সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প সরে যাওয়ার দায় তাঁর নয়। তার জন্য দায়ী তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। বুধবার শিলিগুড়িতে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান থেকে এমনই মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার দাবি, তৎকালীন শাসক সিপিএম কৃষকদের থেকে জোর করে জমি ছিনিয়ে নিয়েছিল! ক্ষমতায় আসার পর তিনি সেই জমি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ওই মন্তব্যের জেরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন বাম সরকার। তার মধ্যে প্রায় ৪০০ একর জমির দাতা ছিলেন ‘অনিচ্ছুক’।
শিলিগুড়িতে ওই মন্তব্যের জেরে মমতার বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচার’-এর অভিযোগ তুলেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। টাটা কর্ণধার রতন টাটার পশ্চিমবঙ্গ ছাড়ার আগে মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেছেন, ‘‘মমতা মাথায় বন্দুক ধরে ট্রিগার টিপে দিলেন বলেই সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যেতে হল, সে কথা তো রতন টাটাই বলেছিলেন।’’
ইতিহাস বলছে, ২০০৬ সালের ১৮ মে সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন রতন টাটা। ২৫ মে থেকে ৯৯৭ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। তার নেতৃত্বে ছিল বিরোধী তৃণমূল।
গোপালনগর, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়া, খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়ি-সহ বেশ কয়েকটি আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশি হামলার অভিযোগ ওঠে। আহত হন বেশ কয়েক জন গ্রামবাসীও।
২০০৬-এর ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরে গিয়ে আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা। সেই অশান্তির রেশ এসে পৌঁছয় রাজ্য বিধানসভায়। সে দিন বিরোধী দল তৃণমূলের বিধায়কদের একাংশ বিধানসভার আসবাব ভাঙচুর করেছিলেন বলে বামেদের অভিযোগ।
সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরানোর দাবিতে ২৬ দিন (৩-২৮ ডিসেম্বর, ২০০৬) ধর্মতলার মোড়ে অনশন-অবস্থান করেছিলেন মমতা। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর তৎপরতায় রাজভবনে আলোচনা হয়েছিল সেই ঘটনা নিয়ে। মমতার অনশন মঞ্চে এসেছিলেন বিভিন্ন দলের নেতা। সমর্থন এসেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও। অনশন মঞ্চে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।
১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছরের কিশোরী তাপসী মালিকের মৃত্যু ঘিরে রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুরু হয়। খুনের জন্য সিপিএমকে দায়ী করে তাপসীর পরিবার এবং তৃণমূল।
২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি ন্যানো কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমির চারপাশে পাঁচিল তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। ৯ মার্চ অধিগৃহীত জমি টাটার হাতে তুলে দেওয়ার পরে নতুন করে অশান্তির শুরু হয়। জমিহারা কৃষকের আত্মহত্যা ঘিরে বিতর্কও শুরু হয়েছিল।
মে মাসে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প রূপায়ণের পথ সুগম করতে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু তা সফল হয়নি।
২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে গাড়ি প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করে টাটা ন্যানো। ১৮ জানুয়ারি জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্যের পক্ষে রায় দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
২১ মে রাজ্যের পঞ্চায়েতে ভোটে সিঙ্গুর-সহ বিভিন্ন এলাকায় জয়ী হয় তৃণমূল। অগস্টে নতুন করে শুরু হয় জমিরক্ষা আন্দোলন। ২৪ অগস্ট থেকে টানা ১৫ দিন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে অবস্থান করেন মমতা।
এর আগে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ২০ অগস্ট বুদ্ধদেবের সঙ্গে মমতার আলোচনায় মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। রাজভবন জানায়, ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি না নিতে সরকার সম্মত। কিন্তু সরকার বাড়তি ক্ষতিপূরণের কথাও ঘোষণা করে।
ন্যানো কারখানা রাজ্যের বাইরে সরানোর হুঁশিয়ারি রতন টাটার। ৩ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে কারখানা নির্মাণের কাজ স্থগিত করে টাটা মোটরস। পাশাপাশিই অন্য রাজ্যে জমির খোঁজ শুরু করে তারা।
৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প সরানোর ঘোষণা করেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়, ন্যানো কারখানার পরবর্তী গন্তব্য নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের সানন্দে। তখন মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
সিঙ্গুর তথা বাংলা থেকে প্রকল্প গুটিয়ে গুজরাতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে গিয়ে রতন টাটা জানিয়েছিলেন, তিনি ‘ব্যাড এম (মমতা)’ এবং ‘গুড এম (মোদী)’-র মধ্যে দ্বিতীয়টি বেছে নিচ্ছেন।
২০১১ সালের মে মাসে বিধানসভা ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরাতে সক্রিয় হয়েছিলেন মমতা। বস্তুত, মমতা মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ৯ জুন জমি ফেরাতে জারি করা হয় অধ্যাদেশ।
১৩ জুন জমি ফেরাতে বিধানসভায় পাশ করানো হয় ‘সিঙ্গুর বিল’। ২০ জুন নতুন আইনের খসড়ায় সই করেন তৎকালীন রাজ্যপাল। ২১ জুন সিঙ্গুরের ‘বিতর্কিত’ জমির দখল নেয় রাজ্য সরকার।
২২ জুন ‘সিঙ্গুর আইন’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে যায় টাটা মোটরস। তাদের আবেদনে সরকারি নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেও কলকাতা হাই কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে।
২০১১-র ২৯ জুন সিঙ্গুর আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় টাটা গোষ্ঠী। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে মামলা ফেরে কলকাতা হাই কোর্টে। ২৮ সেপ্টেম্বর ফের রাজ্যের পক্ষে রায় দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
রাজ্যের পক্ষে হাই কোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ১ নভেম্বর ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায় টাটা গোষ্ঠী। ২০১২-র ২২ জুন ডিভিশন বেঞ্চে হার হয় রাজ্যের। কৃষকদের জমি ফেরানোর আইন ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষিত হয়।
ডিভিশন বেঞ্চের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ৬ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। ২০১৩-য় শীর্ষ আদালতে টাটা গোষ্ঠী জানায়, ‘বিকল্প শিল্প’ গড়ার উদ্দেশ্যে তারা সিঙ্গুরের ওই জমি হাতে রাখতে চায়।
২০১৬-র ৩১ অগস্ট ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত ২০০৬ সালের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে জানায়, বাম জমানায় আইন মেনে জমি নেওয়া হয়নি। ১২ সপ্তাহের মধ্যে টাটাকে জমি ফেরানোর নির্দেশও দেওয়া হয়।
চলতি বছরের ১৩ মে মমতার বাংলা জয়ের একাদশ বর্ষপূর্তির আগে সিঙ্গুর নিয়ে ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করেন টাটা গোষ্ঠীর ‘চেয়ারম্যান এমিরেটাস’ রতন টাটা। সেখানে তিনি তাঁর স্বপ্নের ন্যানো প্রকল্প শুরু করার ‘আসল কারণ’ লিখেছিলেন।
রতন জানিয়েছিলেন, মুম্বইয়ের রাস্তায় স্কুটারে সওয়ার বাবা-মায়ের মাঝখানে পরিবারের শিশু সদস্যটির ‘স্যান্ডউইচ’ হয়ে কুঁকড়ে থাকা দেখে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের জন্য একটি সস্তা এবং নিরাপদ গাড়ির কথা ভেবেছিলেন। যদিও ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তাঁর সেই ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ সফল হয়নি। ন্যানো গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করে গুজরাতের সানন্দের কারখানায় এখন অন্য গাড়ি করছে টাটা গোষ্ঠী।