খবরের কাগজ হোক বা টিভির পর্দা। জীবনবিমার প্রায় সব বিজ্ঞাপনে তার দু’টি অমোঘ আবেদনের কথা থাকবেই। এক, গ্রাহকের মৃত্যুর পরেও তাঁর পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা। আর দুই, বিমার প্রিমিয়াম এবং মেয়াদ শেষে প্রাপ্য টাকায় করছাড়ের সুবিধা। প্রথমটি নিয়ে অবশ্যই কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু গত বছর কেন্দ্রের নতুন নীতি ঘোষণার পরে অনেক পলিসিই এখন করছাড়ের সুবিধার বাইরে।
করছাড়ের সুবিধাই উধাও?
না। প্রথমেই বিষয়টি খোলসা করে দেওয়া ভাল। মনে রাখবেন, এমনটা একেবারেই নয় যে, আগামী দিনে জীবনবিমায় করছাড়ের কোনও সুবিধা আর থাকবে না। বরং উল্টো। ওই সুবিধা মিলবে না নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। তাই আসুন, আজ আগে সেগুলিকে চিনে রাখি।
কীসে ছাড়, কীসে নয়?
জীবনবিমা পলিসির প্রিমিয়ামে আগে যেমন ৮০সি ধারায় করছাড় মিলত, এখনও তা পাওয়া যাবে। এই নিয়মে কোনও বদল হয়নি।
পলিসির মেয়াদপূর্তির পরে যে-টাকা হাতে আসে, ফারাক হবে সেখানে। আগে পলিসির মেয়াদ ফুরোলে, তা থেকে পাওয়া টাকাও থাকত পুরোপুরি করমুক্ত। কিন্তু নতুন নিয়মে সব ক্ষেত্রে তা আর থাকবে না। পলিসি কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না-করলে, কর গুনতে হবে ওই ‘ম্যাচিওরিটি ভ্যালু’র উপরে।
কর কতখানি?
যে-সমস্ত পলিসিতে ওই কর গুনতে হবে, সেখানে তার অঙ্ক খুব কম নয়।
গ্রাহকের প্যান কার্ড থাকলে, মেয়াদ শেষে হাতে পাওয়া টাকায় ২% টিডিএস (ট্যাক্স ডিডাক্টেড অ্যাট সোর্স বা উৎসে কর) দিতে হবে। তার মানে, ২০ বছরের মেয়াদ শেষে কেউ যদি ২৫ লক্ষ টাকা হাতে পান, তাহলে তাঁকে কর দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা।
আর প্যান নম্বর না-থাকলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে টিডিএস দিতে হবে ২০%।
আওতায় কোনগুলি?
• ২০০৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে কেনা যে-সমস্ত পলিসিতে বছরে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিমার অঙ্কের (কভারেজ) ২০ শতাংশের বেশি, সেগুলিই এই নয়া নিয়মে আয়করের আওতায় আসবে।
অর্থাৎ, ধরুন আপনার পলিসিতে বিমার অঙ্ক এক লক্ষ টাকা। সে ক্ষেত্রে বছরে প্রিমিয়াম যদি ২০ হাজার টাকা বা তার কম হয়, তাহলে মেয়াদ শেষের পরে প্রাপ্য পুরো টাকাই হাতে পাবেন। কোনও কর দিতে হবে না। কিন্তু প্রিমিয়ামের অঙ্ক ২০ হাজার পেরোলে, গুনতে হবে টিডিএস।
• যে-সমস্ত পলিসি ২০১২ সালের ১ এপ্রিলের পরে কেনা কিংবা আগামী দিনে কেনা হবে, সেগুলির ক্ষেত্রে নিয়ম অবশ্য আলাদা। ওই পলিসিগুলিতে বছরে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিমার অঙ্কের (সাম অ্যাসিওর্ড) ১০ শতাংশের বেশি হলেই তা করের আওতায় পড়বে।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে এক লক্ষ টাকা বিমার কোনও পলিসিতে বছরে ১০ হাজার বা তার কম প্রিমিয়াম দিলে, মেয়াদ শেষে কোনও কর লাগবে না। কিন্তু প্রিমিয়াম তার বেশি হলে, গুনতে হবে টিডিএস।
খেয়াল রাখুন...
অনেক সময়ে দেখবেন, পলিসিতে মূল বিমার অঙ্ক যা, গ্রাহকের মৃত্যুতে টাকার প্রতিশ্রুতি তার থেকে বেশি। মনে করুন, পলিসিতে বিমার মূল অঙ্ক (সাম অ্যাসিওর্ড) এক লক্ষ টাকা। কিন্তু পলিসি চলাকালীন তিনি মারা গেলে নমিনি পাবেন তিন লক্ষ। এই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম বিমার অঙ্কের ১০ বা ২০ শতাংশ কি না, তা হিসেব হবে ওই তিন লক্ষের উপর।
সু্যোগ কোথায়?
এতক্ষণ ১০ বা ২০ শতাংশের সীমারেখা নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। এ বার জেনে রাখা দরকার, কোথায়-কোথায় সেই সীমা লঙ্ঘন করেও আয়কর ছাড়ের সুবিধা পেতে পারেন আপনি।
সেই তালিকা মোটামুটি এ রকম—
• গোড়াতেই বলেছি, নতুন নিয়মে আয়কর দিতে হবে মেয়াদ শেষে টাকা হাতে পাওয়ার সময়ে। ফলে পলিসি চলাকালীন গ্রাহকের মৃত্যু হলে, নমিনি যে-টাকা পাবেন, তাতে কর কাটার প্রশ্ন নেই।
• পলিসি বন্ধক রেখে ধার নিলে, সেই ঋণের টাকার উপর কর দিতে হবে না। টিডিএস গুনতে হবে না তা ‘পেড-আপ’ (প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ) করে দিলেও। নির্ধারিত সময়ের আগে পলিসি সারেন্ডার করলে (প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করে টাকা তুলে নেওয়া) অবশ্য তা লাগবে।
• ২০০৩ সালের ১ এপ্রিলের আগে কেনা কোনও পলিসির ক্ষেত্রেই নতুন নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ, সেগুলিতে মেয়াদপূর্তির পরে পুরো টাকাই হাতে পাওয়া যাবে। তাতে বার্ষিক প্রিমিয়াম বিমার অঙ্কের যত শতাংশই হোক না কেন।
• কোনও বছরে এক বা একাধিক পলিসির মেয়াদ ফুরোলে যদি তা থেকে বোনাস-সহ মোট এক লক্ষ টাকার কম হাতে আসে, তবে কর দিতে হবে না সে ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ, হাতে আসা মোট টাকার পরিমাণ এক লক্ষ ছাড়ালে, তবেই কর দেওয়ার প্রশ্ন।
এ বার মনে করুন, আপনার তিনটি পলিসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে একই বছরে। যার একটিতে আপনি প্রিমিয়ামের ঊর্ধ্বসীমা (১০ বা ২০ শতাংশ) মেনেছেন। বাকি দু’টিতে মানা হয়নি। সে ক্ষেত্রে তাঁকে কর দিতে হবে কি না, তা নির্ধারিত হবে ‘নিয়ম-ভাঙা’ দুই পলিসির ভিত্তিতে। ওই দুই পলিসি থেকে পাওয়া টাকার অঙ্ক যদি এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়, তবে তাতে টিডিএস গুনতে হবে। নইলে তা থাকবে করমুক্ত।
চালু হল কখন?
জীবনবিমায় এই নয়া কর ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে। তবে মনে রাখবেন, এর জন্য পুরনো (ওই তারিখের আগের) পলিসির ক্ষেত্রে কোনও বকেয়া কর গুনতে হবে না কাউকে।
আর অ্যানুইটি?
অবসরের পরে পেনশন পেতে হালফিলে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে বিভিন্ন অ্যানুইটি প্রকল্প। এই প্রকল্প দু’ধরনের হতে পারে—
• ইমিডিয়েট অ্যানুইটি: এ ক্ষেত্রে আপনি প্রকল্প কেনেন হাতে থাকা থোক টাকায়। ফলে যেই তা কিনলেন, অমনি পরের মাস থেকে পেনশন চালু। সাধারণত অবসরের পরে পিএফ, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদির টাকা হাতে এলে, তা দিয়ে এই অ্যানুইটি কিনি আমরা।
এই অ্যানুইটিতে যে-টাকা আপনি প্রকল্পে লগ্নি করছেন, তা করমুক্ত। কিন্তু প্রকল্প থেকে যে- পেনশন পাবেন, তা অবশ্যই করের আওতায় আসবে।
• ডেফার্ড অ্যানুইটি: এই প্রকল্পে প্রথমে দীর্ঘ দিন ধরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে তহবিল তৈরি করতে হয়। পরে সেই তহবিলের টাকা থেকেই প্রতি মাসে পেনশন মেলে।
এই ধরনের অ্যানুইটিতে লগ্নি মানে আসলে সেই বিমাই কিনি আমরা। ফলে এ ক্ষেত্রেও তা করের আওতায় আসবে কি না, তা নির্ভর করছে এতক্ষণ আলোচনা করা নিয়ম অনুযায়ী। অর্থাৎ কর দিতে হবে কি না, তা বোঝার জন্য দেখতে হবে, বছরে প্রিমিয়ামের অঙ্ক ১০ বা ২০ শতাংশের ( যেখানে যেমন প্রযোজ্য) সীমা ছাড়াচ্ছে কি না।