ঘন জঙ্গলের আধোঅন্ধকারের মাঝে একটি গহীন রাস্তা। তার ধারে গাছগাছালির মাঝে এক লাইনে সার সার পাথুরে মূর্তি। গায়ে শ্যাওলার গাঢ় পরত। প্রতিটিরই মাথায় লাল টুপি। সেগুলির গলায় ঝুলছে ওই রঙেরই কাপড়ের বিব। বাচ্চাদের খাওয়ানো সময় যা সাধারণত ঝুলিয়ে দেন মা-বাবারা।
সেই সব মূর্তি দেখতে বছরভর জাপানে ভিড় করেন উৎসাহীরা। তবে তাঁরা সেই মূর্তিগুলি গোনাগুনি শুরু করলেই নাকি তার কয়েকটি বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। মোট ক’টি মূর্তি রয়েছে? সে অঙ্ক নাকি কখনই মেলে না। জাপানের লোকগাথায় এমনই দাবি করা হয়।
জাপানের নিক্কো-শি শহরে এক পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে ওই মূর্তিগুলি। জাপানে যা পরিচিত জিজো নামে। কানমানগাফুচির অতল গহ্বরে জাপানি দেবতা জিজোর অসংখ্য মূর্তি ঘিরে পর্যটকদের অসীম কৌতূহল।
জাপানের দেবতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে সামনের সারিতে রয়েছেন জিজো। সে দেশে একে বোধিসত্ত্বের রূপ বলে মান্য করা হয়। কথিত রয়েছে, পর্যটকদের পাশাপাশি শিশুদের আত্মারও রক্ষাকর্তা জিজো।
নিক্কো-শি শহরে জিজোর যে মূর্তিগুলি রয়েছে, সেগুলি নারাবি জিজো বলে পরিচিত। জাপানি ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ— সারবদ্ধ জিজো।
জাপানের ওই ছোট্ট শহরে দাইয়াগাওয়া নদীর কাছে ৩২০ ফুটের একটি দেওয়ালের গায়ে সার বেঁধে রয়েছে জিজোর মূর্তিগুলি। সেগুলিকে ঘিরে অপার রহস্যের জেরে অনেকের একে বেক জিজো বলেও ডাকেন। প্রসঙ্গত, জাপানে ভূতকে বেক বলে ডাকা হয়।
আকাশের নীচে বসে থাকলেও ওই জিজোরা জিয়ুন-জি মন্দিরের অংশ। সে মন্দিরটি আবার তোকুগাওয়া সমাধির অংশও বটে। যাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী সৌধের তালিকায় রেখেছে ইউনেসকো।
গোড়ায় নাকি জিয়ুন-জি মন্দিরে শ’য়ে শ’য়ে জিজোর মূর্তি ছিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ১৯০২ সালের ভয়াবহ বন্যাও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি জিজোর সবক’টি মূর্তি। তবে বন্যার জেরে তার সংখ্যা কমে আসে। যদিও এখনও মাথা উঁচিয়ে রয়েছেন অনেকগুলি জিজো।
বসতি এলাকা ধরে কানমান পথের দিকে পা বাড়ালে জিয়ুন-জি মন্দিরে পৌঁছতে পারেন পর্যটকেরা। এই মন্দিরটি প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো। জিজো ছাড়াও এখানে বনশো নামে একটি ঘণ্টা রয়েছে। যেটি পঞ্চবিংশ শতকের। এ ছাড়া রয়েছে সুগেগাসা হিগিরি জিজোর মূর্তি। যাঁর মাথায় কাপড়ের বদলে উঠেছে বাঁশের টুপি।
নিক্কো-শি শহরে কানমান পথ ধরে এগোলে দাইয়াগাওয়া নদীর উপরে একটি সেতুও রয়েছে। সেই সেতু ধরে জঙ্গলের পথ বেঁকে গিয়ে ঠেকেছে জিয়ুন-জি মন্দিরের দরজায়।
ইতিহাসবিদদের দাবি, ১৬৫৪ সালে কোকাই নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু জিয়ুন-জি মন্দিরের স্থাপনা করেছিলেন। তবে ১৯০২ সালে ভয়াবহ বন্যায় সে মন্দিরের অনেকাংশ ভেসে গিয়েছিল। এর পর ১৯৭৩ সালে ওই মন্দিরের জায়গায় একটি ছোট হলের মতো অংশ নির্মাণ করা হয়।
জিয়ুন-জি মন্দিরটি রয়েছে কানমানগাফুচি অতল গহ্বরে। সেটি নাকি প্রায় সাত হাজার বছরের পুরনো। কথিত রয়েছে যে প্রায় সাত হাজার বছর আগে মাউন্ট নানতাইয়ে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে লাভা বেরিয়েছিল, তার জেরেই কানমানগাফুচি অতল গহ্বর তৈরি হয়।
কানমানগাফুচি অতল গহ্বরে জিজোর মূর্তিগুলি ঘিরে রহস্যময়তা টের পেয়েছেন বলে দাবি বহু পর্যটকের। এর কাছেই বয়ে চলা দাইয়াগাওয়া নদীর জলের শব্দেও নাকি এখানকার পরিবেশকে অন্য রকম করে তোলে।
জিজোর মূর্তিগুলি ঘিরে বেশ কয়েকটি লোকগাথা রয়েছে। কথিত, মৃত্যুর পর জাপানি শিশুরা সাই-নো-কাওয়ায় চলে যায়। নরকের সেই বিছানার মতো অংশ যাতে ওই শিশুদের আত্মা ঘোরাফেরা করে।
যে হেতু ওই শিশুরা জীবদ্দশায় বিশেষ কর্মফল অর্জন করেনি, তাই তাদের সে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সাই-নো-কাওয়ায় এক-একটি পাথুরে স্তম্ভ গড়তে হয়। প্রতিটি স্তম্ভেই এক-একটি প্রার্থনা লুকিয়ে থাকে। তবে শিশুরা সেই স্তম্ভ গড়ার পর প্রতি রাতে ওনি অর্থাৎ শয়তান এসে সেগুলি ভেঙে দেয়। ফলে সেগুলি নতুন করে গড়ার শাস্তি পেতে হয় শিশুদের। তবে শিশুদের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ান জিজো। সাই-নো-কাওয়ায় ঘুরে ঘুরে শিশুদের নিজের লাল রঙের বিবের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন তিনি।
জিজোর গলায় ঝোলা বিবের রং লাল কেন? এ নিয়েও লোকগাথা রয়েছে। লোকে বলে, জাপানে অসুকা আমলে অর্থাৎ ৫২২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টপূর্বে জলবসন্তে ভোগা শিশুদের চিহ্নিত করতে তাদের গলায় লাল রঙের বিব ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পাশাপাশি, লাল রংকে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার রং হিসাবেও মান্য করা হয়। শিশুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে তাই জিজোর মাথায় লাল টুপি এবং গলায় লাল বিব ঝোলানো থাকে।
জাপান সরকারের দাবি, উত্তর টোকিয়োর কানমানগাফুচিতে মোট ৭৪টি জিজোর মূর্তি রয়েছে। তবে তা গুনতে গেলে নাকি প্রতি বারই নতুন সংখ্যা মেলে। কেন এমনটা হয়? সে রহস্যের সমাধান আজও হয়নি।