গানের জলসায়।
মান্না দের মতো সফল গায়ক আর নেই। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তবু সঙ্গীতের সেই মহাসমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে বার বার মনে হয়েছে, উপরে যতই শান্ত দেখাক, তার অতল গভীরে লুকিয়ে আছে কত বিষণ্ণতা, বেদনাবোধ। সেখানে তিনি একা, নিঃসঙ্গ।
১ মে প্রতি বছর মান্নাদাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হত। গানের মানুষদের কাছে এই দিন তো পুজোর দিন। মান্নাদার জন্ম এই দিনে। মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠান। মান্নাদা গাইবেন। ঠিক হল, এ বারে অনুষ্ঠানটা একটু অন্য রকম ভাবে হবে। আমি একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করে মান্নাদাকে দেখালাম। মান্নাদার গানের ঘরের আদলে তৈরি হবে স্টেজ। পর্দা উঠতে দেখা যাবে মান্নাদা রেওয়াজ করছেন। পাশে প্রভাস দে (অনুজ এবং সুরকার)। এমন সময় মান্নাদার সঙ্গে কাজ করা সব গীতিকার, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রীরা ঢুকবেন ফুলের তোড়া হাতে—‘মান্নাদা, জন্মদিনে কলকাতায় আছেন শুনে শুভেচ্ছা জানাতে এলাম।’ এর পরে তাঁদের সঙ্গে মান্নাদার জমাটি আড্ডা। সঙ্গে মান্নাদার গান। গানগুলোর মোটামুটি একটা সিলেকশন করে রাখা হয়েছিল—তার পরে পাবলিক রিকোয়েস্ট তো থাকবেই। কিছু হিন্দি গানও রেখেছিলাম। একজন সংগঠক মন্তব্য করেন—‘হিন্দি গানের সিলেকশন একদম ঠিক হয়নি। মান্নাদার হিন্দি রোম্যান্টিক গান তো বেশি রাখেনইনি।’ তার কথা শেষ না হতে মান্নাদা বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন—‘দেবপ্রসাদবাবু দুশো পার্সেন্ট কারেক্ট সিলেকশন করেছেন। কোথা থেকে রাখবেন বেশি গান? ক’জন সুরকার আমাকে নিয়ে হিন্দি রোম্যান্টিক গান গাইয়েছেন, এক শংকর-জয়কিষণ ছাড়া?’
মান্নাদা-র কথা শুনে নতুন করে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রফি-কিশোর-মুকেশ-তালাতের সেট মার্কেট থেকে যে ক’টি রোম্যান্টিক গান গাইবার সুযোগ পেয়েছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন সুরের জহরত-হিরে। প্যার হুয়া ইকরার হুয়া, ইয়ে রাত ভিগি ভিগি.....। অন্য শিল্পীদের গাওয়া যে কোনও গান মান্নাদা আরও ভালভাবে গাইতে পারতেন যদি সুযোগ মিলত, কিন্তু মান্নাদার গাওয়া কোনও গান, অন্য শিল্পীর কণ্ঠে ভাবা যায় না। দারুণ ভাবে তৈরি শিল্পী, সব থেকে বেশি ভালবাসতেন মিষ্টি রোম্যান্টিক গান গাইতে। কিন্তু সুযোগ বেশি পাননি। সেই দুঃখ আজীবন মান্নাদার বুকে পাথর হয়ে জমে ছিল।
মৃণাল সেনের সঙ্গে।
সহশিল্পীদের জন্য তাঁর ছিল অসীম শ্রদ্ধাবোধ। মহম্মদ রফিকে সব সময় গায়ক হিসেবে এক নম্বরে রেখেছেন। কিশোরকুমারের জনপ্রিয়তায় এক সময় রফির গান খুবই কমে আসে। রফি মন থেকে এই সিচুয়েশনটা কিছুতেই মানতে পারেননি। গুমরে গুমরে খুব অল্প বয়সেই চলে যান তিনি। মান্নাদা কিশোরকুমারের গানেরও খুব প্রশংসা করতেন। বলতেন তাঁর কণ্ঠ, সুরবোধ অসাধারণ। একদিন এ সব আলোচনা করতে করতে একটু গলা নামিয়ে মান্নাদা বললেন—‘কিশোর এত ভাল গায়, সবাই ওর গান এত ভালবাসে, খুব ভাল লাগে। কিন্তু এটাও সত্যি রফি-আমি-তালাত— আমাদের গানে একটা যে ‘হরকত’ ছিল, সেটা হিন্দি গান থেকে অনেক কমে গেল। মুকেশের গান নিয়ে মান্নাদার অন্য দুঃখ ছিল। সেই সময় অন্য শিল্পীদের তুলনায় মুকেশ ছিলেন অনেক কমজোরি। মান্নাদা বলতেন—বেশ তালকানা, খুব বেসুরো। কিন্তু ভাগ্যটা এমন সুপার কোয়ালিটির যে সব গান গাইবার সুযোগ পেয়েছে, আর রাজকপূরের অসাধারণ পিকচারাইজেশন—অনেক মাইলেজ দিয়েছে গানগুলোকে।’ বলার সাহস ছিল না। নিজেকে বলেছি—‘আপনার কৃতিত্ব অনেক বেশি মান্নাদা। নায়ক নয়, রোম্যান্টিক সিচুয়েশন নয়, অধিকাংশ গান-সহ অভিনেতাদের লিপে। শুধু আপনার গায়কিই সে-গানকে টেনে নিয়ে গেছে। একজন সাধারণ মানুষ যেমন আপনার গান ভালবাসে, মেহেদি হাসান-গোলাম আলির মতো ওস্তাদ শিল্পীরাও আপনার গানের ভক্ত।
মান্নাদা গানের রেকর্ড করে বেঙ্গালুরু ফিরে গিয়েছেন। ফোন করে খবর নিয়েছেন আমার লেখার। রেমুনারেশন পেয়েছি কিনা। বললাম—‘আপনার সঙ্গে কাজ করেছি এটাই তো সব থেকে বড় রেমুনারেশন’। এ কথা শুনে মান্নাদা খুব রেগে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন— ইয়োর অ্যাটিটিউড মাস্ট বি প্রফেশনাল। যখন তাঁর কাছে অ্যাকসেসটা একটু বাড়ে, সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—‘আপনার রেমুনারেশন পেয়েছেন?’ মান্নাদা ম্লান মুখে বললেন—‘ওদের দোষ নেই। বোধহয় ভুলে গিয়েছে।
কফি হাউসের সেই আড্ডায়।
জীবনের বেশির ভাগ সময় মান্নাদা কাটিয়েছেন মুম্বইতে। ১৯৪৩ সাল থেকে ২০০০ সাল। ৫৭ বছর। এক সময় সাধের বাড়ি ‘আনন্দন’ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বড় মেয়ে আমেরিকায়, ছোট মেয়ে বেঙ্গালুরুতে সেটেল্ড। মান্নাদা-বৌদির বয়সও হয়েছে। এত বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করাও খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক করলেন সেই বাড়ি বিক্রি করে বেঙ্গালুরুতে থাকবেন। অত সুন্দর লোকেশানে বাগানঘেরা ছবির মতো বাড়ি। আশেপাশে সব সেলিব্রিটিদের বাস। প্রচুর মানুষ কিনতে আসছে। এক ভদ্রলোক এসে বললেন—‘তিনি মান্নাদার গানের দারুণ ভক্ত। এ জন্য এই বাড়ি কিনে একই রকম ভাবে রেখে দিতে চান। একটা চাবি থাকবে মান্নাদার কাছে। যখন খুশি আসবেন, থাকবেন। কেয়ারটেকার ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকবে না মান্নাদার অবর্তমানে। মান্নাদা সেই ভদ্রলোককেই বাড়িটি বিক্রি করলেন। কিছুকাল পরে মান্নাদা এসেছেন মুম্বইতে অনুষ্ঠান করতে। কিছুটা সময় হাতে ছিল। ভাবলেন, এক বার বাড়িটা দেখে আসি। কত স্মৃতি জড়িয়ে। এক বার ভিতর থেকেও ঘুরে আসবেন। সেই গানের ঘর। একবার দেখবেন না? হাতের তালুর মতো চেনা জায়গা। কয়েক বার চক্কর মেরেও মান্না দে সেই সাধের ‘আনন্দন’ খুঁজে পেলেন না। বুঝলেন খানিকক্ষণ পরে—‘আজ যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়/যা দেখিতেছ না/তাহারই ভিড়—সেই বাড়ি ভেঙে রাতারাতি তৈরি হয়েছে এক বহুতল হাউজিং। ঘটনাটা বলতে বলতে মান্নাদার দু’চোখ বুজে আসে, চোখের কোল ছাপিয়ে জল—‘বাড়ি তো আমি বিক্রিই করতাম। কেন এ সব বলল আমায়?’
বড় দুঃখ ছিল দুই মেয়ের কেউ সে-ভাবে গান গাইলো না। ছোট মেয়েকে নিয়ে একটা চেষ্টা করেছিলেন। দু’জনে মিলে গেয়েছিলেন—‘বাবা-মেয়ের গান’—ব্যস ওই পর্যন্ত। বাচ্চাদের ভীষণ ভালবাসতেন—খুব আদর করতেন। মান্নাদার এমনই দুর্ভাগ্য তিনি আর দাদু হতে পারেননি।
সে দিনের সোনা ঝরা সন্ধায়। সন্ধা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
এক সহকর্মীর মৃত্যুতে বিকাশ রায়ের একটা প্রতিক্রিয়া মনে পড়ছে। বলেছিলেন—বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা একটা অভিশাপ। অনেক প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বইতে হয়। মান্নাদার জীবনে এ-কথা চরম সত্য। ১৯৬২ সালে পর পর মারা গেলেন প্রিয় ঠাকুরমা, চার দিন বাদে বাবা, তার ক’দিন বাদে তাঁর সঙ্গীতগুরু কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে।
১৯৮৫ সালে দুষ্কৃতীরা ভুল করে মান্নাদাকে ছুরিকাঘাত করে। অত্যন্ত মাতৃভক্ত মান্নাদার মা-ও চলে গেলেন এই বছরে।
শুধু শুনে গেছেন একে একে প্রায় সব প্রিয়জনের চলে যাওয়া। রফি-মুকেশ-কিশোর-তালাত-গীতা-হেমন্ত-নচিকেতা-সুধীন-অনিল-শচীনদেব-রাহুলদেব-মদনমোহন-সলিল-রাজকপূর—একে একে সবাই। সব শেষে প্রিয়তমা স্ত্রী। কলকাতায় সব থেকে প্রিয় বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন সেবাব্রত গুপ্ত, তিনিও চলে গেলেন। ও ভাবে পুলকবাবুর চলে যাওয়াও কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মান্নাদা।
এটা ঈশ্বরের বিধান। শিল্পীকে সুখী হতে নেই। তিনি মান্না দে হলেও।