রূপকথার শুরুটা হয় সৌদি আরবে। ছাত্রাবস্থায় একে অপরের প্রেমে পড়েন ওঁরা। নারী-পুরুষের প্রেমে পরিবারের মত না থাকলে যুগলকে যে বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বাধা পেয়েছিলেন এই যুগল। কারণ তাঁরা দু’জনেই নারী।
কথা হচ্ছে আধিলা নাসারিন এবং ফতিমা নুরাকে নিয়ে। সম্প্রতি তাঁরা আংটিবদল করেছেন। সেই ফটোশুটের ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল। সমুদ্রের ধারে একে অপরকে আংটি পরিয়ে দিয়ে কেক কেটেছেন তাঁরা।
আনুষ্ঠানিক ভাবে ফতিমা আর আধিলার বিয়ে হয়নি এখনও। আইনি বিবাহের বন্ধনেও তাঁরা আবদ্ধ নন। আংটিবদল করে একটি ফটোশুট করেছেন মাত্র। তবে আগামী দিনে বিয়ে করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন দু’জনেই।
ফতিমাদের লড়াইটা সহজ ছিল না। সৌদি আরবে থাকাকালীন তাঁদের পরিচয় হয়। দু’জনেই তখন স্কুলপড়ুয়া। দ্বাদশ শ্রেণির সেই প্রেম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হয়েছে আরও। প্রেমই তাঁদের যাবতীয় লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছে।
গত মে মাসে কেরল হাই কোর্ট ফতিমা এবং আধিলাকে এক সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছে। ৩১ মে হাই কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ের পর থেকে নির্বিঘ্নে একত্রে থাকেন প্রেমিক-যুগল।
সৌদি থেকে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ফতিমা এবং আধিলা উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন ভারতে। তাঁরা দু’জনেই কেরলের বাসিন্দা। সেখানে ডিগ্রি কোর্সের জন্য পড়াশোনা করেন তাঁরা। পরে কোভিড অতিমারির সময় ফতিমাকে নিয়ে সৌদিতে ফিরে যান তাঁর বাবা-মা।
সৌদিতে গিয়ে ফতিমার কাছ থেকেই তাঁরা এই সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। তার পর শুরু হয় লড়াই। ফতিমা এবং আধিলা— দু’জনের বাড়িতেই তুমুল অশান্তি হয় এই সম্পর্ক নিয়ে। কিছুতেই পরিবারের সদস্যরা এই সমলিঙ্গ প্রেম মেনে নিতে পারেননি।
ফতিমা, আধিলাকে আলাদা করতে উঠে পড়ে লেগেছিল দুই পরিবার। অনেক বকাঝকা, অজস্র চোখরাঙানি ধেয়ে আসে। তাঁদের উপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা হয় বলে অভিযোগ।
ফতিমা এবং আধিলার বিয়ে দিতেও উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনরা। পাত্র দেখার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফতিমারা তবু কিছুতেই একে অপরের হাত ছাড়েননি।
পড়াশোনা শেষ করার পর দু’জনেই চেন্নাইয়ে চাকরি পান। গত মে মাসে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। চেন্নাইয়ে এলজিবিটিকিউ গোষ্ঠী পরিচালিত একটি হোমে আশ্রয় নেন ফতিমা এবং আধিলা। সেখানে লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলেন বেশ কিছু দিন।
তবে বেশি দিন এক সঙ্গে থাকতে পারেননি। প্রথমে পরিবার, পরে পুলিশ এসে হানা দেয় তাঁদের হোমে। আধিলার বাবা-মা তাঁকে এবং ফতিমাকে নিয়ে যান মুপ্পাথাডমের বাড়িতে। সেখানে ফতিমার পরিবার এসে মেয়েকে নিয়ে যান নিজেদের বাড়িতে।
জোর করে যুগলকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এর পরেই আইনি লড়াইয়ের পথে হাঁটেন আধিলা। তিনি সটান হাজির হন কেরল হাই কোর্টে। এক সঙ্গে থাকতে চেয়ে আবেদন জানান আদালতে। পরিবারের সদস্য এবং পুলিশের হাত থেকে রেহাই চেয়ে দাবি করেন নিরাপত্তাও।
কেরল হাই কোর্টের বিচারপতি পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর যুগলের পক্ষে রায় দেন। ৩১ মে হাই কোর্ট জানায় ফতিমা এবং আধিলার এক সঙ্গে থাকতে কোনও বাধা নেই। পরিবার বা পুলিশ কেউ তাঁদের সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
তার পর থেকে চেন্নাইতেই নির্বিঘ্নে থাকেন যুগল। একই আইটি সংস্থার অফিসে তাঁরা চাকরি করেন। কেউ তাঁদের বিরক্ত করেন না আর।
ভারতে সমলিঙ্গ বিবাহে এখনও আইনের সম্মতি নেই। তাই ফতিমা, আধিলার চার হাত এক হয়নি এখনও। তাঁরা আংটিবদলের মাধ্যমে একটি ফটোশুট করেছেন শুধু। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বিয়েও করতে চান।
আদালতের সবুজ সঙ্কেত থাকলেও সমাজের টিপ্পনী হামেশাই সহ্য করতে হয় এই দুই সমলিঙ্গ যুগলকে। অনেকেই তাঁদের নিয়ে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে নানা রকম আলোচনা করেন। কেউ কেউ আবার হাসাহাসিও করে থাকেন। কিন্তু সে সব পাত্তা দেন না দু’জনের কেউই।
এক সাক্ষাৎকারে ফতিমা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। কেন এখনও চাকরি বা উচ্চশিক্ষা, সব ক্ষেত্রে মহিলাদের ফর্ম পূরণের জন্য অভিভাবক হিসাবে বাবা অথবা স্বামীর নাম প্রয়োজন হয়, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। চাকরির জন্য তাঁকেও বাবার নাম ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু তা তিনি চান না বলেই জানিয়েছেন বারবার।
স্বাধীন ভারতে সকলে আদৌ ‘স্বাধীন’ কি না, সেই প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে আধিলাকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘কোনও কিছুই ভারতের সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। স্বাধীনতা তো কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আমরা আমাদের পরিবার এবং সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনতা খুঁজে নিয়েছি।’’
একই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলার উপর ভরসা রেখেই তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন আধিলা। ভারতেও আগামী দিনে সমলিঙ্গ সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে আশাবাদী তিনি।