যেন স্বপ্নের মায়াজালে

রবীন্দ্রসদনে ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’। অপূর্ব উপস্থাপনা। লিখছেন বারীন মজুমদার।তিনি নিজে মনে করেন ‘অহমের বিসর্জন মুক্তির পথ ক্ষমা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করো’। হয়তো সেই বিশ্বাসেই সংশোধনাগারের বন্দিদের কাছে ‘মা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন, দেখিয়েছেন তাদের মধ্যেও প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটানো যায়। তাদের দিয়ে তিনি বাল্মীকি প্রতিভার নৃত্যনাট্য রূপ মঞ্চস্থ করে শহরে ও শহরের বাইরে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যে অলকানন্দা রায় তিনি আবার তাদের দিয়ে মঞ্চস্থ করালেন নবতম প্রযোজনা ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’ শীর্ষক এক ব্যালে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share:

তিনি নিজে মনে করেন ‘অহমের বিসর্জন মুক্তির পথ ক্ষমা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করো’। হয়তো সেই বিশ্বাসেই সংশোধনাগারের বন্দিদের কাছে ‘মা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন, দেখিয়েছেন তাদের মধ্যেও প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটানো যায়। তাদের দিয়ে তিনি বাল্মীকি প্রতিভার নৃত্যনাট্য রূপ মঞ্চস্থ করে শহরে ও শহরের বাইরে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যে অলকানন্দা রায় তিনি আবার তাদের দিয়ে মঞ্চস্থ করালেন নবতম প্রযোজনা ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’ শীর্ষক এক ব্যালে। ২০০৭ সালের ৮ মার্চ বন্দিদের যে পথ চলা শুরু হয়েছিল মঞ্চাবতরণের মাধ্যমে এদিন ছিল তার শততম রজনী আর ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু’-র দ্বিতীয় উপস্থাপনা। রবীন্দ্রসদনে পশ্চিমবঙ্গ সংশোধনাগারের সহযোগিতায় যৌথভাবে নৃত্যনাট্য বা ব্যালেটি উপস্থাপন করলেন টাচ ওয়ার্ল্ড ও রেয়ার আর্থ ফাউন্ডেশন। রবীন্দ্রসদনের অলিন্দে লাল মোমবাতির আলোয় খড়ের গাদায় উদ্ভাসিত ছোট্ট যীশুর যে কল্পরূপ বা সমাগত অতিথিদের হাতে হাতে লাল মোমবাতি প্রদান- সব কিছুই বুঝিয়ে দেয় সন্ধ্যাটি অবশ্যই অন্যরকম হবে।

Advertisement

অলকানন্দা যেহেতু যীশুর জীবন ও সময় ভিত্তিক একটি ব্যালে উপস্থাপন করছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে, তাকে প্রথমেই মনে রাখতে হয়েছে যে এটা রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য নয়-- কেননা সেখানে গান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যালের মাঝে-মাঝে কথা দিয়ে নৃত্যকে বাঁধবে। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যে গানগুলি প্রয়োগ করেছেন তা কখনও আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ, আবার কখনও দুটি লাইন। ব্যালের দেশ রাশিয়াতে ব্যালেকে স্পেকতাকল বলা হয়- এ কথা নিশ্চয়ই তাঁর স্মরণে ছিল। তাই তিনি একে পাশ্চত্যের মোড়কে ভারতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে, পাশ্চাত্য থেকে ভারতীয় নৃত্যধারার ব্যবহারে এমন এক সর্বোচ্চ মানের শিল্পসম্মত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর পরিচালনায় যে কোনও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব সম্বন্ধে তাঁর সচেতনতা সব সময়ই প্রখর ও তীক্ষ্ণ। এই প্রযোজনাতেও প্রতিটি দৃশ্যেই তাঁর সেই দেখার চোখটা আমাদেরও মুগ্ধ করে।

মাতা মেরী ও তার পুত্রের গল্প সকলেরই জানা। তাকেই সংক্ষিপ্ত আকারে এক ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশ করার মধ্যে যে দক্ষতার প্রয়োজন অলকানন্দার তা আছে। তিনি নিজে ওড়িশি নৃত্যশিল্পীর পরিচয়ের বাইরে এসে যে নৃত্য আঙ্গিক প্রকাশ করিয়েছেন তাতে কখনওই মনে হয়নি যে তারা প্রথাগত নৃত্যশিক্ষা করেননি। বেশ কিছু জায়গায় বিভিন্ন নৃত্য আঙ্গিকের বিশেষ করে ছৌ-কলায়ারিপু ও মার্শাল আর্টের নয়নশোভন ও ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগ দেখা গেল। আরও একটি বিশেষ উল্লেখোগ্য বিষয় হল অপূর্ব পেশাদারিত্বে শিল্পীরা কখনও ত্রৈমাত্রিক, কখনও চতুর্ভুজ বা কখনও গোলাকৃতি ভঙ্গিমায় নিজেদেরকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন তা প্রায় বিরল। আনন্দময় মুহূর্তগুলিতে যন্ত্রসঙ্গীতের প্রয়োগে যে ভাবনা দেখা যায় তা অবশ্যই মুগ্ধ করে। মনে থেকে যাবে ‘আলো আলোকময় করে হে’ গানটির মুহূর্ত। তবে বিস্ময় আরও ছিল। অলকানন্দা নিজে গেয়েছেন ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’ ও ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’ গানদুটির অংশ বিশেষ যা ভাবে অভিব্যক্তিতে ও নাটকীয়তায় নিখুঁত। মাতা মেরীর চরিত্রে স্বয়ং অলকানন্দা ও যীশুর চরিত্রে নরেন্দ্র কী চেহারায় কী পোশাকে আশ্চর্যভাবে মিশে গিয়েছেন। সুদক্ষ আলোকসম্পাত, মঞ্চসজ্জা ও পোশাক পরিচ্ছদ কেমন যেন এক স্বপ্নিল মায়াজাল রচনায় সাহায্য করেছে। তবে ছন্দপতন একবারই হয়েছিল। যীশুর জন্মমুহূর্তে মঞ্চের দ্বিতীয় স্তরে হঠাৎই আগুন ধরে যায়। স্বভাবতই হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে পড়েন শিল্পী ও দর্শকেরা। কিন্তু সে বিপদ কেটে যায়। ‘দি শো মাস্ট গো অন’ ইংরেজি প্রবাদবাক্য অনুযায়ী যীশু আবার আলোকপ্রাপ্ত হন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement