অনিন্দ্য বিবেকানন্দ

‘বিলে’ নাটকটি দেখে এলেন মনসিজ মজুমদারলোককৃষ্টির ছাব্বিশতম জন্মদিনে মঞ্চস্থ হল স্বামী বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে ‘বিলে’ (নাটক: উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, পরি: ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়)। ডকু-ড্রামা বা জীবনী নয় কিন্তু বিলে, নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং বিবেকানন্দ – এই তিন পর্যায়ের জীবনকথার সারাংশের সুষ্ঠু নাটকীয় উপস্থাপনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

লোককৃষ্টির ছাব্বিশতম জন্মদিনে মঞ্চস্থ হল স্বামী বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে ‘বিলে’ (নাটক: উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, পরি: ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়)। ডকু-ড্রামা বা জীবনী নয় কিন্তু বিলে, নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং বিবেকানন্দ – এই তিন পর্যায়ের জীবনকথার সারাংশের সুষ্ঠু নাটকীয় উপস্থাপনা। প্রথমে ছেলেবেলার বিলের সঙ্গে এবং পরে নিবেদিতার সঙ্গে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের সংলাপ সূত্রে মঞ্চদৃশ্যে উঠে আসে জীবনের প্রধান ঘটনাবলি, শিকাগোয় স্বামীজির বক্তৃতা বা রামকৃষ্ণের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ ও ক্রমশ বিবেকানন্দ হয়ে ওঠা। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই ও সামাজিক অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ, গুরু ও ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ – সব কিছুর নাটকীয় অভিঘাতে দেবশঙ্কর হালদারের বিবেকানন্দ এক সৌম্য ঋজু ব্যক্তিত্ব, আবার এক অনমনীয় সাহসী ও তেজস্বী চরিত্র যার সমস্ত লক্ষণই ছিল বালক বিলের মধ্যে, তাই নায়ক বিলে ও বিবেকানন্দ।
বিবেকানন্দের জীবন ও বাণী, তাঁর স্বচ্ছ মানবতাবাদী সাধনার যা কিছু সাধারণভাবে দর্শক জানেন তার সবটুকুই মঞ্চের স্বল্প পরিসরে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু নাটক হয়ে ওঠার জন্যে যা প্রয়োজন এই প্রযোজনা কিন্তু পূর্ণ করে না। তাঁর ভাবনার দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধিতার প্রশ্ন তোলেন মঞ্চের যুক্তিবাদী নিবেদিতা। হয়তো আত্মজিজ্ঞাসার এইটাই নাটকীয় রূপ। কিন্তু মঞ্চের বিবেকানন্দ অটল থাকেন নিজের অবস্থানে এক পরিচ্ছন্ন আত্মবিশ্বাসে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক মননশীল মনীষী হয়ে ওঠেন কোনও দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আত্মজিজ্ঞাসার মোকাবিলা না করেই। নাটকে তিনি অনায়াসে উত্তীর্ণ হন সংশয় থেকে বিশ্বাসে, যুক্তিবাদ থেকে গুরুবাদে, সমাজচেতনা থেকে অধ্যাত্মচেতনায়। বিবেকানন্দের এই অনিন্দ্য প্রতিমূর্তির পাশে অনেক বেশি সজীব ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের রামকৃষ্ণ। এত দিন সিনেমায় নাটকে রামকৃষ্ণের যে টাইপ দেখা গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। তেমনি জীবন্ত গুড্ডুর চঞ্চল দুরন্ত নির্ভীক বিলে। সংক্ষিপ্ত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করেছেন নিবেদিতার ভূমিকায় মোনালিসা।

Advertisement

Advertisement

সীতার দুঃসময় এখনও

সুরঞ্জনা দাশগুপ্তের ‘সীতা থেকে শুরু’ নাটকে

নারী অবমাননা নির্যাতনের শুরু সেই রামায়ণের সীতার সময় থেকে। এই বার্তার মধ্যে নতুন কিছু নেই। তবে অভিনব নাটকটির উপস্থাপনা। নবনীতা দেবসেন রচিত কাহিনীগুলির (রাজকুমারী কামবল্লী, মূল রামায়ণ, অমরত্বের ফাঁদে, সীতা থেকে শুরু) মধ্যেই রয়েছে। গল্পগুলিকে যে স্বতঃস্ফূর্ততায় গাঁথা হয়েছে তা চমৎকার! এই শল্যচিকিৎসার কাজটি নিপুণ হাতে সামলিয়েছেন নাট্যকার সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত। সংলাপ ব্যবহারে মুন্সিয়ানা আছে।

মঞ্চপ্রয়োগ ও পাপেটের ব্যবহারে নীল-কৌশিকের কাজ নজর কাড়ে। মাঙ্কি টুপি মাথায় দিয়ে হনুমান ও তার দলবলকে মঞ্চে হাজির হতে দেখে আহ্লাদে আটখানা দর্শক। গেরুয়া বসনধারী একটি মেয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই দর্শক বলে ওঠেন সীতা! মহাভারত, ইলিয়ড-ওডিসি কিছুই এখন বাংলা মঞ্চে দুর্লভ নয়। কোরিওগ্রাফির কাজে সাধুবাদ পাবেন অঞ্জন দেব। কয়েকটি চিত্রকল্প ভোলা যায় না। হনুমানের লঙ্কাযাত্রার জন্য আকাশে ওড়া কিংবা রকেটাকৃতি ধারণ করে সীতাকে সঙ্গে নিয়ে মহেন্দ্রপর্বতের উদ্দেশে উড়ে চলা এবং সেখানে রাম-সীতার আকস্মিক মিলন ঘটানো চমৎকার ছবি!

অভিনয়ও বেশ ভাল। বাল্মিকী বেশে কমল চট্টোপাধ্যায় এলেন, দেখলেন, জয় করলেন! শর্মিলা মৈত্র-র নারদ, অরুক সোম-এর লক্ষ্মণ সুন্দর। দুর্দান্ত শরীরী ব্যঞ্জনায় নজর কাড়েন রামরূপী অনির্বাণ ঘোষ। হনুমানের ভূমিকাভিনেতা যেন আরও একটু শক্তিশালী অভিনয়ের দাবি রাখেন। লব-কুশ এর ভূমিকায় দুই কিশোরী মাতিয়ে দেন। নাটকটির দুর্বল অংশ কোরাসের অভিনয়, যা আরও জোরালো হতে পারত। দুটি প্রধান নারী চরিত্র সীতা ও শূর্পণখা। এই দুই চরিত্রে কথাকলি এবং নন্দিনী ভৌমিক উভয়েই চিত্তাকর্ষক আর সমান দাপুটে।
নির্দেশকের এক একটি মোচড় নাটকটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আগুনে ঝাঁপ দিতে গিয়ে নারদের অমরত্বের প্রতিশ্রুতিতে সীতা যখন ফুঁ-দিয়ে সেই আগুন নিভিয়ে দেন তখন দর্শক করতালিতে ফেটে পড়েন। এ করতালি নির্দেশকের প্রাপ্য। মুহূর্তে মঞ্চ রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় একটি রক্তাক্ত কাপড়ের ব্যবহারে। সেই কাপড়টি নিয়েই কুশীলবেরা নাচতে নাচতে বেরিয়ে যান, যেন কোনও বিনোদনের উপচার নিয়ে চলেছেন তারা। চোখের পলকে কমেডি থেকে ট্র্যাজেডি আবার ট্র্যাজেডি থেকে কমেডিতে যাতায়াত আছে এ নাটকে। সেই যাত্রাপথে যেতে যেতে গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের অসহায়তা। হাসতে হাসতে সেই অসহায়তার মধ্যে দিয়ে যান সুরঞ্জনা।

আসল খুনি কে

উদয়নীল ভট্টাচার্যের নাটক ‘ওয়াইন ফ্লু’

পিনাকী চৌধুরী

সম্প্রতি তপন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হল গণকৃষ্টি প্রযোজিত উদয়নীল ভট্টাচার্যের নাটক ‘ওয়াইন ফ্লু’। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং ঘুণ ধরা সমাজের দিকে আঙুল তোলা সাহসী নাটক। নিজের মুনাফার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। তার জন্য জনগণকে তো একা ধোঁকা দেওয়া যায় না। এই ত্রিফলা আক্রমণে সাধারণ মানুষ একটা আপাত রঙিন গোলক-ধাঁধাতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। মনে হয় সে চলছে, কিন্তু সে চলার কোনও পথ নেই। একই অবস্থায় সে থেকে যায়। একই সঙ্গে থাকে ত্রিকোণ মিথ্যেজীবিতা। এই চিত্র সমাজেরই একটি দিক। আর তা ছোট হোক বা বড়।

নাটকের শুরুতেই দেখা যায় সমৃদ্ধ চৌধুরী তার দাদুর একপাটি ভেষজগুণ সম্পন্ন বিশেষ ধরনের জুতো বাইপাসের ধারে হারিয়ে ফেলে। দু’জন গোয়েন্দা সূক্ষ্ম এবং সুতনুর দ্বারস্থ হন। গোয়েন্দারা অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। ওদিকে দেখা যায় যে, সবাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, যারা কিনা কোনওদিন এক ফোঁটাও অ্যালকোহল গ্রহণ করেননি। এদিকে বিত্তশালী সমৃদ্ধ চৌধুরী তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ‘জর্দা প্লাস’ নামক একটি নতুন ব্যান্ডের মদ বাজারে আনেন, যার উদ্বোধন করেন মান্যগণ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জীবনসুধা পান। সমৃদ্ধ আমন্ত্রণ জানান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিশলয়কেও। দেখা যায়, পুরো কলকাতা শহরটাই প্রায় অ্যালকোহলিক হয়ে পড়েছে।

নাট্যকার উদয়নীল ভট্টাচার্য অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। কারণ নাটকের মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে আর একটি নাটক! গোয়েন্দা সূক্ষ্ম এবং সুতনু রহস্য ভেদ করতে গিয়ে দেখেন যে, সমৃদ্ধ চৌধুরীই তাঁর দাদুর আসল হত্যাকারী। দারুণ ক্লাইম্যাক্স। নাটকের সবচেয়ে বড় মূলধন টিমওয়ার্ক। অনবদ্য অভিনয় করেছেন তীর্থঙ্কর মুখোপাধ্যায়, সোমা দত্ত, দীপক দাস, স্বর্ণেন্দু সেন, ইন্দ্রজিৎ সিংহ। ভাল লাগে মালা (সোমা দত্ত) এবং সমৃদ্ধ (অর্ণব ভদ্র) এবং দিতিপ্রিয়া (লোপামুদ্রা গুহ নিয়োগী) কে। নির্দেশনায় অমিতাভ দত্ত।

নাটকের মঞ্চ ভাবনায় অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন স্বর্ণেন্দু সেন ও তাপস মিল। বিশেষত ম্যাসাজ পার্লার, যেখানে পুরো ষড়যন্ত্রটা তৈরি হচ্ছে আর সেখানে চুপিসাড়ে মশা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি ফ্রেমের সাহায্যে যে অনবদ্য জটিল গোলক ধাঁধার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। সুদীপ সান্যালের আলো নাটকটিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আবহ ও সঙ্গীত পরিচালনায় পিলু ভট্টাচার্য।

এ কেমন বাঁচা

‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ নাটকে। দেখলেন পিয়ালী দাস

জীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তির বেদনা আছে। তবুও স্বপ্ন আর আশা জীবনকে ঘিরে রাখে। কিন্তু জীবনের সমস্ত রং যখন হারিয়ে যায়, বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এমনিভাবেই তো বেঁচে আছেন কত মানুষ। কারও মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে, কারও বা মস্তিস্ক সচল কিন্তু শরীর অসাড়। সে রকমই মানুষের প্রতিনিধি পলাশ। যার শরীরটাই পঙ্গু। ‘নয়াবাদ তিতাস’ নাট্য গোষ্ঠীর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘স্বেচ্ছা মৃত্যু’ নিয়ে নাটক ‘পেশেন্ট ফোর সি’। ব্রেইন ক্লার্ক-এর ‘হুউজ লাইফ ইজ ইট এনিওয়ে’ অবলম্বনে।

পলাশ একজন ভাস্কর। রোম্যান্টিক মন আর প্যাশন নিয়ে বাঁচেন। আচমকা এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান। জীবনে আসে চরম বিপর্যয়। পলাশের মস্তিষ্ক, চেতনা সজাগ থাকলেও কোনও দিনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন না। জীবনকে ভালবাসেন, তাই জীবনের অমর্যাদা করে এই পঙ্গুত্বের জীবন বহন করতে চান না। একসময় পলাশ উকিলের দ্বারস্থ হন স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানিয়ে। আমাদের দেশে ইউথানাসিয়া আইনসিদ্ধ নয়। তাই সম্ভব নয় স্বেচ্ছামৃত্যু। এদিকে ড. রায় চৌধুরীও স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘোরতর বিরোধী। পলাশের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। এই ঘটনায় প্রকট হয় দুর্বলের ওপর সবলের প্রভাব বিস্তার।

উমা বসু, শর্বরী মুখোপাধ্যায়, সুশান্ত জানা, লোকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের অভিনয় মনে দাগ কাটে। বিশেষভাবে বলতে হয় পলাশ চরিত্রে আবিরের কথা। নাটকের নির্দেশনা, মঞ্চসজ্জাও তাঁর। নাটকের শেষ দৃশ্যও অভিনব। যেখানে বিচারের ভার দর্শকদের ওপরেই আরোপ করা হয় ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ কাম্য কি না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement