া ‘নিরাপদ’ এবং সেটা ‘চিন্তার কারণ নয়।’ এ বিষয়ে তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।