একেবারে চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা!
বাঁক নেওয়ার মুখে দুটো ঘোড়ার মধ্যে ধাক্কা লেগে, জকিসমেত দুটো ঘোড়াই উল্টে পড়ল মাঠে।
একটা ঘোড়া বিশ্রীভাবে, ঘাড় গুঁজড়ে।
বাকিরা কিন্তু কেউ থামল না ওদের জন্যে। সবাই দুরন্ত গতিতে উইনিং পোস্ট পেরিয়ে যাওয়ার পর একটা ঘোড়া, জকিবিহীন, লাগামছাড়া, কিন্তু চেনা ট্র্যাকে নির্ভুল দৌড়ে চলে গেল সামনে দিয়ে।
আর অন্য ঘোড়াটা?
সে বেচারি বোধ হয় আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
গ্যালারিতে তখন সবাই রেসের বই খুলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যে ঘোড়াটা সবার পিছনে একা দৌড়ে গেল এক্ষুনি, এক নম্বর ঘোড়া, তার নাম ‘কার্নিভাল পয়েন্ট’। জকি পি এস চৌহান। নামী জকি। আর যে ঘোড়াটাকে দেখা যাচ্ছে না, পাঁচ নম্বর, তার নাম ‘মুনলিট স্কাই’, জকি বি নিখিল।
বই বলছে, এই রেসে পয়লা নম্বর ফেভারিট ‘ইয়েরেভান’-কে মেরে বেরিয়ে যাওয়ার স্ফুলিঙ্গ ছিল তিন নম্বর ফেভারিট মুনলিট স্কাইয়ের মধ্যে। রেসটা যদিও জিতল ফেভারিট তালিকায় চার নম্বরে থাকা ‘লম্বার্ডা’।
কিন্তু ‘মুনলিট স্কাইয়ের’ কী হল?
দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গিয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্স। তখন মাঠে ঢুকছে আরও একটা পিক-আপ ট্রাক গোছের গাড়ি। পর পর অনেকগুলো লাঠির গায়ে আটকানো সবুজ ক্যানভাসের একটা রোল নিয়ে লাফিয়ে গাড়ির পিছনে উঠলেন টার্ফ ক্লাবের খাকি পোশাক পরা দুই কর্মী। পাশ থেকে সুরজিৎ রায় একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে ঘোড়াটাকে ‘ডেসট্রয়’ করে দেবে। ওই যে ওরা সব যাচ্ছে।’’
দৌড় জমছে, পারদ চড়ছে। ছবি: লেখক।
ডেসট্রয় করে দেবে মানে! মেরে ফেলবে?
বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়লেন সুরজিৎবাবু, ‘‘রেসের ঘোড়া যদি খোঁড়া হয়ে যায়, তা হলে আর কোনও কাজে লাগবে না। বাঁচিয়ে রেখে কষ্ট দিয়ে লাভ কী! আগে শটগান দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করত, এখন বোধ হয় ইঞ্জেকশন দেয়।’’
সুরজিৎ রায়। মেম্বরস্ এনক্লোজারের তিন তলায় বক্স নম্বর ৮৩। আরসিটিসি-র ২১ বছরের মেম্বরশিপ। আর মাঠে আসছেন ৬১ বছর ধরে। কলকাতায় রেস থাকলেই আসেন। নিজের বা ছেলের বিয়ে, অথবা পত্নীবিয়োগ, এ ধরনের ঘটনা ছাড়া কোনও দিনই কামাই করেননি। এখন বয়স ৮৬। শিরদাঁড়া টানটান। সোজা হাঁটেন। যাঁরা রেসকোর্সের ‘রেগুলার’, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত প্রবীণতম।
কিন্তু মার্চের এমন চমৎকার এক ঝকঝকে দুপুরে জলজ্যান্ত একটা ঘোড়াকে নিষ্কৃতি-মৃত্যু দেওয়া হবে শুনে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ল, তিনি বসে ছিলেন পিছনে, আরেকটু উপরের একটা বক্সে। প্রথম দিন, প্রথম বার রেসের মাঠে এসে এ রকমই এক অভিজ্ঞতা থেকে লিখে ফেলেছিলেন অসাধারণ এক উপন্যাস ‘দৌড়’। বইটির দ্বাদশ মুদ্রণ হয়েছে চার বছর আগে। কলকাতা রেস কোর্স নিয়ে সেই কাহিনি আজও প্রাসঙ্গিক, যেমন এই নির্মম মৃত্যু।
প্রথম দিনের অভিঘাতের তীব্রতা স্বাভাবিক ভাবেই আর নেই, কিন্তু উত্তেজনা অবশ্যই আছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সমরেশ মজুমদার বললেন, ‘‘দেখলে? আমার দৌড়-এর প্রথম দৃশ্যটা দেখলে?’’
কারণ, আগের দিনই এই নিয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। এখনও কেন সুযোগ পেলেই রেসের মাঠে যান, তার জবাবে মুচকি হেসে রসিকতা করেছিলেন, ‘‘প্রথম দিন দশ টাকা বাজি ধরে হেরেছিলাম। সেই টাকাটা আজও উদ্ধার হয়নি। তাই যাই!’’
যদিও চল্লিশ বছর আগের সেই প্রথম দিন রেসের মাঠে গিয়েছিলেন মধ্যবিত্তের অপরাধবোধ নিয়েই। কিন্তু মাঠে গিয়ে যখন দেখলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস বসে আছেন, তখন ধারণাটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আর সেই প্রথম দিনেই একই রকমভাবে ছুটন্ত ঘোড়ার পা পড়ে গিয়েছিল ‘ফক্স হোল’-এ। পা ভেঙে গিয়েছিল। তাকেও এই ভাবেই ক্যানভাসের ঘোরাটোপের মধ্যে নিষ্কৃতি-মৃত্যু দেওয়া হয়েছিল।
‘‘আসলে সে দিন আমার মনে হয়েছিল, আমরাও তো রেসেরই ঘোড়া। অর্থ, যশ, প্রতিষ্ঠা, যে যার লক্ষ্য সামনে রেখে সবাই দৌড়চ্ছি। এর মধ্যে যে পারে না, বা যার পা গর্তে পড়ে, খোঁড়াতে থাকে, সে কিন্তু দৌড় থেকে হারিয়ে যায়। রেসের মাঠের মতো তাকে হয়তো গুলি করে মারা হয় না, কিন্তু ভাগ্য তাকে মেরে ফেলে।’’
তবে ঘোড়দৌড়ের রক্ত ছলকে ওঠা উত্তেজনার মতো এই রক্তপাতও গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। পুরসভার ‘মৃত পশুবাহী’ গাড়ি যখন মাঠে ঢুকছে, তখনই লাউড স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে, জকি পি এস চৌহান জখম হয়েছেন। তাঁর বদলি এক জকি বাকি রেসগুলো দৌড়বেন। সবাই বই উল্টে দেখতে শুরু করে দিয়েছেন, চৌহানের জন্য বেছে রাখা ঘোড়ার সঙ্গে নতুন জকির কম্বিনেশন কতটা ‘আপসেট ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারে।
কোন ঘোড়ার জন্য কোন জকি, সেটা ঠিক করেন ট্রেনার। ঘোড়া কেনার ক্ষেত্রেও ট্রেনারদের মতামতই শেষ কথা। যদিও ‘হেভিওয়েট’ মালিকরা নিজেদের নামীদামি ঘোড়ার মানানসই জকি অনেক সময় নিজেরাই পছন্দ করে নেন, যেমন বেঙ্গালুরুর বিজয় মাল্য, চেন্নাইয়ের এম এ রামস্বামী। কলকাতা রেসকোর্সে এঁদের সমকক্ষ একজনই ছিলেন, সদ্যপ্রয়াত দীপক খৈতান। তাঁর দৌলতে অনেক ভাল ঘোড়া আর জকি দেখেছে কলকাতা।
এ ছাড়া বড় ডার্বির সময়, যখন বিপুল অঙ্কের ‘জ্যাকপট’, মালিকদের ‘স্টেকমানি’ও অনেক বেশি, তখন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড থেকে বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে বিখ্যাত জকিদের নিয়ে আসা হয়। বাকিরা বেশির ভাগ উত্তরপ্রদেশ কিংবা দক্ষিণ ভারতের অবাঙালি মুসলিম, রাজপুত আর মরাঠি। আগে কলকাতায় অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জকি ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জকি প্রায় নেই। কলকাতায় বা মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ অথবা মহীশূরের মাঠে বাঙালি জকি কখনও থাকলেও তাঁরা নাকি চিরকালই তালিকায় শেষ দিকে থেকেছেন।
মাঠে নামার আগে।
শেষ সফল বাঙালি শিল্পপতি শোনা গেল ধ্রুব দাশ, ‘টপমোস্ট’ বলে একটা ঘোড়াকে বাজি জিতিয়েছিলেন। রেসের বই যদিও কলকাতার মাঠে পল্টু দাশ এখনকার এক জকির নাম বলছে, কিন্তু গ্যালারির খবর, তিনি ওড়িশার লোক। কেন কোনও বাঙালি জকি নেই, তার কারণটা অবশ্য চেনা। অত পরিশ্রম বাঙালির পোষায় না! শুধু ছিপছিপে শরীর, বা ৫০ কেজি-র মধ্যে ওজন ধরে রাখা নয়, পানাহার থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সমস্ত আমোদ-আহ্লাদের মুখে লাগাম পরিয়ে রাখতে হয়। নিয়মিত কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকতে হয়। একটা সাধারণ মানের দৌড়েও ঘোড়াকে ১৪০০ মিটার পার হতে হয় কম-বেশি এক মিনিটে। তার সওয়ারকে তাই সক্ষমতা, সতর্কতার তুঙ্গে থাকতে হয়।
তুলনায় ঘোড়ার মালিকদের মধ্যে বেশ কিছু বাঙালি নাম। মেম্বরস্ গ্যালারিতে দেখা হল চিরঞ্জিত বসুর সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী, শখের গীতিকার আর নেশায় দৌড়। ছ’ বছর আগে প্রথম ঘোড়াটা কিনেছিলেন। মহীশূর-কলকাতা মিলিয়ে এখন আটটা ঘোড়া। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। পরের রেসটাতেই দৌড়বে তাঁর ঘোড়া ‘ক্লেমোর’। আরসিটিসি-র স্টুয়ার্ড সুবীর দাশগুপ্ত আর চিরঞ্জিতবাবুর যৌথ মালিকানার ক্লেমোর ফেভারিট হিসেবেই শেষ পর্যন্ত জিতল।
ঘোড়ার বিনিয়োগ তা হলে ব্যবসা হিসেবে লাভজনক? হাসলেন চিরঞ্জিতবাবু। সেটাও বরাত। ভারতে এই মুহূর্তে সব থেকে সফল ঘোড়া এম রামস্বামীর ‘বি সেফ’। জন্মসূত্রে আইরিশ। গত চার বছরে চার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে। আবার এই একই ঘোড়া অন্য আস্তাবল, অন্য ট্রেনার আর জকির হাতে পড়লে কী হত বলা যায় না। তার সেরা উদাহরণ ‘রিভার ডাউন এমপ্রেস’। মালিক প্রদীপ মণ্ডল, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন ডেপুটি রেজিস্ট্রার। রেসের মাঠের সঙ্গে ৪৯ বছরের সম্পর্ক, রসিটিসি-র সঙ্গেও নানা সূত্রে যুক্ত।
‘নন পারফর্মার’ বদনাম হয়ে যাওয়ায় প্রায় জলের দরে এমপ্রেসকে কিনেছিলেন প্রদীপবাবু। যে ঘোড়াকে প্রথম বার আয়ারল্যান্ড থেকে এ দেশে আনা হয়েছিল দেড় কোটি টাকা দিয়ে। কিন্তু একের পর এক বাজি হারায় হু হু করে দাম পড়তে লাগল। শেষে দেড় কোটির ঘোড়া মাত্র ৩৫ লক্ষ টাকায় কিনে নিল মাহিন্দ্রা গোষ্ঠী। কিন্তু তাদের হাতেও হর্স পাওয়ার বাড়ল না। হতমান সম্রাজ্ঞী দু’বছর আগে মাথা নিচু করে এসে ঢুকলেন কলকাতার আস্তাবলে।
ম্যাজিকটা ঘটে গেল তার পরেই। এক সময়ের ‘নন পারফর্মার’ হয়ে গেল ‘থ্রি টাইমস্ উইনার ইন এ রো’! রিভার ডাউন এমপ্রেসকে নিয়ে প্রদীপবাবুর গলায় অকৃত্রিম গর্ব। এখন অবশ্য রেসের মাঠ থেকে এমপ্রেস গিয়েছে ধাইমার বাড়ি, বাচ্চা বিয়োতে। চ্যাম্পিয়ন ঘোড়ার বাচ্চার অনেক দাম। তার পর শরীর ঠিক থাকলে এমপ্রেস আবার রেসের মাঠে ফিরবে, নয়তো চলে যাবে কোনও রাইডিং স্কুলে।
রেসের ঘোড়ার এই একটি ব্যাপার নিয়ে ঘোর অস্বস্তিতে থাকেন আর এক মালিক গৌতম সেনগুপ্ত। কলকাতার ব্যবসায়ী, সারা দেশেই ঘোড়া দৌড়য় তাঁর। রেসের মাঠের মেয়াদ ফুরোলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সেই সব ঘোড়ার জীবন। কিছু নেয় মাউন্টেড পুলিশ। কিছু যায় রাইডিং স্কুলে।
সমরেশ মজুমদার
কিন্তু বাদবাকি?
হাত বদল হওয়ার পর কে তাদের কী ভাবে রাখবে, যত্নআত্তি করবে কি না, এ সব ভাবতে গেলে মন খারাপ হয় আজীবন পশু-পাখি ভালবেসে বাঁচা গৌতমবাবুর। ওই কারণেই আস্তে আস্তে সব গুটিয়ে ফেলার কথা ভাবছেন এ বার।
তবে সাতচল্লিশ বছর ধরে রেসের সঙ্গে সম্পর্ক, তাই মাঠে আসা ছাড়তে পারবেন না। বরং তাঁর ইচ্ছে, আরও লোক আসুক। নিছক রেস খেলার আখড়া না থেকে আরসিটিসি এই শহরের আরও একটা পারিবারিক পিকনিকের জায়গা হয়ে উঠুক। যদিও ক্লাব মেম্বরশিপ এখনও কঠোর ভাবে আমন্ত্রণমূলক এবং মহার্ঘ। যেহেতু বেটিং হয়, ভারতের আর কোনও শহরে না হলেও কলকাতায় ১৬ বছরের নীচে কোনও প্রবেশাধিকার নেই।
তবু এমন চমৎকার একটা খোলামেলা জায়গায় লোকে বেড়াতে, আড্ডা দিতেও আসতে পারেন, বক্তব্য গৌতম সেনগুপ্তের।
অনেকে কিন্তু সেই কারণেই আসেন। শনি-রবিবার শহরে থাকলে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে আসেন আইনজীবী শৈবাল গঙ্গোপাধ্যায়। ওঁর টেবিলেই দেখা হল দাবার গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মেম্বরস গ্যালারির একতলার বিরাট লাউঞ্জে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে সবাই যখন এলসিডি স্ক্রিনে মুম্বইয়ের চলতি রেসের লাইভ ফিড দেখতে ব্যস্ত, তখন পঙ্কজবাবু ব্যস্ত বন্ধুদের হেমন্ত মুখুজ্যের ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক’ গেয়ে শোনাতে।
আর আছেন সুরজিৎ রায়ের মতো মানুষেরা, রেসের মাঠ যাঁদের কাছে বেঁচে থাকার বাড়তি অক্সিজেন। ৮৬ বছরের ‘তারুণ্যে’ আরও কিছুটা প্রাণশক্তি ভরে নেওয়া। এর সঙ্গে উপরি পাওনা প্রতিটা ঘোড়দৌড়ের ওই অসম্ভব, অবিশ্বাস্য, অপ্রতিরোধ্য উত্তেজনা। একসঙ্গে শুরু করছে সব ক’টা ঘোড়া। যাদের গতি এবং সক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি, অঙ্ক কষে তাদের ওপর বাড়তি ওজনের ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে জেতার সুযোগ সবার সমান থাকে।
তার পরেও ভিকট্রি ল্যাপে পিছিয়ে থাকা একদঙ্গল ঘোড়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে একটা ঘোড়া। সেই মুহূর্ত থেকে প্রতি কদমে একটা-দুটো করে আগুয়ান ঘোড়াদের পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যেতে থাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে আর বুঝিয়ে দেয় আর কেউ নয়, সে-ই বিজয়ী!
প্রেমেন্দ্র মিত্র
তবে রেসের মাঠে অঘটন খুব কমই ঘটে। মানে ‘ফেভারিট’ ঘোড়াদের সবাইকে টপকে একটা ‘আপসেট’ ঘোড়া ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে দৌড় শেষ করল সবার আগে, এমন সচরাচর হয় না। কিন্তু ঘোড়া তো ঘোড়াই। কোন এক সংকট মুহূর্তে সে নিজের শেষ রক্তবিন্দু বাজি রেখে দৌড়তে শুরু করল, সে কথা তার জকিও জানে না।
একটা মজার গল্প আছে। একদা ‘হার্ড টু সে’ নামে এক ঘোড়া ছিল। যে ছিল ঢাকাই কুট্টিদের রসিকতা অনুযায়ী ‘বাঘের বাচ্চা’। মানে যে কোনও রেস সে বাকিদের তাড়া করে সবার পরে শেষ করত। রেসের মাঠের পরিভাষায় wএ ধরনের ঘোড়াকে বলে ‘ডাউন দ্য লাইন’। কিন্তু ‘হার্ড টু সে’-কে অনেক টাকা দিয়ে নিলামে কেনা হয়েছিল। সে যদি সেই টাকা তুলে দিতে না পারে, তা হলে তাকে রেখে লাভ কী!
সেই শক্ত কথাটাই খুব নরম ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই হেরো ঘোড়াকে। যে, দেখো বাপু, আর একটাই চান্স পাবে। যদি জিততে না পারো, তা হলে তোমার জন্য অন্য আস্তাবল খুঁজে দেওয়া হবে!
যিনি গল্পটা বলেছেন, তাঁর রসবোধ অসাধারণ। বলেছেন, ঘোড়দৌড় যেহেতু সাহেবদের খেলা, ওদেরই শুরু করে যাওয়া, ঘোড়ারা আর কিছু না বুঝুক, ইংরেজিটা খুব ভাল বোঝে! ফলে পরের দৌড়ে, সবাইকে চমকে ছিটকে দিয়ে জিতে গিয়েছিল ‘হার্ড টু সে’! সে বার তার জকি ছিলেন বিখ্যাত রবিন কর্নার, এখন যিনি কলকাতা রেসকোর্সের সমস্ত দৌড় পরিচালনার দায়িত্বে।
তবে এর বাইরেও অঘটন ঘটে। সে প্রায় থ্রিলারের মতোই রোমহর্ষক। অনেক টাকার বাজি। সারা মাঠ জানে কোন ঘোড়া বাজিমাত করতে চলেছে। কিন্তু দৌড় শুরুর আগেই নাকি ঘটে গিয়েছে অন্য নাটক। জকির কাছে উড়ো ফোন চলে এসেছে, রেসটা হারতে হবে। না হলে আদরের মেয়ে কাল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবে না!
পরের ঘটনা খুব আকস্মিক, অথচ প্রত্যাশিত। জকি ‘ভয়ঙ্কর অসুস্থ’ হয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। শেষ মুহূর্তে তার যোগ্য বদলি পাওয়া যায়নি, যে ফেভারিট ঘোড়াটিকে ঠিকঠাক চালনা করতে পারবে। ফলে মাঠে মারা গিয়েছে বাজি জেতার সম্ভাবনা, কিন্তু ‘অসুস্থ’ জকির মেয়ের নিরাপদে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত হয়েছে।
এমন কি সত্যিই হয় নাকি?
না হওয়ার কী আছে! ক্রিকেটের মতো তথাকথিত ভদ্দরলোকের খেলায় যদি অমন তুমুল বেটিং হতে পারে, বুকিদের ইশারায় উইকেট পড়তে পারে, দাঁড়াতে পারে, তা হলে ঘোড়দৌড়ের মতো বেটিং-সর্বস্ব খেলাতে এ সব হতেই পারে!
কিন্তু রেসের মাঠে নাকি এমন অঘটন কম ঘটে। বহু লক্ষ মানুষের কোটি কোটি টাকার বাজি যে ঘোড়ার ওপর, ছক কষে তাকে হারিয়ে দেওয়াটা অত সহজ নয়। তবে ঘোড়ার মতিগতিও তো সব সময় বোঝা যায় না। যেমন, প্রায় সব রেসেই, যে ঘোড়া সম্ভাব্য বিজয়ী, তার ‘পেস সেটার’ হয়ে অন্য একটা ঘোড়া পাশাপাশি দৌড়য়। তার একমাত্র কাজ, একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত পাল্লা দিয়ে দৌড়ে ফেভারিট ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে তোলা।
দেবব্রত বিশ্বাস
কিন্তু কখনও কখনও এমনও হয়, দৌড়তে দৌড়তে তাকে জেতার নেশায় পেয়ে বসল। তখন অতি দক্ষ জকিও তার রাশ টানতে পারে না। ভবিতব্য নয়, নিজের পুরুষকারে সওয়ার হয়ে সেই ‘পেস সেটার’ নিজেই হয়ে ওঠে ‘উইনিং হর্স’। নিশ্চিত বিজয়ীকে পিছনে ফেলে পেরিয়ে যায় উইনিং পোস্ট। একবারের জন্য হলেও নিজেকে প্রমাণ করে।
ঘোড়দৌড়ের আসল মজা, তার যাবতীয় উত্তেজনা লুকিয়ে থাকে সেই মহান অনিশ্চয়তার মধ্যেই। রেসের মাঠের হাওয়ায় আরও নানা ‘খবর’ ভাসে। একেবারে শেষ মুহূর্তে জকির কাছে গোপন নির্দেশ এসেছে, রেসটা ছেড়ে দিতে হবে। কিছু লোক বিশ্বাস করে, কিছু লোক করে না। তার ওপরেই উল্টে পাল্টে যায় পাশার দান, লোকের ভাগ্য। কেউ হাসে, কেউ হাহাকার করে।
কখনও এ রকমও হয়, কোনও আপসেট হয়ে যাওয়ার পর জোরালো অভিযোগ উঠল, সেই রেস বাতিল করতে হল। জানিয়ে দেওয়া হল, বেটিং-এর টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু রেসের মাঠে আমজনতার গ্যালারির পরিচিত প্রতিক্রিয়াই হল, যারা হেরে যায়, তারা চূড়ান্ত হতাশায় হাতের টিকিট ছুড়ে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়। তার পর ঘোষণা করা হয় বেটিং মানি ফেরত দেওয়ার কথা, তখন সেই টিকিট কুড়িয়ে নেওয়ার ধুম পড়ে।
‘‘অদ্ভুত লাগে দেখতে! মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাদা কাগজ, আর কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে হরিপদ কেরানি, সবাই পাশাপাশি মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে ফেলে দেওয়া টিকিট খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে,’’ বলছিলেন সমরেশ মজুমদার। রসিকতা করলেন, ‘‘রেসের মাঠ হচ্ছে ফলিত কমিউনিজমের শেষ কথা! দুর্মূল্য গাড়ি থেকে নেমে স্যুট পরা লোকটি যে ভাবে মলিন জামাকাপড় পরা পান্টারের থেকে ‘টিপস’ নেন, দেখে মনে হয় যেন কত দিনের অন্তরঙ্গতা। অথচ সেই লোকটিই যখন কোটি টাকার বাজি জিতে মাঠ ছাড়েন, তখন কিন্তু পান্টারের কথা তাঁর মনেও থাকে না!’’
তবু দু’জনেই আবার পরের রেসের দিনই মাঠে আসেন। নতুন করে জেতার চেষ্টা করবেন বলে। ফের এক বার কপাল ঠুকে বাজি ধরবেন, ঝুঁকি নেবেন আবার।
আসলে রেসকোর্স নিয়ে কোনও কথা, যে কোনও লেখার শেষ বোধ হয় জুলিয়া রবার্টসের ‘প্রিটি ওম্যান’-এর সংলাপ দিয়ে হওয়া উচিত।
অদ্ভুত যে, সংলাপটা মূল চিত্রনাট্যে নেই! কিন্তু ছবিটা বানানোর পর পরিচালকের নির্ঘাত মনে হয়েছিল, এমন জমজমাট প্রেমকাহিনির শেষেও একটা শেষ কথা থাকা উচিত। তাই এক পথচলতি মানুষের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন, হলিউড, এখানে মানুষ স্বপ্নের খোঁজে আসে। কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়, কিছু হয় না। তাই বলে স্বপ্ন দেখা থামিয়ো না। কিপ ড্রিমিং। স্বপ্ন দেখতে থাকো।
ঘোড়দৌড়ের মাঠের শেষ কথা, সার কথা সম্ভবত ওটাই। আজকে জিত হতে পারে, কিংবা হার। তবু স্বপ্ন দেখো!