Swami Vivekananda

Nautch Girl: রাজসভায় ময়নাবাঈয়ের গান শুনে কেঁদে ফেলেন বিবেকানন্দ! কী হয় সেই বাঈজির?

আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের কলকাতায় বাঈজিদের ঘিরে এক প্রকার দ্বন্দ্ব কাজ করেছে ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২২ ১৫:৩১
Share:
০১ ৩৩

বাঈজিদের সমাজে যে কখনওই শ্রদ্ধার আসনে বসানো হয়নি, তা উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকে তাঁদের নিয়ে লেখালেখি থেকেই পরিষ্কার। এক বার তেমনই এক বাঈজির গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং বিবেকানন্দ। সেই গল্পে যাব, তার আগে কলকাতার বাঈজিবিলাস নিয়ে সংক্ষেপে দু’চার কথা বলে নেওয়া যাক।

০২ ৩৩

উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের কলকাতায় বাঈজিদের ঘিরে এক প্রকার দ্বন্দ্ব কাজ করেছে ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের। এক দিকে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং নৃত্য— শিল্পের এই দুই মাধ্যমের অগ্রণী শিল্পী তাঁরা। একই সঙ্গে তাঁদের কাছেই আবার ‘বাঁধনহীন’ যৌনতার হাতছানি।

Advertisement
০৩ ৩৩

একটা সময় বেশির ভাগ বাঈজি থাকতেন চিৎপুরে। জনশ্রুতি, অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের হাত ধরেই কলকাতায় উত্তর ভারতীয় ঘরানার বাঈজিদের আগমন। চিৎপুরে বাঈজিদের থাকার ব্যবস্থাও নাকি করেন ওয়াজিদ আলি শাহ।

০৪ ৩৩

আবার গবেষকদের একাংশের মতে, নব মুন্সির আমদানি এই বাঈজি-সংস্কৃতি। কিছু কিছু গবেষকের অবশ্য দাবি, কলকাতায় বাঈনাচ পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছেছিল রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরে।

০৫ ৩৩

নবকৃষ্ণের ইংরেজ আনুগত্য ছিল স্বীকৃত। নবকৃষ্ণই আবার কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নিতাই দাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর সভায় বাঈনাচের আয়োজন হলে সমাজের ‘এলিট’ সাহেব-সুবো আর বাবুরা নিমন্ত্রণে যেতেন।

০৬ ৩৩

ধীরে ধীরে বৌবাজার, বাগবাজার, পাইকপাড়া এবং বেলঘরিয়ায় তাঁদের আস্তানা গড়ে ওঠে। সে সময় একটা প্রবাদ চালু ছিল, ‘চল্‌ পানসি বেলঘরিয়া!’ অর্থাৎ নব্য বাবুরা নৌকা করে বেলঘরিয়ায় যাবেন বাঈজি-সঙ্গ উপভোগ করতে।

০৭ ৩৩

কলকাতার বাঈজিবিলাস নিয়ে আলোচনা করলে অবধারিত ভাবে আসে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথের কথা। বৌবাজারে দ্বারকানাথ ঠাকুরের দুটো কোঠা ছিল। ২৩৫ এবং ২৩৬ বৌবাজার স্ট্রিট। সেখানে ৪৩টি ঘর জুড়ে ছিল যৌনকর্মীদের আস্তানা।

০৮ ৩৩

জনশ্রুতি, দ্বারকানাথের বাঁধা কোনও রক্ষিতা ছিল না বলে নাকি তিনি ‘বাবু’ হতে পারছিলেন না। অতঃপর, তিনিও জবাব দিলেন স্বমহিমায়। একটি পতিতাপল্লির মালিক হলেন তিনি।

০৯ ৩৩

বিখ্যাত বাঈজিদের যে নাম বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন, নিকি বাঈ, অসরুন জিন্নাত, বেগম জান, মির্জা জান, হীরা বুলবুল, গওহর জান, নুরজাহান, মালকা জান, জানকি বাই (ছপ্পন ছুরি), জদ্দন বাই (অভিনেত্রী নার্গিসের মা, সঙ্গের ছবিতে), কোহিনুর, ইন্দুবালা প্রমুখ।

১০ ৩৩

হীরা বুলবুল থাকতেন বউবাজার অঞ্চলে। তৎকালীন কলকাতায় হীরা বুলবুল সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইয়ে শিবনাথ শাস্ত্রী এই বিষয়টির উল্লেখ করেছিলেন।

১১ ৩৩

ঘটনাটি কী? হীরা নিজের ছেলেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করতে যান। এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ হয়। যা নিয়ে সে সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।

১২ ৩৩

রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নিকি বাঈয়ের নাচ দেখেছিলেন মিস ফানি পার্কস। ১৮২৩ সালে। সে সময়ের প্রসিদ্ধ গায়িকা ছিলেন হীরা বুলবুল। এঁদের মধ্যে রেষারেষিরও উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন বইয়ে।

১৩ ৩৩

বাঈজি নিয়ে তাঁর স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন অবনীন্দ্রনাথ। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-বইতে।

১৪ ৩৩

অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘...তখন আমি দস্তুরমতো গানের চর্চা করি। কোথায় কে গাইয়ে বাজিয়ে এল সব খবর আসে আমার কাছে। কাশী থেকে এক বাইজি এসেছে, নাম সরস্বতী, চমৎকার গায়। শুনতে হবে। এক রাত্তিরে ছ’শো টাকা নেবে। শ্যামসুন্দরকে পাঠালুম, ‘যাও দেখো কত কমে রাজি করাতে পারো।’ শ্যামসুন্দর গিয়ে অনেক বলে কয়ে তিনশো টাকায় রাজি করালে।’’

১৫ ৩৩

শোনা যায়, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথও অবন ঠাকুরের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন— “অবনদা, করেছ কী! তিনশো টাকা জলে দিলে?”

১৬ ৩৩

শুধু তা-ই নয়, দু’বোতল ব্র্যান্ডিও দাবি করেন সরস্বতী। কারণ, ব্র্যান্ডি না খেলে তিনি নাকি গাইতেই পারেন না! অবনীন্দ্রনাথ তাতেও রাজি হয়ে যান।

১৭ ৩৩

সরস্বতী গান শুরু করেন রাত ১০টায়। একটা গানেই ১১টা বেজে যায়। অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন, “এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন।’’

১৮ ৩৩

সরস্বতীবাঈ বললেন, ‘‘আর কী গান শোনাব?” তাঁকে একটি ভজন গাইতে বললেন অবন ঠাকুর। সরস্বতী গেয়েছিলেন ‘আও তো ব্রজচন্দলাল।’

১৯ ৩৩

সুরে আবিষ্ট অবনীন্দ্রনাথ তড়িঘড়ি একটি ছবি এঁকে রাখলেন তাঁর। অতঃপর, রাত পেরিয়ে সকাল হল। বাঈ উঠে পড়লেন। অবনীন্দ্রনাথ মনে করলেন, দু’খানা গানের জন্য তিনশো টাকা দেওয়া সার্থক।

২০ ৩৩

বাঈজিসঙ্গীত শুনেছিলেন বিবেকানন্দও। বিবেকানন্দ তখন গিয়েছেন খেতড়ীর রাজার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

২১ ৩৩

খেতড়ী রাজসভায় বসেছে মজলিশ। শেষ অনুষ্ঠান বাঈগান। এ সব জেনেশুনে বিবেকানন্দ সভা ছেড়ে বেরোতে চাইছেন।

২২ ৩৩

খেতড়ীর রাজা তখন বিবেকানন্দকে অনুরোধ করলেন আরও কিছু ক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্য...। সে সময় সুরদাসের ভজন শুনে বিবেকানন্দ ফিরে এলেন।

২৩ ৩৩

বাঈজি গান ধরলেন: ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিত্ না ধর। সমদরশি হ্যায় নাম তুমহারও, চাহে তো প্যার করো...।’

২৪ ৩৩

বাঈজি গাইছেন। চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন ‘বালক-বীর’। গান শেষ হতে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বিবেকানন্দের চোখের জলে জোয়ার লেগেছে।

২৫ ৩৩

এই ঘটনা বিবেকানন্দের জীবনে গভীর রেখাপাত করে। পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ যত বার খেতড়ী গিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘‘আমার মা-কে ডাকো। আমি ওর গান শুনব।’’

২৬ ৩৩

এই ঘটনার বহু বছর পরে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক সন্ন্যাসী পরবর্তী ঘটনার অনুসন্ধান করতে করতে রাজস্থানের খেতড়ী পৌঁছন। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সেই বাঈজির নাম ময়নাবাঈ।

২৭ ৩৩

এক প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, অসামান্যা সুন্দরী এবং সুগায়িকা ছিলেন ময়না। রাজস্থানের বহু রাজা তাঁর গান শোনার জন্য সে সময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই সে দিনের পর থেকে তাঁকে আর কেউ দেখতে পাননি।

২৮ ৩৩

মিশনের ওই সন্ন্যাসী অনুসন্ধান শুরু করেন। তার পর সেখান থেকে বহু দূরে রাজপুতানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পেয়েছিলেন সেই বাঈকে। তিনি তখন বৃদ্ধা। ছোট্ট কুটিরে থাকেন। একা। তাঁর সঙ্গে থাকেন তাঁর সারা জীবনের আরাধ্য দেবতা— গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। পটে আঁকা ছবির সামনে তিনি গান শোনান। পুজো করেন। নিজের সন্তানের মতো খাওয়ান। ঘুম পাড়ান...।

২৯ ৩৩

রামকৃষ্ণ মিশনের সেই সন্ন্যাসী ওই বাঈজির কাছে শোনেন তাঁর কথা। ময়নাবাঈ বলেছিলেন, “আমি সে দিন আমার জীবন্ত গোপালকে গান শুনিয়েছিলাম। সেই গান তার পর আর কাউকে শোনাইনি। আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি এই গ্রামে …। আমার দেবতাদের নিয়েই আমার জীবন কাটিয়ে দেবার জন্যে। আমি সাক্ষাৎ ভগবানকে দেখেছি, তিনি আমার গান শুনেছেন, আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে…।’’

৩০ ৩৩

বিবেকানন্দের প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নেয় এই ভজন। অনেক পরে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রামকৃষ্ণ মিশনের এক শীর্ষস্থানীয় মহারাজের অনুরোধে বিবেকানন্দের প্রিয় গানের একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। শিল্পী ছিলেন অজয় চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী।

৩১ ৩৩

এই ভজনটি চন্দনা গেয়েছিলেন ওই সঙ্কলনটিতে। যদিও গানটির ইতিহাস সেখানে বলা হয়নি।

৩২ ৩৩

বস্তুত, যৌনকর্মীদের নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল বিবেকানন্দের। রামকৃষ্ণানন্দ (শশী মহারাজ)কে ২৩ অগস্ট ১৮৯৬ সালে সুইৎজারল্যান্ডের লেক লুসান থেকে এক চিঠিতে বিবেকানন্দ লেখেন, ‘বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মতো মহাতীর্থে যেতে না পারে, তবে যাবে কোথায়? পাপীদের জন্য স্রষ্টার যত প্রকাশ, পূণ্যবানদের জন্য কিন্তু ততটা নয়। হ্যাঁ, ভেদাভেদ সংসারে আছে, থাকবে, থাকুক না। কিন্তু তীর্থতে ও যদি এ রকম ভেদাভেদ হয়, তবে তীর্থ আর নরকে ভেদ কী...?’

৩৩ ৩৩

তথ্য সূত্র: রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, নিউ এজ পাবলিসার্স, উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ, জোড়াসাঁকোর ধারে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, বেশ্যা সঙ্গীত বাঈজি সঙ্গীত, দেবজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবর্ণরেখা, লেটারস্‌ অব স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন, স্বামী বিবেকানন্দ এবং ধর্মের নতুন সংজ্ঞা, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, উদ্বোধন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২১, ২০১৬।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement