Artist

বলা না বলার কথ্য

শিল্পী কাজ করেছেন প্রধানত মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলি নিয়ে। এক দিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য, অপর দিকে সেগুলিই যেন লৌকিক বা অলৌকিক উপায়ে তাদের প্রকৃতি পাল্টে ফেলেছে।

Advertisement

শমিতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:২২
Share:

আদিম: চারুবাসনা গ্যালারিতে প্রদর্শিত সমীর আইচের চিত্রকর্ম নিজস্ব চিত্র।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ছবি আঁকছেন সমীর আইচ। প্রথমে আকৃতিপ্রধান বা ফিগারেটিভ ছবি দিয়ে শুরু করে পরবর্তী জীবনে আধাবিমূর্ত বা সেমিঅ্যাবস্ট্রাক্ট ছবিতে উত্তরণ। এখন এক সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নিজের কথা বলেছেন। সমীরের আগের কাজের চেয়ে অনেক পাল্টে গিয়েছে এই ছবিগুলি। বিশেষত ফর্ম বা কাঠামো এবং কাজের মাধ্যম‌ও।

Advertisement

যোগেন চৌধুরী সেন্টার ফর আর্টসের চারুবাসনা গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর সব কাজই মিশ্র মাধ্যমে করা। অ্যাসিড ফ্রি ফেব্রিয়ানো কাগজের উপরে। ছোট ছোট কাজই বেশি। বড় কাজ চারখানা। শিল্পী এই সব কাজই গত আড়াই বছরে করোনার সময়ে গৃহবন্দি অবস্থায় সম্পন্ন করেছেন।

শিল্পী কাজ করেছেন প্রধানত মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলি নিয়ে। এক দিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য, অপর দিকে সেগুলিই যেন লৌকিক বা অলৌকিক উপায়ে তাদের প্রকৃতি পাল্টে ফেলেছে। অনেক পরোক্ষ উপমার সাহায্য নিয়েছেন শিল্পী। অনেক কাজই রূপকাত্মক। অনেক সময়ে আইচের ছবি দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু আরামদায়ক নয়। হৃদয়ের গভীরে ধাক্কা লাগিয়ে দেয় সে সব ছবি। কিন্তু এটা বলতেই হয় যে, সালভাদোর দালির ‘দ্য ফেস অব ওয়র’ বা ‘যুদ্ধের মুখ’ ছবিতে যে রকম একটি বীভৎস রূপ দেখা যায়, সেটা সমীর আইচের ছবিতে পাওয়া যায় না। আবার মানুষকে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাতেও থাকতে দিতে চান না শিল্পী।

Advertisement

সমীর আইচের ‘নৈশ ভোজ’ বা ‘ডিনার’ ছবিতে মানুষের জন্য তৈরি ভোজ খাচ্ছে একটি কুকুর জাতীয় প্রাণী বা প্রাগৈতিহাসিক কোনও জানোয়ার। করোনার সময়ে কাজটি করা বলে ভাবা যায় যে, প্রকৃতির ওই করুণাহীন অবতার মানুষকে পশু করে তুলেছে অথবা মানুষ বা পশুর আপাত তফাত মুছে দিয়েছে। কী সাঙ্ঘাতিক পরিবেশনা! কিন্তু বীভৎস নয় একেবারেই। ট্রিটমেন্টের বিশেষত্বে এবং মিশ্র মাধ্যমের জোরে ছবিটি আকর্ষক হয়ে উঠেছে।

নিজস্ব চিত্র।

এর পরের একটি ছবি যেটির নাম ‘লাইফ ইন ডার্ক’, সেটিতে কয়েকটি কলা রাখা রয়েছে টেবিলে, অথচ শিল্পীর তুলি-কলমে যেন প্রাণসঞ্চার হয়েছে ওই ফল তিনটিতে। ফল তো নয়, তবে কি তিনটি সামুদ্রিক প্রাণী এবং ওদেরও এক‌ই বাঁচার সমস্যা? ওই ট্রিটমেন্টেই করা। অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে ফ্ল্যাট করে ব্যাকগ্ৰাউন্ড কিছুটা ঢেকে কিছুটা অংশে কাগজ ছেড়ে দিয়ে তার উপরে পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং করে মেজাজটা ধরেছেন। বিবেচনা করেই করা, অথচ মনে হয় স্বতঃস্ফূর্ত। সেখানেই কৃতিত্ব শিল্পীর।

‘দ্য ফলেন বার্ড’ ছবিটিতে দেখা যায় পৌরাণিক পাখি জটায়ু— যার কাজ নারীদের রক্ষা করা। সীতাহরণের সাক্ষী— শেষ পর্যন্ত সীতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সে রাবণের হাত থেকে। কিন্তু আজ সে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আজ তার পরাজয়। সঙ্গে নারীজাতিরও। নারীজাতিকে রক্ষা করতে সে অক্ষম। মিশ্র মাধ্যমের ন্যারেটিভধর্মী ছবি ‘ক্লিওপেট্রা’। প্রথম দর্শনেই ক্লিওপেট্রা যে সাপের দংশনে নিজের মৃত্যু ঘটান, সেই কথা মনে পড়ে। জীবনানন্দ দাশের লেখা বিখ্যাত সেই লাইন— ‘চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার… এই পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায় নাকো আর।’ নিছক শারীরিক সৌন্দর্য ছাপিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বের জোরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা। শিল্পী আর‌ও এক ব্যতিক্রমী নারী দেখেছিলেন এবং এই ছবিটি তাঁকে নিয়েই করা। হাবড়া অঞ্চলে এক মহিলা বহু বছর আগে সাপের খেলা দেখাতেন। কিন্তু তাঁর আসল কাজ ছিল পালাগান করা। সেই পালাগান শুনতে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে লোক আসত। কেউটে সাপ নিয়ে খেলতে খেলতে একদিন সেই সাপ তাঁর মুখে ছোবল মারে ও তিনি মারা যান। ‘ক্লিওপেট্রা’ নাম দিয়ে তাঁরই ছবি এঁকেছেন শিল্পী সমীর। ফ্ল্যাট করে ফেলা শরীরের অংশগুলির ড্রয়িং, টেক্সচার এবং টোনের ব্যবহারের খুব সচেতন প্রয়োগ দেখা যায় ছবিটিতে।

ছোট ছবি ‘সিটি লাইফ’। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কী ভাবে আজ মারণরোগের পীড়নে যাতনা-যন্ত্রণায় ভুগছেন, সেই অনুভূতির কথা বলেছেন মিশ্র মাধ্যমে। আর-এক ছবিতে আছে রূপক, মা ও সন্তানের অদ্ভুত উপস্থাপনা। এখানে মা মমতাশীল নন। এই মা তো সভ্যতার আলোক-বঞ্চিত! প্রাক-সভ্যসমাজের মানুষে পরিণত হচ্ছেন কি আজকের মা-ও? তাঁর বহুস্তন্য গ্রহণ করতে চাইছে অগণিত আদিম সব প্রাণী। হয়তো শিল্পী আমাদের সেই যন্ত্রণা থেকে সরিয়ে অন্য এক কল্পনার জগতে নিয়ে যেতে চান।

প্রদর্শনীর সবচেয়ে অন্য ধাঁচের ছবি হল ‘লেজ়ার টাইম’। বড় আয়তনে মিশ্র মাধ্যমে করা। এক মহিলা আরাম করছেন, তারই চিত্রণ। নাটকীয়তা আছে ছবিটিতে। যেভাবে স্পেসটিকে বেঁধেছেন, তা খুবই উপভোগ্য। অ্যাসিড-ফ্রি কাগজে ঢিলেঢালা আলগা ড্রয়িং করে ছোট ছোট ডট দিয়ে টেক্সচার তৈরি করে ছবিটির উপস্থাপনা।

মনে অনেক প্রশ্ন জাগিয়েছেন শিল্পী। খুবই সমাজসচেতন শিল্পী সমীর আইচ। বাঁচাটাই যখন অভিঘাতপূর্ণ ও অনিশ্চিত তখন মানুষ, পশুপাখি, শিশু এবং প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মা— এরা সকলেই যেন একত্রে জীবনধারণে প্রয়াসী। তবু এই প্রদর্শনী বিষণ্ণতার প্রলয়নাচন নয়। বরং প্রতিটি ছবির সৌন্দর্যই অন্য এক স্তরে উত্তরণ ঘটায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement