ধাতুর খোঁজে

সামনেই ধনতেরাস। সমৃদ্ধি কামনায় সোনা কেনার দিন। সাধ্যে একান্তই না-কুলোলে অন্তত রুপো। তাই তার আগে সে সম্পর্কে খবর নিন। জানুন হিরে-প্ল্যাটিনামের আখ্যানও। অমিতাভ গুহ সরকারসোনার প্রতি আমাদের আকর্ষণ আজকের নয়। অনেক পুরনো। রামায়ণের কথাই মনে করুন। সীতার নজর টানতে কী সাজতে হয়েছিল রাবণকে? সোনার হরিণ। আর তাতে মন মজেওছিল সীতার। লক্ষ্মণকে ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ বলে বায়না জুড়েছিলেন তিনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৮
Share:

সোনার প্রতি আমাদের আকর্ষণ আজকের নয়। অনেক পুরনো। রামায়ণের কথাই মনে করুন। সীতার নজর টানতে কী সাজতে হয়েছিল রাবণকে? সোনার হরিণ। আর তাতে মন মজেওছিল সীতার। লক্ষ্মণকে ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ বলে বায়না জুড়েছিলেন তিনি।

Advertisement

নজরকাড়া ওই ধাতুর প্রতি আমাদের এই আকর্ষণ এখনও অটুট। নইলে আজও তা কারও আর্থিক অবস্থান আর সামাজিক প্রতিপত্তির অমোঘ বিজ্ঞাপন কেন? কেনই বা ধনতেরাসের রাতে তা কিনতে প্রতি বছর অমন বেমক্কা ভিড়? আসলে সোনা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত দুর্বলতা আছে আমাদের। বিশেষত বাঙালিদের। আমরা ভাবি, এ এমনই জাদু ধাতু, যাতে প্রেয়সীর মুখে হাসি ফোটে। উপহারে খুশি হয় স্ত্রী। আবার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের অস্ত্র হিসেবেও তা তুলনাহীন। অর্থনীতির উপর শত ঝড়ঝাপ্টাতেও এর দাম পড়ে না। হঠাত্‌ বিপদে পড়লে, সোনা যে কোনও দিন অন্তত আর্থিক ভাবে উতরে দেবে আমাদের।

শুধু সোনা নয়। গয়না এবং সঞ্চয়ের ধাতু হিসেবে যথেষ্ট কদর রয়েছে রুপোরও। দাম বাড়ার গতির বিচারে তা অনেক সময় পিছনে ফেলে দেয় সোনাকে। পরের পাতার সারণি দেখুন, ১৯৮১ সালে কেউ যদি ২,৭১৫ টাকা রুপোয় লগ্নি করতেন, তা হলে আজ তা বেড়ে দাঁড়াত প্রায় ৩৯ হাজার টাকা। সেখানে ওই একই সময়ে সোনায় ১,৬৭০ টাকা ঢাললে, এখন পাওয়া যেত কম-বেশি ২৬ হাজার টাকা!

Advertisement

হালে ‘গোকুলে বাড়ছে’ আর এক ধাতু প্ল্যাটিনামও। আকাশছোঁয়া দর আর তুলনায় ছোট বাজারের কারণে এখনও এর জনপ্রিয়তা সোনার ধারেকাছে পৌঁছয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়ছে এই ধাতুরও।

লক্ষ্মীপুজো সবে গিয়েছে। সামনেই ধনতেরাস। তাই চলুন, আজ না হয় এই সমস্ত দামি ধাতু নিয়েই আলোচনায় বসি। সঙ্গে রাখি হিরেকেও। দেখে নিই এখন এগুলি কেনা কতটা যুক্তিযুক্ত। কিংবা পরে বিক্রি করতে গেলে, তার ঠিকঠাক দর পাওয়া যাবে কি না।

সোনায় সোহাগা

ধনতেরাসে কোনও না-কোনও ধাতু কেনাকে শুভ বলে মনে করেন অনেকে। বিশেষত ভারতের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই প্রথা দীর্ঘ দিনের। স্বাভাবিক ভাবে সোনাই এ ক্ষেত্রে পয়লা নম্বর পছন্দ। তবে যাঁদের সামর্থ্য তুলনায় কম, তাঁদের অনেককেই রুপো কিনতে দেখা যায়। এমনকী স্টেনলেস স্টিলের বাসনও কেনেন অনেকে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শুধু ধনতেরাসের দিনই সোনার খোঁজ করি আমরা। এই ধাতুর চাহিদা বছরভর। বিশেষত বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-উত্‌সবের মরসুমে। কিন্তু সব সময়ে নগদে সোনা কেনা শক্ত। তাই গত কয়েক বছরে সাধারণ মধ্যবিত্তদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কিস্তিতে সোনা কেনা।

দোকানে কিস্তি বন্ধ

এ নিয়ে আগেও আলোচনা করেছি আমরা। কিন্তু ধনতেরাসের কথা যখন বলা হল, তখন এই বিষয়টি নিয়ে কথা শুরুতেই সেরে ফেলা ভাল। বড় ব্র্যান্ডেড শোরুম থেকে শুরু করে পাড়ার দোকান— সবখানেই মাসিক কিস্তিতে সোনা কেনার রমরমা। প্রধানত দু’ভাবে কিস্তিতে সোনা কেনার রেওয়াজ আছে—

আপনি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিলেন। সেই সঙ্গে এক বা দু’মাসের কিস্তি আপনার হয়ে দিয়ে দিল দোকানদারই। বছরের শেষে মোট যত টাকা জমল, তা দিয়ে সোনার গয়না কিনলেন আপনি। তার মানে ধরুন, প্রতি মাসে ২,০০০ টাকা করে ১১ মাস জমা দিলেন কেউ। আর শেষ মাসে তাঁর হয়ে ২,০০০ দিল সোনার দোকান। সে ক্ষেত্রে বছরের শেষে ২৪ হাজার টাকার সোনার গয়না প্রাপ্য হবে তাঁর।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও প্রতি মাসে টাকা জমা দিতে হবে আপনাকে। কিন্তু দোকানের কাছে তা আর টাকা হিসেবে জমা থাকবে না। বরং প্রতি মাসে ওই টাকা দিয়ে তারা সোনা কিনে রাখবে আপনার জন্য। মানে ধরুন, কোনও মাসে আপনি প্রকল্প চালুর সময় ৫,০০০ টাকা দিলেন। যখন প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দর হয়তো ২৭,৭৭৭ টাকা। তার মানে ওই মাসে আপনার নামে ১.৮ গ্রাম সোনা কিনে রাখবে দোকানটি। এ ভাবে ১২ মাসে যা জমবে, তা দিয়ে গয়না গড়াতে পারবেন।

কিন্তু এখন এই ধরনের প্রকল্প ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলছে অনেক দোকানই। বিশেষত ব্র্যান্ডেড শোরুমগুলি। কারণ, গত ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রকল্পগুলি সবই পড়বে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রেহর আওতায়। ফলে তার উপর ১২.৫ শতাংশের বেশি রিটার্ন দেওয়া চলবে না। টাকা সংগ্রহও করা যাবে না সংস্থার নিট সম্পদের এক চতুর্থাংশের বেশি। ফলে এই ধরনের অনেক প্রকল্পই এখন ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার পথে।

কিছু বিপণি নতুন করে তা চালু করার চেষ্টা করছে ঠিকই। কিন্তু আগের তুলনায় অনেকটাই আকর্ষণ হারিয়েছে কিস্তিতে সোনা কেনার এই প্রকল্প। অনেকেই ভাবছেন, নতুন নিয়ম মেনে রিটার্ন যদি ১২.৫ শতাংশের মধ্যেই হবে, তবে তার তুলনায় ভাল প্রকল্প তো বাজারে অনেকই রয়েছে। ফলে এ বার ধনতেরাসে এই স্বর্ণ-সঞ্চয় প্রকল্পের রমরমা কিছুটা কম হওয়ারই সম্ভাবনা।

সোনায় মাধ্যাকর্ষণ

কিস্তিতে কেনা কিছুটা কমেছে বলে কি সোনা কেনাই কমে যাবে? আলবাত না। আসলে দীর্ঘ মেয়াদে সোনাকে মানুষ উঠতেই দেখেছে। পড়তে সে ভাবে দেখেনি। যে-কারণে তাকে সব সময়েই অনেকখানি ঝুঁকিহীন মনে হয়েছে।

শুরুতে সোনা কেনা হত মূলত গয়না গড়ার জন্য। লগ্নি হিসেবে তা কেনার চল ছিল কম। কিন্তু পরে এক সময়ে সোনার দর নাগাড়ে বাড়তে থাকায় লগ্নির জায়গা হিসেবেও তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বাড়তে থাকল সোনায় লগ্নি।

ফলে সেই বাড়তি চাহিদা মেটাতে সোনার কয়েন বা মুদ্রা বিক্রি করতে নেমে পড়ল অনেক ব্যাঙ্ক। এল কাগুজে সোনা। মিউচুয়াল ফান্ডের অধীনে চালু হল গোল্ড ফান্ড। ক্রমশ বেশ জনপ্রিয় হল গোল্ড ইটিএফ-ও।

কিন্তু লগ্নি হিসেবে সোনার এই উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তাই তার দাম পড়ারও কারণ হল। কারণ, লগ্নির উদ্দেশ্যই তো পরে দাম বাড়লে তা বিক্রি করে লাভ ঘরে তোলা। কিন্তু একসঙ্গে অনেকে বিক্রি করতে গেলে দরে পতনের প্রবল সম্ভাবনা। আর সম্ভবত এই কারণেই এখন বড়সড় উত্থানের পর সোনাকে আমরা পড়তেও দেখি।

ভেবে দেখুন, ২০১২ সালের এক সময়ে যে সোনা (২২ ক্যারাট) ৩২,০০০ টাকার (১০ গ্রাম) কাছাকাছি ছিল, তা এখন নেমে এসেছে ২৬,০০০-এর আশেপাশে। দাম কমেছে প্রায় ২০%। সুতরাং সোনার দামে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না, এ কথা আর হলফ করে বলা যাবে না। সব মিলিয়ে, সোনার দাম এতটা কমায় এখন কিছুটা হলেও সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে মানুষের মনে। অনেকেই ভাবছেন, সোনা কিনে পরে লোকসান হবে না তো? স্বর্ণকারদের অবশ্য আশা, উত্‌সবের মরসুমে সোনার চাহিদা আবার বাড়বে।

কমার কারণ

হালফিলে যে ভারতের মতো সোনাপাগল দেশেও তার চাহিদা ও দাম কিছুটা কমেছে, তার বেশ কতগুলি কারণ রয়েছে। যেমন—

বিশ্ব বাজারে সোনার দাম ক্রমাগত কমে চলা।

শেয়ার বাজারের উত্থান। বাজার তেজী হয়ে ওঠায় সোনা থেকে লগ্নি সরিয়ে সেখানে টাকা ঢালছেন অনেক বিনিয়োগকারীই।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

অনিশ্চয়তা, আর্থিক সঙ্কট এবং শেয়ার বাজারের দুর্দিনে সাধারণত সোনার দাম বাড়ে। সেই কারণে বিশ্বজোড়া মন্দার কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তা প্রায় লাগাতার বেড়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্কট এখন ফিকে হয়েছে মার্কিন মুলুক-সহ অনেক দেশেই। ফলে সোনা ছেড়ে মানুষ ঝুঁকছেন অন্যান্য সম্পদের দিকে।

চিনে কমছে সোনার চাহিদা।

ভারতের আধুনিক মহিলারা সোনার মোটা সাবেকি গয়না ছেড়ে ঝুঁকছেন হালকা সূক্ষ্ম গয়নার দিকে। অনেক কর্মরত মহিলা আবার ফ্যাশন সচেতন ভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন রুপো, হিরে এবং প্ল্যাটিনামের তৈরি গয়নাকে।

কোনও কোনও অঞ্চলে এ বার কম বৃষ্টিপাতও সোনার চাহিদা কমার অন্যতম কারণ।

তা হলে ভবিষ্যত্‌?

আপাতত স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদে বিশ্ব বাজারে সোনার ভবিষ্যত্‌ তেমন উজ্জ্বল নয়। যদি না হঠাত্‌ যুদ্ধ বাঁধে কিংবা হুড়মুড়িয়ে ধস নামে অর্থনীতিতে। কারণ, মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় আগামী দিনে সুদ বাড়তে পারে সেখানে। সে ক্ষেত্রে ডলারের চাহিদা বাড়বে। ফলে আরও কমতে পারে সোনার দাম।

সোনার বড় ব্যবহারকারী চিনে কমছে তার চাহিদা। ভারতেও এখনও বহাল সোনা আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ। তাই সব মিলিয়ে ছবি সুবিধার নয়। বিশ্ব বাজারে সোনার দাম এখন ঘোরাফেরা করছে প্রতি ট্রয় আউন্স ১,২০০ ডলারের আশপাশে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের ধারণা, আগামী দিনে বিশ্ব বাজারে সোনার দর নেমে আসতে পারে ১,০৫০ ডলারে। ভারতে ততটা না-পড়লেও, কিছুটা প্রভাব তো দেখা যাবেই। বিশেষত আমদানির শর্ত শিথিল হলে দাম আরও পড়তে পারে। যদি না একই সঙ্গে ডলারের দামও বেড়ে যায়।

যদি তবুও কিনি?

কিন্তু মনে করুন এ সব সত্ত্বেও সোনা কিনবেন বলে মনস্থ করলেন। দীর্ঘ মেয়াদে তার ফসল ঘরে তুলবেন বলে। সে ক্ষেত্রেও অন্তত দু’টি জিনিস মাথায় রাখা জরুরি বলে আমার বিশ্বাস—

(১) দামের ফারাক

অনেক সময়ে দেখবেন, এক দোকানে গয়না হয়তো তেমন পছন্দ হল না। গেলেন পাশের দোকানে। এবং কী আশ্চর্য! মাত্র ৫ মিনিটের ফারাকে সেখানে দাম আলাদা! একই ওজনের গয়নায় দামের তফাত অনেকটাই। কেন? এর বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন:

কোনও স্বর্ণকারের হয়তো সস্তার বাজারে বেশ কিছুটা সোনা কেনা আছে। তাই প্রতিযোগিতার বাজারে কিছুটা ছাড় দিচ্ছেন তিনি।

বড় ব্র্যান্ডেড দোকানে দাম একটু বেশি হতে পারে।

মজুরির তারতম্যেও দামে কিছুটা পার্থক্য হতে পারে। যেমন, উত্‌সবের মরসুমে মজুরিতে (বানি) অনেক সময়ে ছাড় দেওয়া হয়। নামী নির্মাতাদের মজুরি সাধারণত হয় একটু বেশি। বর্তমানে প্রচলিত মজুরি গ্রাম প্রতি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সোনার দামের শতাংশের হিসেবেও মজুরি ধার্য হয় অনেক বিপণিতে।

সোনার বিশুদ্ধতাও দামের ফারাকের কারণ হতে পারে। পাকা সোনার (২৪ ক্যারাট) বিশুদ্ধতা ৯৯.৯%। কিন্তু এতে কয়েন হয়, গয়না হয় না। প্রচলিত গয়নার সোনার বিশুদ্ধতা ৯১.৬% (২২ ক্যারাট)। হিরের গয়নায় যে-সোনা ব্যবহার করা হয়, তার বিশুদ্ধতা ৭৫% (১৮ ক্যারাট)। ১৪ ক্যারাটের সোনাতেও গয়না বানানো হয়। এই বিশুদ্ধতা অনুযায়ী হেরফের হতে পারে গয়নার দামে।

শেয়ারের মতো প্রতিনিয়ত সোনার দামও ওঠানামা করে।

সুতরাং বাজার যাচাই করে তবেই সোনা কিনুন।

(২) খাদ কতটা

সোনার বাজারে ঢুঁ মেরে দেখুন। যদি গয়না ভাঙিয়ে নতুন গড়াতে চান, তা হলে আপনি প্রায় সর্বত্র স্বাগত। কিন্তু যদি গয়নার সোনা বেচে নগদ টাকা হাতে চান, তা হলে কিন্তু খুব কম দোকানই সেই সুযোগ দেবে।

শুধু তা-ই নয়। যে বালা জোড়া বেচে আপনি বিপুল লাভের প্রত্যাশা করছিলেন, প্রথমেই বাদ যাবে তার মজুরির টাকা। এর উপর রয়েছে খাদ বাদ যাওয়ার ঝক্কি। এবং মনে রাখবেন, কোন গয়নায় কতটা খাদ আছে, তা আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে চট করে বোঝা শক্ত। তাই সে ক্ষেত্রে আপনাকে নির্ভর করতে হচ্ছে মূলত স্যাকরার সততার উপর। হলমার্ক চালু হওয়ার আগে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গড়াতে গিয়ে চমকে যেতেন অনেকে। অথচ সোনা যখন ৩০-৩২ হাজারের নীচে নামছে না, তখন তা করতে বাধ্যও হতেন তাঁরা।

তাঁদের অসহায় ভাবে দেখতে হত যে, খাদ বাবদ বাদ যাচ্ছে ৩০-৪০ শতাংশ।

তাহলে কি বাবা-ঠাকুর্দারা ভেজাল সোনা কিনেছিলেন? তা-ও তো নয়। দেখবেন দু’টি বালা দু’দোকানে বিক্রি করে একটিতে হয়তো বাদ গেল ৩৫%। অথচ অন্যটিতে ২০%। তাই সোনা ভেঙে সন্তুষ্ট হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। আমার মতে, বিক্রির আগে সোনার বিশুদ্ধতা কোনও ল্যাবে পরীক্ষা করে নেওয়া ভাল। বউবাজারে কোনও কোনও স্বর্ণকার অল্প সময়ের মধ্যে এই পরীক্ষার ব্যবস্থা করেও দেন।

হলমার্কযুক্ত সোনা হলে অবশ্য সমস্যা কম। গয়নার মধ্যেই তার বিশুদ্ধতার ছাপ থাকে। সোনা হলমার্ক হলে এবং যে-দোকান থেকে কেনা হয়েছে সেখানেই বিক্রি করলে, লোকসান কম হয়। তবে তার জন্য রসিদ যত্ন করে রাখতে ভুলবেন না।

নতুন ঘোড়া প্ল্যাটিনাম

অনেকে বলেন, ‘জাতে উঠতে গেলে’ এখন সোনার পাশাপাশি দু’একটি প্ল্যাটিনামের সেট নাকি না-থাকলেই নয়। দামের দিক থেকে বছর কয়েক আগে সোনার তুলনায় প্ল্যাটিনাম অনেকটাই উপরে ছিল। বলা চলে, ছিল কার্যত সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তা ছাড়া, মানুষ তেমন জানতেনও না এই সাদা ধাতু সম্পর্কে।

কিন্তু ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দায় প্ল্যাটিনামের দর কিছুটা পড়ে যায়। অন্য দিকে, অনিশ্চয়তার দুনিয়ায় দাম তুঙ্গে ওঠে সোনার। ফলে সোনার সঙ্গে প্ল্যাটিনামের দামের ফারাক অনেকটাই কমেছিল। আর তখন থেকেই মানুষের নজর কাড়ে প্ল্যাটিনাম।

সোনার বদলে প্ল্যাটিনামের আংটি এবং লাভ ব্যান্ডের প্রচলন এখন দ্রুত বাড়ছে। সোনার তুলনায় এর ঘনত্ব বেশি। তাই প্ল্যাটিনামের গয়নায় ধাতু বেশি লাগে। ফলে সোনার তুলনায় বেশি পড়ে তার দামও। কয়েন ও বার হিসেবে প্ল্যাটিনাম পাওয়া গেলেও, এখনও তার তেমন প্রচলন হয়নি।

প্ল্যাটিনামের রং সাদা। তবে দেখতে কিছুটা একই রকম হলেও, সাদা সোনা বা হোয়াইট গোল্ড কিন্তু প্ল্যাটিনাম নয়। ১৪ ক্যারাট সোনায় (বিশুদ্ধতা ৫৮.৫%) খাদ মিশিয়ে এবং রেডিয়াম প্লেটিং করে সাদা সোনা বানানো হয়। বহু ব্যবহারে এই সাদা ভাব উঠে গিয়ে হলদেটে হওয়ার ভয় থাকে।

সোনার মতো প্ল্যাটিনামের উপরও নকশা করা সম্ভব। ওজনে ভারী হলেও, ১৪ ক্যারাট সোনার তুলনায় প্ল্যাটিনাম কিছুটা নরম ধাতু। ফলে আঁচড় পড়ার ভয় থাকে। অন্য দিকে, বহু ব্যবহারে সোনা ক্ষয় পেতে পারে। ওজন কমতে পারে। যা প্ল্যাটিনামের তেমন হয় না।

প্ল্যাটিনাম কিনতে হলে, নামী দোকান থেকে কেনাই ভাল। এবং অবশ্যই সংগ্রহ করুন তার বিশুদ্ধতার সার্টিফিকেট। সুতরাং বাজেটে কুলোলে এ বার ধনতেরাসে প্ল্যাটিনাম নয় কেন?

আর হ্যাঁ, যাঁরা সোনার দামে প্ল্যাটিনামের স্বাদ চান, তাঁরা ঝুঁকতে পারেন প্ল্যাটিনামের মতো দেখতে প্রাকৃতিক ভাবে আর এক সাদা ধাতু প্যালাডিয়ামের প্রতি। এর দাম প্ল্যাটিনামের তুলনায় কম। তবে সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো।

হিরের টুকরো

শুধু সোনায় আবার আজকাল অনেকের মন ভরে না। সঙ্গে চাই এক টুকরো হিরেও। আগে অবশ্য হিরে চাওয়ার সাহস খুব বেশি মানুষ করতে পারতেন না। তা জ্বলজ্বল করত রাজা-বাদশার মুকুটে। দামের কারণে তা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে অধরা।

কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। এক দিকে, মানুষের আয় বেড়েছে। অন্য দিকে, এক শ্রেণির হিরের দামও নেমে এসেছে নাগালের মধ্যে। ফলে এখন হিরে কেনার ‘স্পর্ধা’ দেখাচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

বাজারে রয়েছে বেশ কয়েকটি সংস্থার ব্র্যান্ডেড হিরে। বলিউড তারকাদের দিয়ে যার বিজ্ঞাপন চলছে জোরকদমে। কিন্তু হিরে কেনা সহজ নয়। সঠিক হিরে কিনলাম কি না এবং তার জন্য সঠিক দাম দিলাম কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

হিরে কিনতে গেলে ক্যারাট, কাট এবং কালারএই তিনটি ‘ক’ খুব ভাল ভাবে দেখে নিতে হবে। নামী দোকানে ব্র্যান্ডেড হিরে কিনলে, দাম একটু বেশি পড়তে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ঠকার সম্ভাবনা কম।

তবে হলমার্ক যুক্ত হিরে পওয়া যায় না বলে, তা বিক্রিতে সমস্যা আছে। দামের ব্যাপারে নিশ্চয়তা নেই। তবে কেনার রসিদ যত্ন করে রেখে দিলে এবং যেখান থেকে কেনা হয়েছে সেখানেই বিক্রি করলে, ভাল দাম পেতে পারেন।

ছোট হিরের আংটি, দুল এবং পেনডেন্ট এখন আখছার বিক্রি হচ্ছে। হিরে কিনতে যেমন মোটা টাকা খরচ হয়, তেমনি যে-সোনার (১৮ ক্যারাট) উপর তা বসানো হয়, তার দর কিছুটা কম পড়ে। আসলে এই সোনা একটু কম উজ্জ্বল হওয়ায় হিরের দ্যুতি বেশি প্রকাশ পায়। মধ্যবিত্তরা অবশ্য এখনও হিরেকে গয়না হিসেবেই দেখেন। লগ্নি হিসেবে ধরেন না।

রুপোলি রেখা

আদর করে অনেকে সন্তানকে ‘সোনা’ ডাকেন। ছেলের গুণ একটু বেশি হলে, বলেন ‘হিরের টুকরো’। কিন্তু রুপো নিয়ে তেমন বিশেষণ কই?

তবে তা বলে আশার রুপোলি রেখা (সিলভারলাইন) কথাটি উপেক্ষা করার নয়। সোনা যখন তুঙ্গে, তখন সাধারণ মানুষকে কিছুটা ভরসা জোগায় রুপোই। অনেকে রুপোয় সোনার জল করে গয়না পরেন। তাতে রঙের অবশ্য কোনও ভরসা নেই। তবে আধুনিক মেয়েরা অনেকেই কিন্তু রুপোকে রুপোর রূপেই পরতে ভালবাসেন। তাই রুপোর গয়নার প্রচলন বাড়ছে দ্রুত।

সোনার দাম যখন ৩০-৩২ হাজারের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল, তখনই লগ্নির জায়গা হিসেবে আরও বেশি করে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে রুপো।

২০০১ সালের ৩১ মার্চ যেরুপোর দাম (কেজিতে) ছিল ৭,২১৫ টাকা, তা বছর দশেক বাদেই টপকে যায় ৬০ হাজারের গণ্ডি। ফলে অনেকে লগ্নি শুরু করেন সেখানে। অবশ্য কিছু দিন হল সোনার মতো রুপোর দরও বেশ খানিকটা নেমে এসেছে।

রুপো কয়েন, বিস্কুট এবং বার হিসেবেও পাওয়া যায়। অনেকে প্রতি বছর ধনতেরাসে সোনা না-হোক অন্তত একটি রৌপ্য মুদ্রা সংগ্রহ করেন।

রুপোর দাম সাময়িক পড়লেও পরে বাড়ার সম্ভাবনা আছে। অনেক শিল্পে (বিশেষত বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে) রুপো ব্যবহার বাড়ছে। গয়না, লগ্নির জায়গা হিসেবে এবং শিল্পে চাহিদা বাড়লে, ভবিষ্যতে রুপোর দর ফের বাড়বে বলে অনেকের আশা।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement