‘যা সিমরন যা, জি লে আপনি জিন্দেগি…। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিটির শেষ দৃশ্যটা মনে আছে? স্টেশন ছাড়ছে ট্রেন। দরজায় দাঁড়িয়ে শাহরুখ ওরফে রাজ। ট্রেন ছোটা শুরু করতেই অমরীশ পুরীর মুখ থেকে শোনা গেল, “যা সিমরন যা, জি লে আপনি জিন্দেগি…।” আর প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করলেন কাজল ওরফে সিমরন। এই দৃশ্য আজও আপামর ভারতীয়ের মনের কোণে রয়ে গিয়েছে। প্রতীকী ছবি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের এক যুগলের ঠিক একই কায়দায় একটি ছবি ভাইরাল হওয়ায় মনে করিয়ে দিচ্ছে দু’দশকেরও আগের সেই ‘যা সিমরন’ জুটির মিল হওয়ার সেই দৃশ্যকে।
রাজ-সিমরনের প্রেমকাহিনি শুরু হয়েছিল বিদেশে একটি ট্রেনসফরের মধ্য দিয়ে। ঘটনাচক্রে, এই যুগলের প্রেমসফরের কাহিনিতেও রয়েছে স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, ট্রেন— সবই।
বাংলাদেশের এই কাহিনির নায়ক আমির হামজা। নায়িকা ফাতেমা তুজ জোহরা। তাঁদের কাহিনির সূত্রপাতও হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। দু’জনকে প্রেমের বাঁধনে বেঁধে রাখার সঙ্গে ট্রেনের যোগ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে যেমন বলিউডের ছবি ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবির কথা উঠল, তেমনই মনে পড়তে পারে ‘জব উই মেট’ কিংবা ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবির অনুষঙ্গও।
আমিরের বাড়ি সিলেটে। ফাতেমার ঢাকায়। সাল ২০১৮। একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল দু’জনের। পরিচয়ের কয়েক দিন পর ফাতেমা জানতে পেরেছিলেন, আমির আত্মহত্যা করবেন বলে স্থির করেছেন।
বিষয়টি ভারী অদ্ভুত লেগেছিল ফাতেমার। যাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল, আর সেই পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারলেন, সেই ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে চাইছেন! কৌতূহলবশত আমিরের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফাতেমা। সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে এমন নানা সমস্যার সমাধান করেছেন ফাতেমা। তাই আমিরের আত্মহত্যা করার কারণ জানতে ফাতেমা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
‘প্রথম আলো’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাতেমা বলেন, “জানতে পেরেছিলাম, আমিরের সঙ্গে একটি মেয়ের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। তার পর তাঁদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। মেয়েটি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, এটা মানতে পারেননি আমির। তার পরই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।” প্রতীকী ছবি।
ঘটনাটি শোনার পর ফাতেমা ঠিক করেন, আমিরকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনতে হবে। তাঁকে বোঝাতে হবে, আত্মহত্যাই সব কিছু নয়। প্রথম আলো-কে ফাতেমা বলেন, “এক সময় আমির ধীরে ধীরে আমার উপর ভরসা করতে শুরু করেন। এক দিন তো বলেই বসলেন, আমাকে ভালবেসে ফেলেছেন। বিয়ে করতে চান।” সেই থেকেই তাঁদের প্রেমের পথ চলা শুরু। প্রতীকী ছবি।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ফাতেমা। পরে চাকরি সূত্রে সিলেটে যান। শমশেরনগরে মামার বাড়িতে থাকতেন। কাজ শেষে রাতের ট্রেনে বাড়িতে ফিরতেন। প্রতীকী ছবি।
অফিস থেকে সিলেট স্টেশনে আসা, ফাতেমাকে ট্রেনে তুলে দেওয়া, সব সময়েই তাঁর সঙ্গী ছিলেন আমির। ধীরে ধীরে সিলেট স্টেশনই হয়ে উঠেছিল তাঁদের প্রেমের আশ্রয়স্থল। তাঁদের বেশির ভাগ কথাই হত সিলেট স্টেশনে। প্রতীকী ছবি।
ট্রেনে আমির আগে চড়তেন। তার পর ফাতেমাকে হাত ধরে ট্রেনে তুলে দিয়ে নেমে পড়তেন। দীর্ঘ দিন এটাই ছিল তাঁদের দু’জনের রুটিন। তত দিনে আমিরও ফাতেমার অফিসে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতীকী ছবি।
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলো-কে ফাতেমা বলেন, “গল্প করতে করতে সময়ে কোথা দিয়ে বেরিয়ে যেত টের পেতাম না। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, রাত ৯টার ট্রেনের টিকিট কাটা রয়েছে। গল্প করার জন্য সেই টিকিট বাতিল করে আবার ১০টার টিকিট কেটেছি।” ফাতেমা আরও জানান, প্রতি দিনই রেলের গার্ড, চালক দেখতেন এক তরুণ এবং তরুণী শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরার জন্য ছুটছেন। ফলে তাঁরা দু’জনেই রেলকর্মীদের কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রতীকী ছবি।
প্রেমের সম্পর্ক মধুর হলেও, বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই আমিরের বাড়ির লোক বেঁকে বসেন। ফাতেমা সিলেটি নন, তাই বিয়ে করা যাবে না, এমনটাই জানিয়ে দিয়েছিলেন আমিরের বাড়ির সদস্যরা। তবে তাঁর মা এই বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আমির-ফাতেমা স্থির করেন, তাঁরা বিয়ে করবেন। তাই ঢাকায় ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে গোপনে বিয়ে করেন। সাল ২০২০।
বিয়ের একটি ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন ফাতেমা। বিষয়টি জানাজানি হতেই আর এক দফা ঝামেলা শুরু হয়। যদিও পরে দুই পরিবারের মতেই সামাজিক ভাবে আমির-ফাতেমার বিয়ে হয়েছিল। ফাতেমা বলেন, “সামাজিক ভাবে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই সিলেট স্টেশনে দু’জনে ছুটে গিয়েছিলাম ফোটোশুট করানোর জন্য। যে ভাবে ট্রেন ধরতাম, যে ভাবে আমির আমাকে ট্রেনে তুলে দিত, সেই দৃশ্য রিক্রিয়েট করে ছবি তুলিয়েছিলাম বর-কনের সাজে।” প্রতীকী ছবি।
দু’বছর আগের পুরনো সেই ছবি ভাইরাল হতেই তা নজরে পড়ে ফাতেমার। তিনি বলেন, “নেটমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছিল। কারণ এটি একটি ভাললাগার মতো বিষয়।” কিন্তু ছবিটি যে এ ভাবে ভাইরাল হয়ে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। ফাতেমা এখন পুরোদমে সংসার করছেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে ফাতেমার ভাললাগার একটা অন্য বিষয়ও রয়েছে। যে মানুষটি তাঁর জীবনসঙ্গী, সেই মানুষটি তাঁকে সব সময় বলেন, “তোমার জন্যই আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি।” প্রতীকী ছবি।
সবশেষে ফাতেমা বলেন, “এক দিন স্টেশনে বসেই আমিরের প্রাক্তন প্রেমিকাকে ফোন করেছিলাম। চেয়েছিলাম, ওঁরা দু’জন এক হয়ে যাক। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে সব মিলিয়ে আমরা দু’জনে ভালই আছি। দু’জন দু’জনকে আপনি বলেই সম্বোধন করি।”