শিল্পধর্ম পালনে অনন্ত নরকেও যেতে রাজি

তাঁর প্রবন্ধ পড়ে আনন্দিত রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে জানান মনের কথা। বিষ্ণু দে তাঁকে তুলনা করেন পাবলো পিকাসোর সঙ্গে। সরল বলিষ্ঠতাই যামিনী রায়ের ছবির প্রাণ। লিখছেন শিশির রায়তাঁর প্রবন্ধ পড়ে আনন্দিত রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে জানান মনের কথা। বিষ্ণু দে তাঁকে তুলনা করেন পাবলো পিকাসোর সঙ্গে। সরল বলিষ্ঠতাই যামিনী রায়ের ছবির প্রাণ। লিখছেন শিশির রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

আচ্ছা, শোন, তোমাদের ঐ ঠাকুরঘরে সবাই কেন জুতো পায়ে আসে? তুমি বারণ কর না কেন?’— ছোট্ট মেয়েটি তাঁকে প্রশ্ন করল।

Advertisement

রুপোলি-সাদা একমাথা-চুল বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি মোড়া পেতে বাড়ির সামনে মাঠে বিকেলের ছায়ায় বসে থাকেন। কখনোই প্রায় বাইরে যান না। সকাল থেকে বিকেল একটানা ঘরে বসে কাজ করেছেন। সন্ধে ঘোর হলেই গিয়ে কাজে বসবেন। এত কী কাজ তাঁর? ছোট্ট মেয়েটি রোজ তাঁকে দেখে। আর দেখে সব বাড়ি থেকে আলাদা দেখতে ঝকঝকে মেঝে আর মস্তো-মস্তো জানলা দেয়া এই বাড়িটার ঘরে-ঘরে, দেয়াল ঘেঁষে সার-সার সাজানো ছবি। কী তার রঙ! এমনটি সে দেখেনি। ঠাকুর-ঘর?’

তখন সিগনেট প্রেস থেকে প্রতি মাসে বেরোত ‘টুকরো কথা’— বাংলা বইয়ের পরিচিতিমূলক মাসিক বার্তা। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পা দিয়েছেন পঁয়ষট্টিতে, ১৯৫২ সাল সেটা। ‘টুকরো কথা’য় কবি-সম্পাদক নরেশ গুহ লিখেছিলেন অপূর্ব এক শ্রদ্ধার্ঘ্য, তারই শুরুতে ছিল ছোট্ট সেই মেয়ে আর বর্ষীয়ান শিল্পীর গল্প। সেই শিল্পী— যামিনী রায়, সে দিন শিশুর মুখের প্রশ্ন শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর ছবি আঁকার ঘরে কত শিল্পবোদ্ধা রসবেত্তা আসেন, এমন সহজ করে তো কখনও বলেননি কেউ! শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নরেশ গুহ লিখছেন, ‘মেয়েটি জানল না তার নিষ্পাপ শিশুমন যামিনী রায়ের আশ্চর্য রচনাকে যথার্থ মর্যাদা জানিয়ে অজ্ঞাতসারে সারা দেশের মুখরক্ষা করল।’

Advertisement

যাঁর ছবির ঘরকে ঠাকুরঘর বলে ভ্রম (না কি বিশ্বাস?) হয়, তাঁর ছবি যে বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পাবে, আশ্চর্য কী! বঙ্গভূমি বিশ্ববিশ্রুত বহু চিত্রশিল্পীর জন্ম দিয়েছে, কিন্তু বাঙালি যে ভাবে বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ বোঝে, সত্যজিৎ বা হেমন্তকে বুকে রাখে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে গলা ফাটায়, সে রকম করে নিজভূমের স্বনামধন্য চিত্রকরদের জানার তাগিদ তার কোথায়? তবু আর কেউ না হোক, যামিনী রায় তাকে আকর্ষণ করে। আলটপকা যে কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, যামিনী রায়কে খুঁজে পাওয়া যাবেই। তিনি আছেন বাঙালির দেওয়ালে, সস্তার নড়বড়ে বাঁধাইয়ে, ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে, নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তার ছবিতে, বিয়ের কার্ডে, মেলায়। কে জানে, হয়তো ঠাকুরঘরেও! যে বাঙালি রাজনীতির তত্ত্ব বোঝে কিন্তু ছবির তত্ত্ব বুঝতে চায় না, সেও ঘরে রাখে যামিনী রায়ের ছবি, জেনে বা না জেনেই। ওঁর ছবির সরল বলিষ্ঠতা এখনও বাঙালির গৃহসজ্জায় কুটোবাঁধা।

ক্রুশবিদ্ধ জিশু

সরল বলিষ্ঠতা! প্যারাডক্স মনে হলেও এটাই সত্যি— তাঁর ছবি ও জীবন, দুই ক্ষেত্রেই। বিষ্ণু দে’র লেখায় ধরা আছে বাঁকুড়ার বেলেতোড়ের দেশজ মানুষটির দৃঢ় মতামতের কথা। স্বাধীনতার ঠিক পরে, তখনকার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন যামিনী রায়ের বাড়িতে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের পোর্ট্রেট-আঁকিয়ে শিল্পী কী যে দেখলেন নেতার মধ্যে, বিচলিত হয়ে উঠলেন রাজ্যের মঙ্গলের বিষয়ে। চিন্তিত গলায় বললেন, ‘‘না মশায়, আপনাকে দিয়ে তো হবে না। আপনি রাজ্য চালাতে পারবেন না।’’ বিষ্ণু দে লিখছেন, ‘আসলে মানুষের গোটা ব্যক্তিত্বই জাতশিল্পীর চোখে প্রত্যক্ষ’; তার পরেই অন্তিম মন্তব্য: ‘এবং ঐ রাজনীতি-ধুরন্ধর সত্যিই দেশের উপকার করতে পারেন নি।’ আবার কমিউনিস্ট নেতা হীরেন মুখোপাধ্যায় এসেছেন শিল্পীর স্টুডিয়োয়, যামিনী রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি ভেবেছেন, আমাদের পুলিশের পোশাক, পাগড়ি বা টুপি কী রকম হবে?’ হীরেনবাবু বললেন, ‘আমরা ওই একটা ডিটেলের ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত ভাবিনি।’ যামিনী রায় উত্তেজিত, ‘ওটা একটা ছোট্ট ডিটেল্‌? আপনারা বিশ্বাস করেন যে আপনারা একটা ভাবী পরিকল্পিত সমাজ ভাবতে পারেন। নিজের মনে ছবিটা না ভেবে, অন্তত খানিকটা... পুলিশের সাজপোষাক, সেটা কি হবে? এরকম ভাবে চললে আপনাদের শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন একেবারে ঘোঁট পাকিয়ে যাবে।’

যামিনী রায় এমনই। স্পষ্ট। দৃঢ়। সহজ এক মানুষ। বুদ্ধদেব বসুর লেখায় আছে তাঁর বাগবাজারে আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের বাড়ির বর্ণনা। ‘অমৃতবাজারের কালাঙ্কিত কার্যালয়গুলি পেরিয়ে উল্টোদিকে থাকেন যামিনী রায়... একতলায় চারখানা কি পাঁচখানা ঘর নিয়ে তাঁর রাজত্ব... এখানেই তিনি দিনমান কাটান ঋতুর পর ঋতু প্রতিটি দিন; ছবি আঁকেন, ছবি ভাবেন, কেউ এলে কথা বলেন ছবি নিয়ে— যে-কোনো সময় আগন্তুকের তিনি অধিগম্য।’ এক সময় উত্তর কলকাতার পাট উঠিয়ে চলে এলেন শহরের দক্ষিণে বালিগঞ্জে, ডিহি শ্রীরামপুর লেনে। নতুন বাড়ি হল বটে, কিন্তু নিজের বাড়ি হল কি? অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সাক্ষাৎকারে ধরা আছে শিল্পীর কণ্ঠস্বর: ‘আগে যে ভাড়ার বাড়িতে থাকতাম তখন নিজের বাড়ি মনে করার কোনো কারণ তো ছিল না, তারপর যখন নিজের বাড়ি হল... কোনোরকমে কিন্তু একবারও মনে হয় না যে এটা আমার বাড়ি। কেবলই মনে হয়, এর গড়নটি তো ঐ আমার মাথা থেকে আসে নি... আমরা ওদের মতো কতকটা গড়েছি। তার জন্য আমি শুধু এইটুকু নীচের টুকুন ব্যবহার করি, ওপরটা ব্যবহার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’ শিল্পজীবন আর ব্যক্তিগত জীবনের মিলমিশ নিয়ে যত তত্ত্বচর্চা, সব কিছুকে স্তব্ধ করে দেয় এই চারিত্রিক সংহতি। ঋষিকল্প সনাতন কৃচ্ছ্রতাকে জীবনে মিশিয়ে নিয়েই তাঁর ছবি আঁকার সাধনা।

এই যে মাটির কাছাকাছি নয়, মাটিতেই বাঁচা, এ জিনিস তাঁর রক্তে। তাঁর পূর্বপুরুষ যশোরের প্রতাপাদিত্য রায়ের বংশজ, ভাগ্যের ফেরে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাঁকুড়ার মল্লরাজার রাজ্যে। কিন্তু রাজানুগ্রহ না গলগ্রহ হয়ে দাঁড়ায়, তাই চলে গিয়েছিলেন বনাকীর্ণ ভূমির গহনে। যামিনী রায়ের স্মৃতিচারণায় আছে তাঁর বাবা রামতারণ রায়ের কথা। সরকারি চাকরি করতেন, ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে এসে চাষির জীবন শুরু করলেন। ইংরেজি-জানা, ব্রহ্মসংগীত-গাওয়া মানুষটা তুলোর চাষ করতেন, নিজের হাতে সুতো তৈরি করে গ্রামের তাঁতিদের দিয়ে ধুতি-শাড়ি বানিয়ে নিতেন ঘরের লোকেদের জন্য। সচ্ছল পরিবার থেকে আসা তাঁর স্ত্রী নগেন্দ্রবালাও হাসিমুখে মানিয়ে নিয়েছিলেন গ্রামীণ জীবন। নিজে হাতে খাবার বয়ে নিয়ে যেতেন খেতখামারে। যামিনীর বাবা সরষে, তিল চাষ করতেন, গরু-ছাগল, ভেড়া-মোষ পুষতেন। গ্রামের কাছেই ঘন জঙ্গলে বুনো জন্তুজানোয়ারের বাস, গৃহপালিত পশুগুলির রক্ষায় নিজেও শুতেন মূল বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে, ছাউনিতে বা গোশালায়। শিশু যামিনী বাবার সঙ্গেও ঘুমোতে চাইতেন, আবার বুনো জন্তুর ভয়ে কাঁদতেনও খুব। বাবা আশ্বাস দিতেন, এই দ্যাখো আমার পাশে দা, তোমাকে কোনও জন্তুই কিছু করতে পারবে না। চাষিরা, স্থানীয় বাউরিরা তাঁর প্রিয় ছিল। অদ্ভুত মানুষটি বলতেন, আমাদের সকলের এক হাতে যেন বই, অন্য হাতে লাঙল।

মা ও শিশু

গ্রামের কিশোরের বড় হয়ে ওঠায় মিশে গেল গ্রামের প্রতিমাশিল্পীদের কাজ, কাঁথার বুনন, উৎসবে দেওয়া আলপনার নকশা। কারিগর, ছুতোর, কুমোর, পটুয়াদের কাজ কাছ থেকে দেখাটাই শিল্পের ভিত গড়ে দিয়েছিল। যামিনীর প্রতিভা নজরে পড়েছিল মুসলমান জেলা-প্রশাসকের, তিনিই ব্যবস্থা করেছিলেন ষোলো বছরের ছেলেটা যাতে কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারে। বিশ শতক শুরুর সেই কলকাতায় যামিনীর বড়দাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। শৌখিন তিনি, মোটরগাড়ি চাপেন, দামি জুতো পরেন। যামিনী কিন্তু দাদার বিলাসী আশ্রয়ে উঠলেন না, উত্তর কলকাতায় বাসা ভাড়া নিলেন। ভাই রজনীকে রাখলেন নিজের কাছে। দীর্ঘ পথ হেঁটে আর্ট স্কুলে যেতেন, আর ছবি আঁকা-শেখার পাশাপাশি সেই বয়স থেকেই তাঁর রুটি-রুজির সন্ধান। কত বিচিত্র কাজ যে করেছেন! দাদার বইয়ের ব্যবসা, দোকানে বই পৌঁছে দিয়ে আনা চারেক মিলত। ইহুদি ব্যবসায়ীর অর্ডারি কার্ড এঁকেছেন, একশো কার্ড আঁকলে দশ-বারো আনা, তাতে এক প্লেট ভাত মেলে। উত্তর কলকাতার এক বাড়ির রোয়াকে বসে লিথোগ্রাফির কাজ করেছেন। বটতলা পাড়ায় কঞ্চি-বাঁশ ছুলে বড় বড় গরানহাটা এনগ্রেভিং ছবির বর্ডার রং করতেন, সে কাজে তাঁর সঙ্গী ও দর্শক পাড়ার ঠিকে ঝি’রা! ‘সীতা’ নাটকে স্টেজের ‘সিন’ এঁকেছেন, এঁকেছেন দোকানের টিনে। শ্যামবাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ করেছেন, শাড়ি কেনাবেচা করতে গিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন নানা পেশার মানুষের রঙের পছন্দ-অপছন্দ!

আর আর্ট স্কুলের ক্লাসে? ভাইস-প্রিন্সিপাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছাত্র ইউরোপীয় শিল্পরীতির অনুসরণে পোর্ট্রেট, ক্ল্যাসিকাল ন্যুড, তেলরং-ছবি আঁকেন মন দিয়ে। সাহেব প্রিন্সিপাল একদিন ক্লাসে এসে দেখেন, যামিনী ক্লাস না করে জানালার খড়খড়ি তুলে চৌরঙ্গির বহমান জীবন দেখছেন। এ ভাবে সময় নষ্ট করছ! অকুণ্ঠ তরুণ বলেন, ক্লাসে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে হবে, কিন্তু বাইরের দৃশ্য তো বিরাট বিশাল, তাই তাকে এই খড়খড়ির ফ্রেমে আটকে দেখছি! ইতালীয় এক শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্রদের প্লাস্টার মডেল নকল করতে হত। ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ হদ্দ-নিচু বেঞ্চি, আর লম্বা সাহেব টহল দিতে দিতে ‘এটা হয়নি’, ‘ওটা হল না’ মন্তব্য করতেন। যামিনী এক দিন সটান বললেন, ‘আপনি দাঁড়িয়ে ওই উচ্চতা থেকে সব দেখছেন আর আমরা ড্রয়িং করছি নিচু বেঞ্চিতে বসে। দু’তরফের দেখা দু’রকম, আমরা কী করে আপনার দেখাটা দেখব?’ ১৯০৮-এ ডিপ্লোমা নিয়ে বেরোচ্ছেন যামিনী রায়, তার আগে থেকেই আর্ট স্কুলের দেওয়ালে তাঁর আঁকা বহু ছবি টাঙানো! ছাত্র থাকাকালীন অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে পাঠাচ্ছেন জোড়াসাঁকো়য় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট আঁকতে!

কৃষ্ণ ও বলরাম

লোকে তাঁকে লৌকিক আঙ্গিকেই বাঁধতে চায় শুধু, জানে না কী পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি চালিয়ে গিয়েছেন নিরন্তর, ছবির বিষয়ভাবনা, রূপ আর রঙের ব্যবহার নিয়ে। একুশ বছর বয়সেই তিনি ইউরোপীয় রীতিতে সুদক্ষ এক ভারতীয় চিত্রকর। পোর্ট্রেট বা প্রতিকৃতিচিত্রে অতুলন, আবার ল্যান্ডস্কেপ আঁকেন অনবদ্য। অশোক মিত্র ‘পরিচয়’ পত্রিকায় যামিনী রায়ের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘তাঁর ল্যান্ডস্কেপে ঝড়জল নেই, অগ্নিদগ্ধ দিন, এমনকি দিগন্তবিস্তৃত মাঠও নেই।’ বিষ্ণু দে তার উত্তরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, ‘আমি অন্তত কিছুতেই ভুলতে পারি না সংখ্যায় শতাধিক সেইসব বহির্দৃশ্যচিত্র— বাঁকুড়ার দিগন্তবিস্তৃত ঊষর মাঠ, সাঁওতাল-দেশের পাথর-মাটির ঢেউ, ধানখেতে লাঙল-চাষী, থৈথৈ বাদল-জলে মেয়েদের বীজরোপণ, রৌদ্রে ঝকঝকে বৃক্ষছায়াঘন মাঠপথবাড়ি, আলোছায়ায় প্রতীক্ষারত বস্তির ছবি...বাগবাজারের গঙ্গায় বোঝাই নৌকা, টিনের শেড আর মেঘবিদ্যুতের ঘনঘটা বা আলোর দীপ্তি, টলোমলো জলধারা, নৌকায় পার্থিব কিন্তু অসীমে উধাও রহস্যময় জলরাশি, পাহাড় রেললাইনে স্টেশনের দুরন্ত বাঁক, দক্ষিণেশ্বরের বটগাছ, সুস্থ শহরের আদর্শ বীথি ও বাসাবাড়ি— কত বলা যায়...’ মনে করিয়ে দেন, যামিনী রায় যখন তাঁর ছবিতে তেলরং নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন, সেই সময়ের ছবি দেখে খুশি হয়ে কিনে নিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।

স্বেচ্ছায় আনপথে গিয়ে শিল্পী যামিনী কখনও আঁকেন সাঁওতাল বিষয়বস্তু নিয়ে একের পর এক ছবি, কখনও বাইজেন্টাইনীয় ঘরানায় তাঁর সুবিখ্যাত বাইবেল সিরিজ। একদিন উপলব্ধি হয় তাঁর, তিনি যা চোখে দেখেছেন তা এঁকেছেন নিপুণ মনে আর হাতে, কিন্তু যা অনুভব করেছেন তা নিয়ে পরীক্ষা এখনও হয়নি কিছুই। তখন ছবি-আঁকার রং তৈরি করলেন মাটি গুঁড়িয়ে তেঁতুল-আঠা বা ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে। বিষ্ণু দে’র ভাষায়, ‘ধূসর তিনি আনেন নদীর পলিমাটি থেকে, সিঁদুর-রঙ পান মেয়েদের পুণ্যাচারের সিঁদুর থেকে, নীল তো চাষের নীল, আর শাদা হচ্ছে সাধারণ খড়ির রঙ এবং কালো তিনি মেশান সুলভ ভুষো থেকে।’ তিনি ছবি আঁকেন খবরকাগজে, চটে চাটাইয়ে, ছেঁড়া কাপড়ে, তালপাতা-নারকেলপাতায়, এক ছবি মুছে দিয়ে তার উপরেই আঁকেন অন্য ছবি। আবার তাঁর অসামান্য কীর্তি রামায়ণ সিরিজ আঁকেন উত্তর কলকাতার ‘রসগোল্লা ভবন’-এর লম্বা হলঘরে বসে।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে

শিল্পীর এই নিজেকে পালটে নেওয়ার ইতিহাস ধরা আছে যামিনী রায়ের নিজস্ব কথনেও। স্টারে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার পথে এক দিন বন্ধুর বাড়িতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের একটা বই পেয়ে হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে কী যে ঘটে গেল! চৈতন্যদেবের সুভক্ত পার্শ্বচর স্বরূপ দামোদরের কথা লেখা সেখানে। পুব বাংলা থেকে এক মহাপণ্ডিত চৈতন্যদেবকে উৎসর্গ করে একখানি বই লিখে এনেছেন, স্বয়ং মহাপ্রভুকে শোনাতে চান। কিন্তু আগে সেন্সর-রূপী স্বরূপ দামোদরকে পেরোতে হবে। দামোদর-সহ সব পণ্ডিতের সভা বসল, তাঁদের সবার ভাল লাগলে মহাপ্রভুর কাছে যাওয়ার ভিসা মিলবে। গ্রন্থলেখক পণ্ডিত শুরুর শ্লোকটি পড়লেন, তাতে বলা হচ্ছে, চৈতন্যদেব ‘দারুব্রহ্মতুল্য’। সভা ‘সাধু সাধু’ করে উঠল। স্বরূপ দামোদর নির্বিকার, একটি শব্দ শুধু বললেন, ‘কাকবিষ্ঠাতুল্য’। সবাই হতভম্ব। স্বরূপ দামোদর বললেন, এই যে জীবিত কোনও ব্যক্তিকে দারুব্রহ্মতুল্য বলা, এ ব্যাপারটা আসলে কাকবিষ্ঠাতুল্য। গল্প পড়ে যামিনী রায় ভাবলেন, এই যে আমরা ইউরোপীয় গতে ছবি আঁকি, ওতে যত গুণই থাক, আদতে সেও যেন ওই রকম, ওই কাকবিষ্ঠাতুল্য! রাফায়েলের ছবির কথা মনে এল। জিশু-কোলে মেরি দাঁড়িয়ে আকাশে, অথচ ছবিতে তাঁর শেড, লাইট, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক মানুষের মতো— এ কী করে হয়? মনে হল, এই ছবি আর যা-ই হোক, ছবি হচ্ছে না। কোন পথে যেতে হবে, ঠিক হয়ে গেল মুহূর্তে।

শিল্পের সাধনে তিনি ছিলেন অনন্ত উৎসাহী এক ছাত্র। যখন খুব নাম হয়েছে, তখনও বলতেন, কাকে কী শেখাবেন! নিজেই এখনও শেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। রাতে নিজের ঘরে বসে ভুসো দিয়ে স্কেচ করছেন, পাশে ওঁর ছোট্ট ছেলে অমিয় (ডাকনাম পটল)। চার বছর মাত্র বয়স তখন, সেও আঁকছে। ছোট্ট ছেলের আঁকা ছবি দেখে শিল্পীর মনে হল, তিনি যা চাইছেন তা ওই শিশুর আঁকাতেই আছে। তক্ষুনি নিজের ছবি পালটে সেই রকম আঁকতে শুরু করলেন! আবার প্রেরণা পান রবীন্দ্রনাথেও, দাগ দিয়ে পড়েন ‘তপোবন’ প্রবন্ধ: ‘মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্যের সীমা নেই। সে তাল গাছের মতো একটি মাত্র ঋজু রেখায় আকাশের দিকে ওঠে না, সে বট গাছের মতো অসংখ্য ডালেপালায় আপনাকে চারিদিকে বিস্তীর্ণ করে দেয়।...’ বইয়ের মার্জিনে নোট লেখেন যামিনী রায়, ‘আমার মনের কথা আজ লিখায় পড়লাম...’

বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন যামিনী রায়। রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিস্তর সমালোচনার আবহে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধ পড়ে আনন্দিত কবি চিঠি লিখেছিলেন শিল্পীকে, ‘তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।’ কলকাতার এগজিবিশনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন, জিভে প্যারালিসিস, কথা বলতে পারেন না। যামিনী রায় দেখলেন, তাঁর আঁকা ছবি দেখে গগনেন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সরোজিনী নাইডু যামিনী রায়কে বলেছিলেন শিল্পবোদ্ধা হাসান শাহিদ সুরাবর্দির কথা। তাঁর বাড়িতে শোওয়ার ঘরে যামিনী রায়ের আঁকা গোপিনীর ছবি ছিল, দাঙ্গার সময় উন্মত্ত জনতা সব ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেল, যামিনী রায়ের ছবিতে হাত দেয়নি!

পদ্মভূষণ, ললিত কলা অকাদেমি সম্মান, গুগল ডুডলে কি মাপা যায় তাঁকে? বহুমুখী প্রতিভার নিরিখে পিকাসোর সঙ্গে তাঁর তুলনা করেছিলেন বিষ্ণু দে। সব ছাপিয়ে মনে পড়ে ভ্যান গঘ-এর সেই উক্তি, শিল্পীর জীবনযাত্রা মঠের ব্রহ্মচারী, গুহাবাসী তপস্বীর মতো, তাঁর মন্ত্র শুধু কাজ— সব সুখ-আরাম ত্যাগ। সেই বোধেরই পুনরুচ্চারণ করেছিলেন যামিনী রায়: শিল্পধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি অনন্ত নরকেও যেতে হয়, তিনি প্রস্তুত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement