তুমি আর নেই সে তুমি

পোশাকি নাম পাইস হোটেল। যার স্মৃতিতে উথলে ওঠে শিবরাম চক্রবর্তী হয়ে অভিনেতা অসিতবরণ। আজ তার হালহকিকত পরখ করলেন সুরবেক বিশ্বাসপাবদা মাছের ঝোলে টোম্যাটো পড়ায় বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাধিয়েছিল বছর আটত্রিশের যুবক। কারণ, তার মতে, পেঁয়াজ দিয়ে ইলিশ রাঁধলে বুদ্ধদেব বসুর কথা অনুযায়ী যেমন ‘মহাপাতক যোগ’ হয়, তেমন পাবদায় টোম্যাটো দিলেও তাই। রাগে গরগর করতে করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল একটা ভাতও মুখে না দিয়ে, এক পেট খিদে নিয়ে। আর বেরোনোর সময়ে গিন্নিকে ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘আজ আমি পাবদা মাছই খাব, অনেক ভাল খাব, হোটেলে খাব।’ আপিসে হাজিরা দিয়েই সে চলে গেল কলকাতা প্রসিদ্ধ ভাতের হোটেল, জানবাজারের মা সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

পাবদা মাছের ঝোলে টোম্যাটো পড়ায় বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাধিয়েছিল বছর আটত্রিশের যুবক।

Advertisement

কারণ, তার মতে, পেঁয়াজ দিয়ে ইলিশ রাঁধলে বুদ্ধদেব বসুর কথা অনুযায়ী যেমন ‘মহাপাতক যোগ’ হয়, তেমন পাবদায় টোম্যাটো দিলেও তাই। রাগে গরগর করতে করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল একটা ভাতও মুখে না দিয়ে, এক পেট খিদে নিয়ে। আর বেরোনোর সময়ে গিন্নিকে ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘আজ আমি পাবদা মাছই খাব, অনেক ভাল খাব, হোটেলে খাব।’ আপিসে হাজিরা দিয়েই সে চলে গেল কলকাতা প্রসিদ্ধ ভাতের হোটেল, জানবাজারের মা সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে।

এক কথায় পাবদা মাছ-ভাতের অর্ডার দেওয়ার মিনিট চারেক বাদে যখন টেবিলে ধোঁয়া ওঠা খাদ্যবস্তু পৌঁছল, চোখে জল এসে গেল যুবকের। ইয়া বড় পাবদা মাছের কালোজিরে ফোড়নের ঝোলে খাবলা খাবলা টোম্যাটো দেওয়া।

Advertisement

বানানো গল্প নয়, ষোলো আনা সত্যি ঘটনা।

বিলিতি বেগুনের অকারণ ব্যবহারে খিদিরপুরের মণিলাল ব্যানার্জি রোডের ইয়ং বেঙ্গল হোটেল আর এক কাঠি সরেস। মটরডালের বড়ার ঝাল, ওলের ডালনা ও ট্যাংরা মাছের তেলঝোল—সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটে পদেই সেখানে টোম্যাটোর অশ্লীল অনুপ্রবেশ।

মটরডালের বড়ার ঝালে অসুবিধে নেই, তেলঝোল নামে আসলে পাতে পড়েছিল একটু মিষ্টি স্বাদের ট্যাংরার কালিয়া জাতীয় বস্তু—তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ছোলা-নারকোল দিয়ে রান্না ওলের ডালনায় টোম্যাটোর টুকরো দেখে মনে হল, লর্ডসে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড অ্যাসেজ সিরিজের টেস্টে বিকিনি পরা চিয়ার লিডাররা নাচছে।

তবে তার চেয়েও বড় ধাক্কা খেতে হল কলেজ স্ট্রিটে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া ভবানী দত্ত লেনের ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে’ ভাত খেতে গিয়ে।

১৯২৭-এ শুরু হয়েছিল হিন্দু হোটেল নামে। কিন্তু খোদ সুভাষচন্দ্র বসু-সহ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মাঝেমধ্যেই নাকি এখানে খেতেন বলে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরের বছরের ২৬ জানুয়ারি নামটার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘স্বাধীন ভারত’। দেশাত্মবোধের ঐতিহ্য বজায় রাখতে। কিন্তু বাঙালি রান্নার চিরায়ত ঐতিহ্য এখন কোথায় সেখানে?

মাছের মুড়ো দেওয়া মুগডালের গন্ধ ও আমেজ হরণ করেছে বহিরাগত ও রবাহূত পেঁয়াজের নির্লজ্জ উপস্থিতি। পাবদা মাছে টোম্যাটো দেওয়ার মতো ব্যাকরণগত ভুল নেই বটে। কিন্তু তার বদলে তেলঝোলের বিছানায় ফিঙ্গার চিপ্স-এর আকারে কাটা আলু দিয়ে মাছটার ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে।

বাঙালি রান্নার প্রকৃত সমঝদার যাঁরা, তাঁদের জন্য এই ধরনের দুঃখ আর হাহাকার রান্নার পদে পদে অপেক্ষা করে আছে এই শহরের তথাকথিত নামীদামি পাইস হোটেলগুলোয়।

পেটচুক্তির হোটেলগুলোকেই বলা হত পাইস হোটেল। পেটচুক্তি মানে এক বার খাবার নেওয়ার পর ভাত-ডাল-নিরামিষ তরকারি যত বার খুশি নিখরচায় নেওয়া যাবে। যতক্ষণ না পেট ভরছে।

পরে ওই তালিকা থেকে ভাত বাদ দেওয়া হয়। প্রতি বার ‘এক্সট্রা’ ভাতের জন্য চালু হয় দাম নেওয়া—হোটেল ভেদে এক থেকে পাঁচ টাকা। এখন অবশ্য ডাল-তরকারিও আর এক বার চাইলে কড়ায়-গণ্ডায় পয়সা গুনে নেয় হোটেলগুলো।

সে না হয় হল, তা বলে রান্না ভুলভাল হবে কেন, তার সদুত্তর মিলবে না। স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে ছোট পেটোর সাইজের মাছের ডিমের বড়ার মাঝখানটা প্রায় কাঁচা, বড় আকৃতির জন্য নুন-ঝাল মাঝখানে ঢুকতে বাধা পেয়েছে। কিন্তু অভিযোগ জানিয়ে শুনতে হল, ‘আমাদের এখানে মাছের ডিমের বড়া এ রকমই হয়!’

পরিষ্কার বোঝা গেল, টকটকে লাল ঝোল থেকে একটা মাছ তুলে সর্ষে বাটার গ্রেভিতে দেওয়া হয়েছে, তবু কিছুতেই মানলেন না পরিবেশনকারীরা।

অথচ এমন অবস্থা ছিল না। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, ফেভারিট কেবিন, সাঙ্গু ভ্যালির মতো ঐতিহ্য বহন করছে ভাত খাওয়ার এই পুরনো হোটেলগুলো।

শিব্রাম চক্রবর্তীর লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে পাইস হোটেলের কথা। বাংলা ছবির নায়ক অসিত বরণের শেষ জীবনটা নায়কোচিত কাটেনি। সেই সময়ে ওই অভিনেতার দু’বেলার খাওয়ার ঠিকানা ছিল মুদিয়ালির কাছে ভবানন্দ রোডের পাইস হোটেল গ্রিন কাফে।

শরীর-স্বাস্থ্যের কারণেও এই সব ভাতের হোটেলের উপযোগিতা কম নয়। বছর ১৭ আগের কথা। প্রবীণা ডায়েটেশিয়ান প্রীতি সেন বলছিলেন, “বাইরে খেতে হলে পাইস হোটেলে খাওয়া অনেক ভাল। টাটকা খাবার। শরীর খারাপের ঝুঁকি কম।” হয়তো সেই কারণেই স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের মালিক, নবতিপর প্রহ্লাদ পণ্ডা ডাঁটের সঙ্গে বলতে পারেন, “আমাদের হোটেলে ফ্রিজ নেই, ছিল না, থাকবেও না।”

আজকের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কিউপিজ কিচেন, ভজহরি মান্না, তেরো পার্বণ, সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস, ষোলো আনা বাঙালি আসলে ওই সব পাইস হোটেলের ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ-সংস্করণ। অথচ পথিকৃৎ নিজেই এখন পথভ্রষ্ট।

উদারপন্থীদের কেউ কেউ বলতে পারেন, পেঁয়াজ-রসুন দেওয়া ইলিশ মাছ এখন অনেকের কাছে জনপ্রিয়, বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া বাঙালি রান্নায় পাবদা মাছে টোম্যাটো কিংবা মাছের মুড়ো দিয়ে মুগডালে পেঁয়াজ দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

সমস্যা হল, এই ভাতের হোটেলগুলো তো টপক্লাস কোনও শেফের ফিউশন ফুডের রেস্তোরাঁ নয়। এগুলো বাড়ির ‘এক্সটেনডেড ডাইনিং রুম’। এখানে শৌখিন খদ্দেরের চেয়ে প্রয়োজনের তাগিদে খেতে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি। বিশুদ্ধতা তাই বাঞ্ছনীয়। এই সব হোটেলে কেউ নিশ্চয়ই ঢ্যাঁড়শ দিয়ে রাঁধা মুরগি খেতে যাবেন না! তা ছাড়া, শুক্তোনিতে ঝাল আর অম্বলেতে ঘি যে পড়তে পারে না, সেটা কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ।

পাইস হোটেলের মান খারাপ হওয়ার জন্য আবার অনেকে যুক্তি দেন, আগের মতো মাছ-মুরগি, তেল, মশলা ও সর্বোপরি ওস্তাদ ঠাকুর তো আর নেই। হক কথা। কিন্তু সেই সঙ্গে চেষ্টাটাও নেই। যার প্রমাণ টোম্যাটো দিয়ে পাবদা কিংবা ওল।

তবু গড়িয়াহাট বাজার-ভবনের দোতলায় আদর্শ হিন্দু হোটেল, যা কি না কালী মাইতির হোটেল বলে পরিচিত, সেখানে কিংবা শোভাবাজারের কমলা হোটেল বা আমাদের অফিস পাড়ার ‘মডার্ন ইটিং হাউস’-এর মতো তুলনায় প্রচারের আর্কল্যাম্প না পড়া জায়গায় মাঝেমধ্যে পাওয়া যেতে পারে ব্যতিক্রমী ঝলক।

মডার্ন ইটিং হাউস-এর শুক্তো দিয়েই এক প্লেট ভাত শেষ করা যায়। কালী মাইতির হোটেলে পাওয়া গেল লাউশাক, কুমড়ো, বেগুন ও আলুর তরকারি। চার রকম সব্জির যথাযথ মিলনে পরিপূর্ণ আবেশ এনেছে শুকনো লঙ্কার ফোড়ন।

এই নির্দিষ্ট পদটিতে আলুর গায়ে খোসা নামক অলঙ্কার যে স্বাদকে আরও উচ্চতায় তুলে নিয়ে যায়, রাঁধুনির তা বিলক্ষণ জানা আছে দেখা গেল। পাঁচ টাকার ছোট এক বাটির ডাল খেয়ে বুঝতে অসুবিধে হল না যে সেটা মুগডাল।

অথচ ইয়ং বেঙ্গল হোটেলে মুসুর ডাল নামে ১০ টাকা দামের যে তরল পদার্থটি এল, সেটা মুসুর, মুগ না বিউলি নাকি জল কিছুই বোঝা গেল না।

তার চেয়ে শোভাবাজারের প্রায় ষাট বছরের পুরনো কমলা হোটেলের দু’টাকা দামের ডাল অনেক ভাল। পাতলা ঠিকই, কিন্তু ডালত্ব রয়েছে। সঙ্গে মেখে খেতে সাত টাকা পিস চিংড়ি মাছের বড়া অতীব সুস্বাদু। সেখানকার ঝিরি ঝিরি আলুভাজাও অনন্য। ডুবো তেলে ভাজলেও আলুর স্বাদ-গন্ধ উবে যায়নি, কারণ ভাজার সময়ে আলু-নুন-হলুদের সঙ্গে মাখা হয়েছে আরও একটা জিনিস। যত্ন।

যেটা সব চেয়ে বেশি মফস্সলের পাইস হোটেলগুলোয়। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, কোলাঘাটের তৃপ্তি হোটেল যেমন। আলু পটল দিয়ে রাঁধা বাগদা চিংড়ির ডালনার স্বাদ এক বছর পরেও মুখে লেগে থাকে। কিন্তু এই হোটেলের তুরুপের তাস সম্ভবত রুই মাছের পেটি ভাজা। মাছের পেটিসমূহ হাল্কা করে ভেজে রাখাই থাকে।

খদ্দেরের অর্ডার পেলে কোনও মহিলা অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রাইং প্যান বসিয়ে দেবেন উনুনে। গরম হলে অল্প সর্ষের তেল, শুকনো লঙ্কা আর তার পর মাছ। ভাল করে এপিঠ-ওপিঠ ভাজার পর গরম ফ্রাইং প্যান ও ছ্যাঁকছোঁক শব্দ সমেত মাছটা আপনার কাছে নিয়ে এসে ভাতের উপর উপুড় করে দেওয়া হবে লঙ্কা ভাজা আর তেল সমেত। রূপে না হোক, শব্দে যেন বাংলাই সিজলার।

কোলাঘাট থেকে বম্বে রোড ধরে পৌঁছন মেদিনীপুর শহরে। জেলা পরিষদ ভবনের উল্টো দিকে সাহুর হোটেল পোস্তর বড়া, ছোট ভেটকির ঝাল, ডাঁটা দিয়ে টাটকা কাতলার ঠান্ডা ঝোল, রুই পোস্ত আর পাঁঠার মাংসের স্নিগ্ধ ঝোলের সম্ভার নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

সাহুর হোটেলের পাশেই সাহুর নিরামিষ হোটেল। যেখানে কুমড়ো ডাটা, কাঁচকলা, আলু, বেগুন, বড়ি-সহ বিভিন্ন সব্জি ও উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি ‘লাইট ঝোল’-এর স্বাদ স্রেফ অনির্বচনীয়। আর সাহুর নিরামিষ হোটেলে পোস্তর বড়ায় পেঁয়াজ নেই, শুধু লঙ্কা।

তবে পোস্তর বড়ায় সব চেয়ে এগিয়ে বিষ্ণুপুরের মোনালিসা হোটেল। বিষ্ণুপুরের লোক বাঁকুড়া শহরের দেবর্ষি হোটেলের অতুলনীয় পোস্তর বড়া খেয়েও নাক কুঁচকে বলেন, ‘পোস্তর বড়ায় আমাদের মোনালিসার উপরে কেউ নেই।’

তবে মোচার ঘণ্ট রাঁধায় দেবর্ষি অনেককেই পিছনে ফেলে দেবে। লাল মাটির আর এক জেলা, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা বান্দোয়ানে, বাসস্ট্যান্ডের পাশে, আরতি হোটেলে এক দুপুরে খেয়ে মুগ্ধ হতে হল।

উচ্ছে চচ্চড়িতেও বিস্ময় নেই, কিন্তু হাঁ হয়ে যেতে হয় ভাতের পাতে লাউশাক পোস্ত পেয়ে। বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। আমিষ চাইতে দেওয়া হল, খাঁটি দেশি মুরগির লাল ঝোল।

বান্দোয়ানের তুলনায় অনেক কম ব্যস্ত, মালদহের হবিবপুরের রেজিস্ট্রি অফিসের গা ঘেঁষা বিশ্বাস হোটেল দেশি মুরগির গরগরে ঝাল খাইয়ে আরও চমকে দিয়েছিল। যেমন স্বাদ, তেমনই গন্ধ। হোটেল-মালিক বললেন, “দেশি মুরগির যত বেশি দামই হোক, এই হোটেলে ব্রয়লার মুরগি আজ পর্যন্ত ঢুকতে দিইনি, কোনও দিন দেবও না।”

একেই বলে সঙ্কল্প। যা না থাকলে পাইস হোটেল খানদানি ও ভোজনরসিক খদ্দের নিয়মিত পায় না, পেতে পারে না। সঙ্কল্প না থাকার কারণেই কলকাতার চাঁদনির ‘মডার্ন ইটিং হাউস’ থেকে দেশি মুরগির কষা বিদায় নিয়েছে।

উল্টো দিকে, বীরভূমের সিউড়ির যুবরাজ হোটেল মুগ্ধ করে। এক প্রবীণ মানুষের পরামর্শে কাটা পোনার ঝোল নেওয়া হল। সাধারণ কাটাপোনার ওই রকম অতুলনীয় স্বাদ শেষ কবে কলকাতায় পাওয়া গেছে?

২৫ বছর আগে, নাকি তারও বেশি? সুপরামর্শ দেওয়া প্রৌঢ় জানালেন, গত দু’বছর যাবৎ মাঝেমধ্যেই তাঁকে ওই হোটেলে খেতে হচ্ছে, কাটাপোনার ওই স্বাদে একদিনও বিচ্যুতি লক্ষ করেননি।

আসলে যে কোনও খাওয়ার জায়গায় ধারাবাহিকতা জিনিসটা খুব জরুরি। যেটা বজায় রাখতে পারেনি শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে, ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে শিবমন্দির মোড়ের চলাচল হোটেল।

বছর দশেক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল যে, চলাচল-এর জন্য শিলিগুড়ির অনেকে বাড়িতে খাসির মাংস রান্নার পাঠ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। না ঝোল-না কষা, না ঝাল-না হাল্কা—মাখো মাখো লালচে গ্রেভিতে চার টুকরো সুসিদ্ধ মাংসের মতো ওই জিনিস আর কোথায় পাওয়া যায়, কে জানে! চলাচল-এই পাওয়া যেত রুই মাছের হাল্কা কালিয়া, কাতলা নয় কিন্তু। দশ-বারো কেজি ওজনের একেকটি রুই আসত অসমের ধুবুড়ি থেকে। এখন সে সব স্মৃতি।

শিলিগুড়িরই বিধান মার্কেটের কল্পনা কিংবা পানিট্যাঙ্কি মোড়ের কল্পতরু হোটেলের অবশ্য এখনও নামডাক কম নেই। জাম্বো চিতল পেটি, থাবার মতো আড়, বড় প্লেটেও না ধরা পাবদা, ইয়া বড় চিংড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু কালেভদ্রেই খাওয়া যায়, রোজ রোজ নয়।

কথিত আছে, কল্পনা হোটেলের বৃদ্ধ মালিক রোজ বাড়ি থেকে টিফিন কেরিয়ার করে খাবার নিয়ে আসেন দেখে এক জন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার হোটেলের এত নামডাক আর আপনি বাড়ি থেকে খাবার আনেন?” বৃদ্ধের সোজাসাপটা জবাব, “ওই সব খাইয়া মরুম নাকি?”

তবে এক সময়ে বিধান রোডেরই আর এক দিকে, গলির ভিতরে দাদাভাই হোটেলে নিয়মিত খেলেও মরতে হয়নি। কত নম্বর টেবিলে কত টাকা বিল হল, তা নিয়ে মালিকের দুই ছেলে নিজেদের মধ্যে উঁচু গলায় ‘দাদা’ ও ‘ভাই’ সম্বোধন করে কথা বলেন।

স্বাদের উৎকর্ষ হয়তো ততটা নেই, কিন্তু চাপিলা মাছের সর্ষেবাটা, বেসন দিয়ে কুমড়োপাতার বড়া, তিনকাঁটা মাছের চচ্চড়ির মতো চমকপ্রদ রান্না ওখানেই পাওয়া গিয়েছে কাঁসার থালায়। এক দিন ওই হোটেলেই পাওয়া গেল লুপ্তপ্রায় এক বাঙাল রান্না। টাকা নেওয়ার সময়ে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মালিক ভদ্রলোকের প্রশ্ন, “কেমন খেলেন কাঁঠাল বিচি-চিংড়ি মাছ?”

কিছু পাইস হোটেলের যত্নআত্তি এমনই পর্যায়ের যে খদ্দেরের মনে হয়, বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়িতে বসে খাচ্ছেন। এক বার ডুয়ার্স গিয়ে ভয়ঙ্কর ডায়েরিয়া বাঁধিয়ে, সেই অবস্থাতেও কলকাতা ফেরার দিন যেতে হয়েছিল শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি রাস্তার জলপাই মোড়ের ঊষা হোটেলে। বহু বার সেখানে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে শিউলি ফুলের মতো ভাতে ছড়ানো ঘি, আলুর চিপ্স, উচ্ছে সাঁতলানো, বিন্স-এর তরকারি এবং আদা-জিরেবাটা ও বড়ি দিয়ে রাঁধা মনোমোহিনী আড় মাছের ঝোল। সে দিন পরিবেশনকারী খদ্দেরের দুরবস্থার কথা জেনে ভাত, কাঁচকলার তরকারি, পাতলা ডাল আর হাল্কা রুই মাছের ঝোল টেবিলে এনে শাসনের সুরে বললেন, “ঘি আর আলু ভাজা দিইনি কিন্তু। চাইলেও আজ ও সব দেব না।”

ঠিক এমনই আন্তরিকতা মালবাজারের বাপিদার হোটেলে। বাপিদা, মানে হোটেল মালিক নিজে টেবিলে টেবিলে গিয়ে তদারকি করেন, পরামর্শ দেন। শাকভাজায় ঢালার জন্য কাসুন্দির শিশি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পরিবেশনকারী।

ভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ দেওয়া মুসুর ডাল, আলু ভাজা ও নটে শাক ভাজা কম্পালসারি। কিন্তু মাত করে দেয় আর এক কম্পালসারি আইটেম—আলু-বেগুন দিয়ে কুচো বোরোলি মাছের শুকনো চচ্চড়ি। এ জিনিস ভূভারতে আর কোথাও সম্ভবত পাওয়া যায় না। একবার বাপিদা জবরদস্তি ইলিশ খাওয়ালেন বে-মরসুমে, ফেব্রুয়ারি মাসে। অত বড়, অত স্বাদু ইলিশ গত দেড় দশকে ঘনঘোর বর্ষার কলকাতাতেও মেলে কি না জানা নেই!

এটা মেনে নেওয়া ভাল, কলকাতা তার ঐতিহ্যের পরিচায়ক অনেক কিছুই হারিয়েছে। ফারপোস, মেট্রো সিনেমা, স্কাই রুম...। সেই অর্থে কলকাতার পুরনো ভাতের হোটেলগুলোর অস্তিত্ব নেই, তা বলা যাবে না। হোটেল সব আছে বহাল তবিয়তেই। তবে তার খাবারের মান ধুলোয় লুটোচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement