বাঙালি বলতেই সবচেয়ে প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র কথা। সিনেমাটা তখন সবে রিলিজ করেছে। কলকাতার মেট্রো সিনেমা হল-এ চলছে। জনসঙ্ঘের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক উপলক্ষে আমরা কলকাতায় গিয়েছি। (তখনও বিজেপি তৈরি হয়নি)। মনে আছে, দিনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, আমি আর অটলবিহারী বাজপেয়ী দুজনে মিলে ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়েছিলাম।
ছবি দেখে তো আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। ভারতের সিনেমাও এ রকম হতে পারে? এত দূর আন্তর্জাতিক? সময়ের থেকে এতটা এগিয়ে? কই, আগে তো এমনটা কখনও কোথাও দেখিনি! আমার তো মনে হচ্ছিল, জীবনের একটা সেরা কাজ করে ফেললাম সিনেমাখানা দেখে ফেলে। সহস্র ভাবনা ভিড় করে এল, আর মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেও আরও কোটি গুণ বেড়ে গেল। কয়েক দিন রেশ থেকে গেল সিনেমার। ছোট্ট অপুর চোখ, দুর্গার প্রাণপ্রাচুর্য, সর্বজয়ার যন্ত্রণা, এই মেয়ে মারা যাবার কান্নাটা তারসানাইয়ের বাজনায় ঢেকে যাওয়া— সব বারেবারে মনে পড়ে যাচ্ছিল কাজের মধ্যে, বিশ্রামের সময়ে।
আমাদের তো কর্মসূত্রে কত জায়গায় যেতে হয়, সরেজমিনে কত নতুন জায়গা দেখতে হয়। কত মানুষ, তাদের কত দুঃখ-কষ্ট, তাদের মেঠো জীবন, তাদের মাটির ঘর-বা়ড়ি, জমি-জমা-খেত। সিনেমাটা দেখার পর এ সব আমাকে আরও বেশি করে ভাবাত। আর ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রটা আমাকে বড্ড ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমার এই দীর্ঘ জীবনে কত ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে যে মোলাকাত হল, ইয়ত্তা নেই। এই যে ঘরে থেকেও ঘরবিহীন একলা মানুষগুলো, এঁদের জন্য কাজ করে চলাই কারও জীবনের ম্যানিফেস্টো হতে পারে। আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে নিজের চারপাশেও আরও বেশি করে এমন অনেক ইন্দির ঠাকরুনের দেখা পাই। বয়সের যন্ত্রণা, একাকিত্বের বেদনা, স্মৃতির ভার আর আশপাশের সব রকমের মানুষের কঠিন অবহেলায় ন্যুব্জ এঁরা। দিনগুলো আদৌ বদলায়নি, না সত্যজিৎ অসাধারণ দূরদর্শী ছিলেন, জানি না।
সিনেমাগত ভাবে ‘পথের পাঁচালী’ অনেক নতুন নতুন রাস্তা দেখিয়েছিল। সিনেমায় তারকা থাকবেন, এমনটা তখন প্রায় ধরেই নেওয়া হত। কিন্তু সত্যজিৎ একেবারে আনকোরা অভিনেতাদের সুযোগ দিলেন। একমাত্র হরিহর ছাড়া বাকি মূল চরিত্রাভিনেতারা— অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, এমনকী বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুন— প্রত্যেকে পরদায় নতুন। তা সত্ত্বেও কী ত্রুটিবিহীন অভিনয় এঁদের! মনে হয় যেন চরিত্রগুলো এঁদের জন্যই বোনা হয়েছিল। আর মেক-আপ করা হয়েছে বলেও মনে হচ্ছিল না। কেউ ঘামলে তার মুখটা ক্লান্ত বলে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। এই যে বাস্তবের প্রতি সত্যজিতের মনোযোগ, সব কিছুর ওপরে বাস্তবকে মর্যাদা দেওয়া, এটা আমাকে ভীষণ টেনেছিল। মজা দিয়ে জীবনের দুঃখ ভোলাবার বদলে, তিনি জীবনকেই খুব দরদ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারকাকে দিয়ে সাধারণ মানুষের অভিনয় না করিয়ে, যেন সত্যিকারের সাধারণ মানুষকেই তিনি ডেকে বললেন, আসুন, আপনার রোজকার জীবনটা ক্যামেরার সামনে একটু মেলে ধরুন।
আর ছবির ওই থিম মিউজিক, ওঃ! ওটা যেন এক ক্লাসিকের জন্য আর এক ক্লাসিকের জন্ম! মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই বাজনাটা না থাকলে ছবিটা অমন মোহময় হয়ে উঠত কি? সত্যজিৎ আর রবিশংকরের যুগলবন্দিটা বোধহয় ঈশ্বরই তৈরি করে দিয়েছিলেন। থিম মিউজিকটা পরে আমি মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। ওটা একলা বসে গুনগুন করে গাইবার চেষ্টা করলেও চোখে জল এসে যায়। কী করে ওইটুকু একটা মিউজিক পিসের মধ্যে এতখানি বিষাদ আর মনকেমন ভরে দেওয়া যায়, কে জানে।
এখনও ‘পথের পাঁচালী’ আমাকে আন্দোলিত করে। আমি তো সাংবাদিক হিসেবে জীবনের শুরুতে সিনেমার রিভিউ করতাম। সিনেমা দেখা-শোনা ও বোঝার কাজটা তাই একটু পেশাদার ভাবেই করতে হত। দর্শকের মুগ্ধতাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে, সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেও, আমি এখনও বিশ্বাস করি, ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটা কেউ যদি গভীর মনোযোগে দেখে, তবে বাঙালি মননকে বুঝতে খুব সুবিধা হয়। না, শুধু গ্রামীণ বাংলা নয়। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে বাঙালি জাতির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ নানা ভাবে সেখানে প্রকাশিত।
এর পর ’৭৭ সালে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী হয়ে আমার সঙ্গে আর এক দিকপাল বাঙালি পরিচালক মৃণাল সেনেরও আলাপ হয়। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য মিঠুন ও মমতাশংকরের সঙ্গে একসঙ্গে মস্কো গিয়েছিলাম। অনেকটা জানার সুযোগ হয়েছিল ওঁদের। এখন কিন্তু দিব্যি বুঝতে পারি শুধু চলচ্চিত্র নয়, বাঙালি মানে আমার কাছে সংস্কৃতি। বাঙালি মানে উনিশ শতকের নবজাগরণ। বাঙালি মানে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ।