প্রতীকী ছবি
ঘটনা ১ – এক একক নারী, তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরতা। আয় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু জমানো সম্পদের পরিমাণ বলতে গেলে শূন্য! লাইফস্টাইল বাড়াবাড়ি কিছু নয়, নেশা শুধুমাত্র আশেপাশের শিশুদের পড়াশোনায় উৎসাহদান এবং পোষ্য পালন। দুনিয়া উদ্ধার জীবনের মোক্ষ হয়ে উঠেছে নিজেরই অজান্তে, নিজের অবসর জীবনের ভার যে শুধুমাত্র নিজের, এটা কখনও মাথায় আসে নি!
ঘটনা ২ – অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন, মা দুরারোগ্য মানসিক রোগী, সম্পূর্ণ শুশ্রূষানির্ভর। রোগটি বংশগত। এই নারী দশহাতে সংসারের ভার, কর্মজীবনের ব্যস্ততা, এবং মায়ের সব দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজের মাথার বোঝা নিজের কাছেই অসহ্য বোধ হয়। মনে পড়ে – মানসিক চিকিৎসকের দেওয়া সাবধানবাণী – এখন থেকে অবসাদ দূরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে নিজের এমন হওয়ার সম্ভাবনা। যদি তিনি নিজে এমন সমস্যায় পড়েন, টাকাপয়সার ব্যবস্থা থাকলেও, দেখাশোনা? পরের প্রজন্মের ঘাড়ে চাপতে তিনি কোনওভাবেই রাজি নন।
ঘটনা ৩ – জীবনটা সাধারণ। একদিকে চাকরি, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। সংসার চালানোর আর্থিক দিক স্বামীই দেখছেন। অধ্যাপিকার জীবন, হাতে মাসের শেষে খারাপ টাকা আসে না। তবু, জমানো বা বিনিয়োগের ঘর শূন্য। শুধু তাই নয়, সব সময়েই হাতে টাকার টান। এদিক ওদিক ব্যক্তিগত ঋণ চলতে থাকে। বলতে গেলে যত্র আয়, তত্র ব্যয়। আর এসব ভাবতে গেলেই মাইগ্রেন। অন্যদের কথা বাদ, নিজেই নিজের কথা ভাবা ছেড়ে দিয়েছেন।
ঘটনা ৪ – একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত! স্বামী ছিলেন নামজাদা সাংবাদিক, বিষয় ছিল তাঁর – ব্যক্তিগত অর্থসম্পদ অর্থাৎ পার্সোনাল ফাইনান্স। কোনও আর্থিক উপদেষ্টার চেয়ে বেশিই জানতেন তো কম নয়। ব্যক্তিগত জীবনে দায়িত্বশীল এবং স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের প্রতি বিশেষ যত্নবান। বয়েস পঞ্চাশের কোঠায়, নিজের জীবনটাও গুছিয়ে নেবার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। এতটাই নিজের মাথায় রাখতেন যে স্ত্রী-কন্যাদের কখনও কোনও আর্থিক বিষয়ের চাপ বুঝতেই দেন নি। এমন ছাতাটা যেদিন হঠাৎ মাথার ওপর থেকে পড়ে গেল, তখন দুর্যোগ যে কী সেটা প্রথম ঝটকায় বুঝতেই পারেন নি তাঁর স্ত্রী!
আজকের লক্ষ্মী সরস্বতীদের জীবন নিয়ে চর্চা চলছে যখন, আর একটু পিছনে তাকানো যাক। টাকা পয়সা নিয়ে কবে ভেবেছে বাঙালি? ভাবলে ভেবেছেন মা-ঠাকুমার দল, যাঁরা মোবাইল ফোন এবং ব্যক্তিগত ঋণের জমানার আগে সংসার চালিয়েছেন। এঁরা শেখানোর চেষ্টা করেছেন – অপচয় কোরো না। কিন্তু পেরেস্ত্রৈকার পরে কে আর কার কথা শুনেছে! বিশ্বের দরজা খুলে যাওয়ার ভালোর দিকের সুযোগ নিয়ে এগিয়ে গেছে প্রজন্ম। কিন্তু পিছুটানও যে তৈরি হয়েছে, সেটা বুঝতেই সময় লেগে গেছে। বুঝেছেন আসলে কজন, বা কটি পরিবার, সেটাই প্রশ্ন।
পরিবার – অর্থাৎ মহিলারা। কারণ, তাঁরাই পরিবারের আর্থিক পরিকাঠামো সামলান। পুরুষ যতই রোজগার করুন, যেখানে যতই খাতির পান, এই এলাকায় কিন্তু একেবারে দিশাহারা। দেশের অর্থনীতির মূল কান্ডারী একজন নারী, দেশের বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রকের মাথার উপরে একজন নারী। প্রত্যেক সংসারেও আছেন এমনই একজন নারী, যিনি হাল ধরে থাকেন। কথা হচ্ছে, কিভাবে তৈরি হলে সেই হালটা ভালভাবে ধরা যায়?
এক – প্রত্যেক মাসে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি করে পরের মাসের টাকাটা জমবে, এটা ভাবা বন্ধ করুন। কারণ – ‘টুমরো নেভার কামস!’ এই চাকা চলতেই থাকবে, জমাতে হলে আজ এবং এখনই শুরু করুন।
দুই – শুধু জমাতে শুরু করলেই হবে না, জানতে হবে ভবিষ্যতের আর্থিক লক্ষ্যগুলো কী কী! তাদের প্রত্যেকের জন্য কত অর্থের প্রয়োজন, আজকের মূল্য অনুযায়ী। মুদ্রাস্ফীতি আছে এবং থাকবে, তাই দাম যে বাড়বে, এবং কতটা – তা বুঝে নিতে হবে। এই অঙ্ক স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও জানে। দরকারে তাদের সাহায্য নিলে লাভ দুতরফা। এখন থেকে তাদের আর্থিক সচেতনতা তৈরি হবে।
তিন – প্রত্যেক জমানো বা বিনিয়োগ যেন সঠিক লক্ষ্য ধরে হয়। বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা চাইল্ড পলিসি করে ফেলার আগে বুঝে নিতে হবে, ওই পলিসির রিটার্ন আদৌ যথেষ্ট কিনা এবং তা প্রয়োজনের সময়ে হাতে পাবেন কি না। তা না হলে নিতান্তই ভস্মে ঘি ঢেলে কাজের কাজ হবে না।
চার – ঋণ করতে হলে অঙ্কটা কষে নিতে হবে। কত সুদ গুনবেন, ঋণ করা টাকা অন্য খাতে লাগালে কত লাভ হতে পারে, এই জাতীয়। ক্রেডিট কার্ডে খরচ হলে সময়ে ফেরত দিতে হবে, ভুলে গেলে হিসেব উল্টে যাবে। ক্রেডিট কার্ডে ইএমআই করলে অঙ্কটা সম্পূর্ণ পালটে যাবে। মনে রাখবেন, উদ্দেশ্যহীন ব্যক্তিগত ঋণে সুদ সবচেয়ে বেশি। গৃহ ঋণ, শিক্ষা ঋণের অঙ্ক আলাদা।
পাঁচ – মাস এবং বছরের খরচ জেনে করতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে মিন্ত্রা-অ্যামাজন-ফ্লিপকার্ট সঠিক ওষুধ নয়। প্রয়োজনীয় জিনিস বুঝে কিনতে অনলাইন কেনাকাটার বিকল্প নেই, তাতে আজকের নারীর সময় এবং অর্থ দুইই বাঁচে। কিন্তু মনে রাখা ভাল, অপ্রয়োজনে বছরে দশটা শাড়ি কিনে একটাও পুরনো না হলে এরপর একটা আলমারি কেনা প্রয়োজন হতে পারে। তারপর সেই আলমারি রাখার জন্য একটা ফ্ল্যাট!
ছয় – আজকাল সবকিছু ড্রাইভে থাকে, বা মোবাইলে। এবার ডিজি লকার ব্যবহার করা আরম্ভ করুন। যে সব অতি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া উচিৎ এবং পরিবারের সকলের জানা থাকা কর্তব্য, তা ডিজি লকারে সহজে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। বিশেষ করে জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমা যেন পরিবারের নাগালে থাকে। শেষেরটি নিজের জীবনকালের মধ্যেই কাজে লাগবে, এবং পরিবার না জানলে কার্যকালে খুঁজে না পাওয়া যেতে পারে।
সাত – যিনি চাকরি করেন, তিনি জানেন যে একদিন অবসর এসে হাজির হবে। কিন্তু যিনি অন্য কিছু করেন, পেশাদার থেকে গৃহবধূ, তাঁরা সারাজীবন কি এই ভূমিকাতেই কাটাতে পারবেন? যখন পারবেন না, বা ভূমিকা থেকে ছুটি নিতে ইচ্ছে হবে, তখন জীবনটা কীভাবে কাটবে? খরচ কীভাবে চালাবেন, তার হিসেব করেছেন কী? জমানো টাকা বা সম্পদ থাকবে, ধরা গেল। কিন্তু কুড়ি বা পঁচিশ বছর মুদ্রাস্ফীতির ভার সামলে জীবনটা যদি ভালভাবে কাটাতে হয়, তবে কতটা অর্থসম্পদ যথেষ্ট, তার হিসেব জরুরী নয়?
আট – আয়কর বাঁচাতে বহুজন বিনিয়োগ করে থাকেন। আসল কথা হচ্ছে, দুটোই আলাদাভাবে প্রয়োজন। আয়কর এবং বিনিয়োগ। এই দুই বিষয়কে তাদের নিজস্ব গুরুত্ব দিন। এদের অস্তিত্ব যেন একে অন্যের সঙ্গে গুলিয়ে না যায়। কারণ কর পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা – দুজনের উদ্দেশ্য আলাদা, পদ্ধতিও ভিন্ন। আয়কর-ছাড় মানুষকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার একটা রাস্তা মাত্র। তবে বিনিয়োগের আসল অনুপ্রেরণা হওয়া উচিৎ জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া।
আশার কথা, ছবিটা পাল্টাচ্ছে। আজকের বহু মেয়ে ফাইনান্সকে পেশা করার কথা ভাবছেন। তিন দশক আগে যখন শেয়ারবাজারের বাড়িটাতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটত, সেখানে মহিলার সংখ্যা ছিল এক হাতের আঙ্গুলে গোনা। পরিচিত মহিলামহলে অনেকেই বুঝতেই পারতেন না, আমার কাজটা সমাজ-সংসারের কোন কর্মে লাগে! সেই চালচিত্রটা এখন নেই। এখন কেউ কেউ এক পা বাড়িয়ে জানতে চান ডেরিভেটিভস ট্রেডিং-এর কলাকৌশল!
মহিলাদের বেশির ভাগের ঝুঁকি নেওয়ার উপায় একটু বেশি থাকে, যদি তাঁর আয় সংসারের সরাসরি প্রয়োজনের পরিধির বাইরে হয়। তবে, মানসিক দিক থেকে খুব কম মহিলা ঝুঁকি পছন্দ করেন, বিশেষত বাঙালি মহিলারা। যে পারিবারিক পটভূমিকায় বাঙালি বড় হয়, তাতেই এমন মানসিকতা তৈরি হয়। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। যদি ঝুঁকি আপনার পছন্দের না হয়, তবে আপনার অর্থসম্পদ নিরাপদ পথেই বাড়ুক না! তার বহু পথ আছে। ডেরিভেটিভস ট্রেডিং না হয় না করলেন, তাতে তো পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
নারী যদি নিজের পথে নিজে এগোতে চান, তা আর্থিক হিসেবনিকেশ না বুঝে করা কখনও সম্ভব নয়। আত্মনির্ভরতার সূচনা কিন্তু এইখানেই।
বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাধান খুঁজতে সঞ্চয় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন পাঠান — takatalk2023@abpdigital.in এই ঠিকানায় বা হোয়াটস অ্যাপ করুন এই নম্বরে — ৮৫৮৩৮৫৮৫৫২আপনার আয়, খরচ এবং সঞ্চয় জানাতে ভুলবেন না। পরিচয় গোপন রাখতে চাইলে অবশ্যই জানান।