ধনতেরাসের মাত্র দু’দিন বাকি, তার আগে একটা ‘র্যাপিড ফায়ার’ পর্ব দিয়েই না-হয় আরম্ভ করা যাক।
প্রশ্ন ১: এমন একটা ধাতুর নাম করুন যার গয়না আজকের ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’?
প্রশ্ন ২: কোন ধাতুর গয়না একই সঙ্গে শাড়ি, কুর্তি, জিন্স, স্কার্ট, সালোয়ার— এথনিক, ইন্দো ওয়েস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন... সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে দারুণ মানানসই?
প্রশ্ন ৩: কোন ধাতুর তৈরি মুদ্রা ধনতেরাসে শুভ ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে কিনে থাকেন সাধারণ মানুষ?
প্রশ্ন ৪: বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞের বক্তব্য অনুযায়ী, কোন ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখার পরে তা বিক্রি করে যে অনুপাতে মুনাফা পাওয়া যায় তা অনেক সময় সোনার চেয়েও বেশি?
সব প্রশ্নের উত্তর একটাই। রুপো।
সবার জন্য
‘আকবর বাদশা’ থেকে ‘হরিপদ কেরানি’র মেয়ে, সকলেই রুপোর রূপে মজেছে। তাই বোধহয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা নৃত্যশিল্পী শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় অনায়াসে বলে ফেলেন, “আমি রুপোর গয়নাই পরি। অক্সিডাইজ্ড রুপো, ট্রাইবাল ডিজাইন আমার খুব পছন্দের।” ওদিকে তারকা-অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, “খু-উ-ব পছন্দ করি। রুপোর গয়না অনন্য-অপূর্ব-সুন্দর।”
আর সদ্য কিশোরী ছাপোষা ঘরের পাশের বাড়ির মেয়েটি পাড়ার দোকানে গিয়ে মুনস্টোন বসানো রুপোর আংটি দেখে মায়ের কাছে আব্দার করে, “ও মা, কিনে দা-ও-না।”
“রুপোর একটা সর্বজনীন আবেদন আছে। কুর্তি, শাড়ি, টপ, স্কার্ট, জিন্স সব কিছুর সঙ্গে মানানসই। আর যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে রুপোর গয়না পরা চলে। যেমন ধরুন বিয়ে উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান। আশীর্বাদ, সঙ্গীত, রিসেপশন...। এর মধ্যে এক দিন রুপোর সাজ চলতেই পারে,” বক্তব্য তরুণ উদ্যোগপতি ও অলংকার ডিজাইনার অনর্ঘ্য চৌধুরীর।
অন্নপ্রাশনে রুপোর থালা-বাটি-গ্লাস দিয়ে তো মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে রুপোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেই কবেই। আজও সাধারণ মানুষ শিশুকে পরিয়ে দেন নিদেনপক্ষে একটা রুপোর চেন, রুপোর মাদুলি বা রুপোর নূপুর। বিয়েতে রুপোর সিঁদুর কৌটো আজও সমান জনপ্রিয়। আর যুগ যুগ ধরে রুপোর গয়না তো আদিবাসী রমণীর অঙ্গের শোভা হয়ে বিরাজ করেছে। এই পরিচিত প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হচ্ছে কারণ রুপো আজ ছুঁয়ে ফেলেছে এক অন্য মার্গ। রুপো এখন সর্বত্রগামী।
“সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব স্তরের মেয়েরা এখন অনায়াসে রুপোর গয়না পরেন।” জানালেন ডিজাইনার অনন্যা চৌধুরী। “কোনও মেয়ে হয়তো দশ হাজার টাকা মূল্যের রুপোর বলহার বা কঙ্কণ কিনে নিয়ে গেল। আর পরমুহূর্তে কোনও মেয়ে চারশো/পাঁচশো টাকা দামের ফিরোজা/গার্নেট/মুনস্টোন বসানো ছোট্ট একটা রুপোর দুল কিনল।” ডিজাইনার কিরণ উত্তম ঘোষের বক্তব্য, “বিয়ে, বা যে কোনও নিমন্ত্রণে, কর্মক্ষেত্রে... রুপো সর্বক্ষেত্রেই চলে।”
স্টাইল স্টেটমেন্ট
ডিজাইনাররা জানাচ্ছেন তাঁদের খুব প্রিয় ধাতু রুপো। এথনিক ও আধুনিক নক্শায় সমৃদ্ধ হয়ে সমসাময়িকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপন মহিমায় উজ্জ্বল। মেয়েরা এখন ওয়েস্টার্ন, ইন্দো ওয়েস্টার্নের সঙ্গে গয়না পরছে। “আর এখানে সবচেয়ে মানানসই রুপোর গয়না”, বক্তব্য ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পলের।
তাঁর মন্তব্য, “রুপোর মধ্যে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার আছে। একটা আভিজাত্য, স্বাতন্ত্র্য।”
শহরের বিভিন্ন রুপোর বিপণিতে ঘুরতে ঘুরতে যে সব গয়না নজরে পড়ল তা নিঃসন্দেহে অগ্নিমিত্রার বক্তব্যকে সমর্থন করে।
একটা ভারী ‘অ্যান্টিক’ বালা। নক্শা ও রেজিপাকতারের মিশ্রণে গড়া বালা। যে মেয়ে পরবে তাকে আর কোনও গয়না পরতে হবে না। সেটা একটা ‘স্টেটমেন্ট পিস’ হয়ে যাবে। কিংবা কানে নকশাদার ঝুমকো। এথনিক পোশাক বা শাড়ির সঙ্গে।
অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরীরও রুপোর গয়না দারুণ পছন্দের। “রুপোর আলাদা গ্ল্যামার। একটা বয়স পর্যন্ত তো সকলকেই মানায়। আর তার পর নির্ভর করে কে কেমন করে ক্যারি করছে। তবে সব বয়সেই রুপোর মতো যাঁরা ঝকঝকে তাঁরা রুপো সবচেয়ে ভাল ক্যারি করতে পারেন।” মনে করেন গার্গী।
প্রাচীন ও আধুনিক নক্শার সমন্বয়ে ‘ফিউশন জুয়েলারি’-র তো কথাই নেই। কিশোরী বা উনিশ-কুড়ির ক্ষেত্রে তো রুপোর ছোটখাটো মোটিফ দুর্দান্ত। কালো ট্যাসেলে বল্গা হরিণ থেকে খুদে গণেশ থেকে রাশিচিহ্ন— দারুণ জনপ্রিয়। ডিজাইনার অভিষেক দত্তের মতে, “রুপোকে যেমন খুশি তেমন রূপ দিন। বিদেশি পোশাকের সঙ্গে ‘অক্সিডাইজ্ড, অ্যান্টিক’ ঘরানার গয়না। ঝকঝকে রুপো এথনিক পোশাকের সঙ্গে।” আর কিছু রঙে তো রুপো দারুণ খোলে। কালো, আইভরি, কালচে শেড, গোলাপি, প্রবাল-গোলাপি, ফিরোজা, ঘন সবুজ... মত ডিজাইনারদের।
চাঁদের আলো রঙা রুপো যেন অনেকটা জলের মতো। যেমন পাত্রে রাখবেন তেমন আকার নেবে। এই না-হলে কি আর হয়ে ওঠা যায় ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’!
জারদৌসি-বেনারসির সঙ্গেও
মধুবনী, ইক্কত, বোমকাই, কলমকারি শাড়ির সঙ্গে রুপোর গয়না? একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু জমকালো জারদৌসি বা বেনারসি বা ভারী জরির কাজের পোশাক বা শাড়ির সঙ্গে রুপোর গয়না? অবশ্যই পরা যাবে। শাড়ি নির্মাতারা অর্ধেক ভেলভেট, অর্ধেক নেট শাড়িতে বা লেহেঙ্গা স্টাইলের শাড়িতে এখন সাদা বা অফ-হোয়াইট নেট ব্যবহার করছেন। শাড়ির জমিতে সোনার রঙের বুনটের উপরে সাদা রঙের পাথরের সারি লাগানো হচ্ছে। জরি আর চকচকে নয়, ‘ম্যাট ফিনিশ’। রুপোলি রঙে সোনার রঙের ‘টাচ’ দেওয়া হচ্ছে। সোনালি-রুপোলি, দু’টোর মাঝামাঝি একটা এফেক্ট আসছে। “অনায়াসে সোনার পাশাপাশি রুপোও পরা চলতে পারে এই সব পোশাকের সঙ্গে।” জানালেন শাড়ি বিপণনের সঙ্গে যুক্ত সঞ্জয় সাহা। ক্রমে ক্রমে রুপোর ছটা সব ধরনের পোশাকই আলোকিত করছে।
পকেট-বান্ধব
সোনা যখন ৩২ হাজার ছুঁলো, তখন লোকে রুপোর প্রতি বেশি করে ঢলল। বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ গুহ সরকার-সহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা এমনটিই মনে করেন। ভারতের বেশ কিছু প্রদেশে, এমনকী হাল আমলে এই বাংলায় কিছু মানুষজনের কাছে ধনতেরাসে ধাতু কেনা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে পছন্দে সোনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রুপো। “ধনতেরাসে যিনি সোনা কিনতে পারবেন না, বা এক চিলতে সোনা কেনার চেয়ে সেই টাকায় অনেকটা রুপো কেনা পছন্দ করবেন, তিনি রুপোই কিনবেন।” স্পষ্ট অভিমত অমিতাভবাবুর। আর এই মুহূর্তে (এই প্রতিবেদন যখন প্রেসে যাচ্ছে) রুপোর দাম গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। “তাই এ বার ধনতেরাসে রুপোর বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করছি।” জানালেন প্রায় ৭০ বছর রুপোর ব্যবসায় থাকা পরিবারের উত্তরসূরি অভিষেক ভট্টর।
বিনিয়োগের মাধ্যম
রুপোতে বিনিয়োগ নতুন কথা নয়। রিটার্নের মাপকাঠিতে সোনাকেও অনেক সময় টেক্কা দিতে পারে রুপো, জানালেন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ গুহ সরকার। বিনিয়োগ বিষয়ক লেখক ও বিশেষজ্ঞ কনক জৈনের মতে, ১০ কেজি রুপোর গুঁড়োভর্তি বাক্স (শুদ্ধতার নিরিখে খাঁটি) লগ্নির জন্য কেনা যেতে পারে। রুপোর পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কৈলাস বাজাজের বক্তব্য, লগ্নির প্রশ্নে খাঁটি রুপোর বার ও মুদ্রার চাহিদা রয়েছে। খাঁটি রুপোর পুনঃক্রয়মূল্যও রয়েছে। সোনার মতোই বানি (মেকিং চার্জ) বাদ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন অভিষেক ভট্টর ও কৈলাস বাজাজ।
পরা নিরাপদ
বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ-ডিজাইনার-অলঙ্কার নির্মাতা-বিভিন্ন বয়সের ক্রেতা সকলেই এই ব্যাপারে একমত। বাসেট্রামে, বাজারহাটে, রাতবিরেতে রুপো পরে চলাফেরা অবশ্যই তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ।
মডেল: পাওলি। অলংকার সৌজন্য: অঞ্জলি জুয়েলার্স। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।