পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার গুঞ্জন। আর সে কথা পাঁচকান হওয়া আটকাতে মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাব নীল ছবির নায়িকাকে। শুধু তা-ই নয়, ঘুষের ব্যাপারটি গোপন রাখতে ব্যবসায়িক সংস্থার নথিপত্র জালিয়াতির অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। নির্বাচনের মুখে ফের এক বার সেই ‘পর্ন কাঁটা’য় বিদ্ধ আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট তথা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
চলতি বছরের ৫ নভেম্বর থেকে আটলান্টিকের পারের দেশটিতে শুরু হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোটের ঠিক মুখে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচারে নামছেন পর্ন ছবির তারকারা। এর জন্য রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন তাঁরা। যা ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ তথা বর্তমান ভাইস প্রাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমার কুশীলবদের অভিযোগ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নীল ছবি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন ট্রাম্প। নিজের ‘অপকীর্তি’ ঢাকতে নাকি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি। এই বিষয়ে সতর্ক করে রিপাবলিকান প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারে ঝড় তুলেছেন তাঁরা।
ওয়েব দুনিয়ায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে ‘#হ্যান্ডসঅফমাইপর্ন’ নামের একটি মঞ্চ তৈরি করেছেন প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সেখানে সকলকে সতর্ক করে তাঁরা বলেছেন, রিপাবলিকান প্রার্থী ও তাঁর সহযোগীদের মূল লক্ষ্য হল নীল ছবির কুশীলবদের জেলবন্দি করা। এই প্রচারে ইতিমধ্যেই দু’লক্ষ ডলার খরচ করে ফেলেছেন পর্ন তারকারা।
প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা নীল ছবিকে ‘প্রাণবন্ত ও আনন্দময়’ জীবনের অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন। আর তাই ট্রাম্পের ষড়যন্ত্র বিফল করতে আমেরিকাবাসীকে ব্যালটে জবাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। ভোটদানের সময়ে সুস্থ-স্বাভাবিক দেশ গড়ার বিষয়টি মাথায় রাখার কথা বলেছেন তাঁরা।
সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পর্নতারকা সিওক্সি কিউ বলেছেন, ‘‘আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক বিনোদনের বিষয়টি চিন্তা করেন, এটি গ্রহণ করতে সম্মত হন, তা হলে ৫ নভেম্বর আপনাকে ভোটের বাক্সে জবাব দিতে হবে। এর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই।’’
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সরকারি নীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এ জন্যে ‘প্রকল্প ২০২৫’-এর কথা বলেছেন তিনি। যাতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। যাঁরা এটি তৈরি করছেন ও তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের কারারুদ্ধ করার কথাও ওই প্রকল্পের দলিলে লেখা রয়েছে।
নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন ট্রাম্প অবশ্য ‘প্রকল্প ২০২৫’ থেকে নিজেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, এই ইস্যুতে তাঁকে ডেমোক্র্যাটিকেরা নিশানা করতে ছাড়েননি। হ্যারিসের অনুগামীদের কথায়, ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠেরাই প্রকল্প ২০২৫-এর হোতা। আর এর বিচারধারায় সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের।
পর্নতারকাদের প্রচার নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। সমীক্ষক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর ফ্যামিলি স্টাডিজ়’-এর দাবি, #হ্যান্ডসঅফমাইপর্নের প্রচারটি মূলত পুরুষদের মধ্যে চালানো হচ্ছে। কারণ, মহিলাদের তুলনায় ছেলেদের বিরুদ্ধে চার গুণ বেশি নীল ছবি দেখার তথ্য রয়েছে।
আমেরিকার নির্বাচনী বিশ্লেষকদের দাবি, লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে মহিলাদের তুলনায় পুরুষ ভোট সব সময়ে বেশি পেয়েছেন ট্রাম্প। আর তাই পেনসিলভ্যানিয়া, অ্যারিজোনা ও জর্জিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক ছবির কুশীলবেরা বেশি করে প্রচার চালাচ্ছেন। সেখানকার কেউ পর্ন ছবি দেখতে গেলেই স্ক্রিনে ফুটে উঠছে একটি ঘোষণা। যাতে ভোটে ট্রাম্পকে হারানোর কথা বলা হচ্ছে।
নীল ছবির তারকাদের মধ্যে সিওক্সি কিউ জোরকদমে এই প্রচার চালাচ্ছেন। পর্ন দেখার সময়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমি জানি তুমি খুব ব্যস্ত। আমি জানি তুমি অন্য কিছু করছ। একটু দাঁড়াও। তুমি যদি এটা করে যেতে চাও তা হলে নভেম্বরের ৫ তারিখ ভোট দাও... আনন্দ করো।’’
আমেরিকাতে পর্ন বন্ধ করার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। এর আগে ১৯৮০-র দশকে নীল ছবি আটকাতে কড়া পদক্ষেপ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন। যদিও তাতে পুরোপুরি সফল হননি তিনি। ওই সময়ে গোপনে পর্নোগ্রাফির শুটিং করতেন এই ছবির কুশীলবেরা।
প্রাপ্তবয়স্ক ছবির নায়ক-নায়িকারা অবশ্য একে আমজনতার স্বাধীনতার অংশ বলেই মনে করেন। রিপাবলিকানরা অবশ্য যৌনশিক্ষার বই নিষিদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যাকে প্রচারে সামনে এনেছেন তাঁরা। পাশাপাশি আগামী দিনে সমকামী বিবাহ বা প্রজননের অধিকারের মতো বিষয়গুলিতে আঘাত নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পর্নতারকারা।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় থাকাকালীনই পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী কালে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে সে দেশের আদালত।
পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের আসল নাম স্টেফানি গ্রেগরি ক্লিফোর্ড। আমেরিকার ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে গল্ফের মাঠে একটি ইভেন্টে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ট্রাম্পের। এর পরই স্টর্মির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নীল ছবির তারকার সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ার এক বছরের মাথায় স্লোভানিয়ান মডেল মেলানিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প-স্টেফানির সম্পর্ক নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কেউ কিছু জানতেনও না। কিন্তু, ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণার পরই ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শুরু হয় কাটাছেঁড়া। স্টেফানি ছাড়াও বহু নারীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং যৌন সম্পর্কের কথাও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। সেই সময়ে সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় ওই পর্নস্টারকে।
ট্রাম্পের বহুগামিতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে রীতিমতো চর্চা চলে। এই পরিস্থিতিতে পর্নস্টারের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে, সেটা অনুমান করে নাকি স্টেফানির মুখ বন্ধ করতে চান ট্রাম্প। আর তাতে প্রাথমিক ভাবে সফলও হন তিনি। এ জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার খরচ করতে হয় তাঁকে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছিল, ট্রাম্প সরাসরি এ বিষয়ে স্টেফানির সঙ্গে কথা বলেননি। তাঁর ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের সঙ্গে কথা হয় স্টেফানির আইনজীবী কেইথ ডেভিডসনের। লস অ্যাঞ্জেলসে সিটি ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা পড়ে। আর ঘটনাটি ঘটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে ২০১৬-র অক্টোবরে।
স্টর্মিকে টাকা দেওয়ার জন্য ট্রাম্প তাঁর ব্যবসায়িক সংস্থার নথিপত্রে জালিয়াতি করেছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনায় আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন সত্তরোর্ধ্ব ওই রিপাবলিকান নেতা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি অভিযোগের সব ক’টিই প্রমাণিত হয়েছে বলে জানায় নিউ ইয়র্কের একটি আদালত।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এবং তার পরে পর্ন তারকার সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কের অভিযোগ অস্বীকার করেন ট্রাম্প। কিন্তু এই নিয়ে তাঁর হয়রানি কম হয়নি। ফের নির্বাচনের মুখে উঠল সেই প্রসঙ্গ। যা ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলবে কি না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আর কয়েক দিন।