ছবিমুক্তির আগে দুর্বল সিজিআই-এর ব্যবহার, পৌরাণিক চরিত্রের বেশভূষা নিয়ে বিতর্কে মাখামাখি ছিল ওম রাউত পরিচালিত ‘আদিপুরুষ’। ১৬ জুন মুক্তির পর বিতর্ক যেন আরও জাঁকিয়ে ধরেছে ছবিটিকে। ছবি নির্মাতার পাশাপাশি সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন ছবির চিত্রনাট্যকার মনোজ মুন্তাসির।
দর্শক থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিবিদও সংলাপ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগ, হনুমান-সহ রামায়ণের পৌরাণিক চরিত্রের মুখে যে সংলাপ দেওয়া হয়েছে তা নাকি অত্যন্ত নিম্নমানের এবং কুরুচিপূর্ণ।
মনোজের অবশ্য দাবি, ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে কাজ করার সময় নিজের সেরাটা দিয়েছেন তিনি। মনোজ জানান, তিনি যখন ছবির সংলাপ লেখার কাজ নিয়ে বসতেন তখন রামায়ণের প্রতি নিজের শ্রদ্ধা থেকে জুতো খুলে বসতেন। দর্শকের সমালোচনায় খানিকটা ভেঙেও পড়েছেন বলে জানান মনোজ।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ‘আদিপুরুষ’ ছবির সংলাপ নিয়ে মুখ খুলেছেন মনোজ। তিনি বলেন, ‘‘সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে কোনও ভুল পদক্ষেপ করিনি আমি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের দিদা-ঠাকুমারাও চলতি ভাষাতেই রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করে শোনাতেন। এমনকি সাধারণ মানুষও এই ভাষাতেই কথা বলেন। আমি আলাদা কিছুই করিনি।’’
শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরে, রাজ্যসভার সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী দাবি করেছেন, ‘আদিপুরুষ’ ছবির সংলাপ ‘রকের ভাষার মতো’। রাজনীতিবিদদের মতে, এমন সংলাপ পৌরাণিক চরিত্রের মুখে দেওয়ার অর্থ তাঁদের অশ্রদ্ধা করা।
ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেল ‘আদিপুরুষ’ ছবির সংলাপ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তিনি জানান, রাজ্যবাসী যদি চান তা হলে এই ছবির উপর নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা করা হবে। রাজ্যবাসীরা সিদ্ধান্ত নিলে রাজ্য সরকার তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই ছবির বিরুদ্ধে দিল্লির হাই কোর্টে ইতিমধ্যেই আবেদন করেছে হিন্দু সেনা। ছবির প্রদর্শন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে তাঁদের তরফে। ‘আদিপুরুষ’ ছবিতে পৌরাণিক হিন্দু চরিত্র রাম, রাবণ, সীতা এবং হনুমানের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের। হিন্দু সেনার তরফে অবিলম্বে ছবি থেকে কিছু ‘আপত্তিকর’ দৃশ্য বাদ দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। সংলাপ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
‘আদিপুরুষ’ ছবিতে লঙ্কাদহনের একটি দৃশ্যে হনুমানের সংলাপ, ‘‘তেল তেরে বাপ কা, আগ ভি তেরে বাপ কি। তো জ্বলেগি ভি তেরে বাপ কি।’’ এ ছাড়াও সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে দুর্বলতার ছায়া ধরা পড়েছে প্রতি পদে পদে।
মনোজের দাবি, এটি কোনও ভুল নয়। তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবেই এমন ভাবে সংলাপ লিখেছেন। রামায়ণের এত চরিত্র। সকলের মুখে একই ধরনের সংলাপ বসানো যায় না বলেও জানান মনোজ।
তবে সংলাপকে ঘিরে এত বিতর্কের মধ্যে মনোজ টুইট করে লিখেছেন, ‘‘আমি চাইলে সংলাপ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা দিতে পারি। তবে কিছু সংলাপ দর্শকের মনে আঘাত দিয়েছে। তাই আমরা বিশেষ কয়েকটি জায়গায় সংলাপ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী সপ্তাহ থেকেই তা কার্যকর হবে।’’
‘আদিপুরুষ’-এই প্রথম নয়, এর আগেও বহু হিন্দি ছবির জন্য গান লিখেছেন মনোজ। তা ছাড়া দক্ষিণী ছবির সংলাপ লেখা থেকে শুরু করে হলিউডি সুপারহিরো ছবির সংলাপও লিখেছেন তিনি।
মনোজের আসল নাম মনোজ শুক্ল। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময় মুন্তাসির পদবি ধারণ করেছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের অমেঠিতে জন্ম তাঁর।
মনোজের পরিবার চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শৈশব থেকেই রামায়ণ এবং মহাভারতের গল্প শুনে বড় হয়েছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে স্কুল এবং কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইতি টেনে কাজের সন্ধানে মুম্বই চলে যান তিনি।
১৯৯৯ সাল থেকে হিন্দি ধারাবাহিক, হিন্দি রিয়্যালিটি শো এবং হিন্দি ছবির সংলাপ লেখার কাজ শুরু করেন মনোজ। অমিতাভ বচ্চন সঞ্চালিত ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র জন্যও সংলাপ লিখেছেন তিনি।
কেরিয়ার শুরুর পর্বে নীলম শুক্লকে বিয়ে করেন মনোজ। এক পুত্রসন্তানও রয়েছে তাঁর। লেখক হিসাবে হিন্দি ফিল্মজগতে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলার পর বিভিন্ন হিন্দি ছবির গানও লিখতে শুরু করেন তিনি।
‘এক ভিলেন’ ছবির ‘গলিয়াঁ’, ‘রুস্তম’ ছবির তেরে সঙ্গ ইয়ারা’, ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ ছবির ‘কৌন তুঝে’র মতো গান লিখেছেন মনোজ।
বলিউড মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রিতে আসার পর এমএম কীরাভানি, অরিজিৎ সিংহ, অঙ্কিত তিওয়ারি, জুবিন নৌটিয়াল, আমাল মালিক, হিমেশ রেশমিয়া, অর্কপ্রভ মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন মনোজ।
২০২০ সালে মুক্তি পায় ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’ ছবিটি। এই ছবিতে অরিজিতের কণ্ঠে ‘ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা’ গানটি লিখেছিলেন মনোজ। কিন্তু এই গানের নেপথ্যে রয়েছে অন্য গল্প।
আসলে ‘ফির ভি তুমকো চাহুঙ্গা’ গানটি ২০০১ সালে স্ত্রীর জন্য লিখেছিলেন মনোজ। পরে ছবিতে সেই গানটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শ্রোতাদের কাছে আশানুরূপ প্রশংসা না পাওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করেন তিনি।
জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন মনোজ। পরিণীতি চোপড়া অভিনীত ‘সাইনা’ ছবির গানের জন্য পুরস্কার পান তিনি।
এ ছাড়াও ২০২০ সালে ‘কেসরি’ ছবির ‘তেরি মিট্টি’ গানটির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন মনোজ। কিন্তু সেরা গানের পুরস্কার জোটেনি তাঁর। তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে টুইট করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন তিনি।
গানের বিভিন্ন রিয়্যালিটি শোয়ের সংলাপ লিখেছেন মনোজ। তা ছাড়া ‘বাহুবলী ২’ ছবির হিন্দি সংস্করণের সংলাপ লিখেছেন তিনি।
হলিউড সুপারহিরো ছবি ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-এর হিন্দি সংস্করণের সংলাপ লেখার দায়িত্বে ছিলেন মনোজ।
ইনস্টাগ্রামে ১৪ লক্ষ অনুরাগী রয়েছে মনোজের। ইউটিউবে নিজস্ব একটি চ্যানেলও খুলেছেন তিনি। সেখানে পৌরাণিক ঘটনা থেকে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে ভিডিয়ো পোস্ট করেন তিনি। ইউটিউবেও ২০ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে মনোজের।