মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল।
আমি পাশ করেছিলাম। ইছে ছিল আরও পড়ার কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি।
বিয়ের আগেই শুনেছিলাম আমার স্বামী সাহিত্যিক। বিয়ের পর প্রথম এসে উঠেছিলাম টালিগঞ্জের বাড়িতে।
তখন যৌথ পরিবার। দিব্যি চলছিল। আমার স্বামীর একমাত্র কাজ ছিল লেখা। ধরাবাঁধা কাজ তার কোনও দিনই পোষাত না।
খুব চা খেতেন আর সঙ্গে কাঁচি ব্র্যান্ডের সিগারেট। ফ্লাস্কে চা করে রেখে দিতাম। উনি খেতেন। এমন হয়েছে লেখার ঝোঁকে খাওয়াদাওয়াই ভুলে গেছেন। মনে করিয়ে দেওয়ার পর খেয়েছেন।
শ্বশুরমশাই টালিগঞ্জের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পর প্রাপ্ত টাকা তাঁর ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
পরে শুনেছিলাম, বাড়ি বিক্রির পাওয়া টাকার নিজের অংশ উনি পার্টি ফান্ডে দান করে দিয়েছিলেন।
বাড়ি বিক্রির পর শ্বশুরমশাই আমাদের সঙ্গে চলে এলেন বরানগরের ভাড়া বাড়িতে। বাইরের ঘরে চটের পার্টিশন দেওয়ার একভাগে থাকতেন উনি আর অন্যভাগে আমার স্বামী। ওইটকু অংশই ছিল তার জগত। লেখা পড়া, গল্প আড্ডা, ঘুমোনো সাহিত্য সৃষ্টি সবকিছু।
সংসারের কোনও কিছুতেই খেয়াল থাকত না আমার স্বামীর। বাজার করতেন নিয়মিত। তবে বড় বেহিসাবি বাজার। যেদিন যা খুশি হয় নিয়ে আসতেন।
মানুষকে খাওয়াতেও ভালবাসতেন খুব। কোনওদিন কাউকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে বলতে ভুলে যেতেন, যখন মনে করে বলতেন, ততক্ষণে বাড়ির রান্নাবান্না শেষ।
আবার উনি ছুটতেন বাজারে। আমি রান্না বসাতাম। এমনটা বহুবার হয়েছে। নিজে সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন মিষ্টি খেতে।
বাড়িতে খড়ম পরতেন। খড়মের শব্দেই জানা যেত তিনি আসছেন। নিজের জামাকাপড়ের প্রতি চিরকালই বড্ড উদাসীন। ধুতি পাঞ্জাবি পরতেই ভালবাসতেন বেশি।
বিকেলের দিকে বাড়ির সামনের মাঠে বাচ্চা ছেলেরা খেলাধুলো করত, তাদের খেলার মীমাংসা করা, ঝগড়াঝাঁটি থামানো, বাঁশি নিয়ে রেফারিগিরি করা, সব ব্যাপারেই উনি। মাঝেমাঝে ছোটদের সঙ্গে ঘুড়িও ওড়াতেন।
গান গাইতেন চমৎকার। প্রধানত রবীন্দ্রসঙ্গীত। নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রামপ্রসাদী, অতুলপ্রসাদীও গাইতেন। প্রিয় গান ছিল ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’।
লেখার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময় ছিল না তার। কখনও অনেক রাত পর্যন্ত, আবার কখনও খুব ভোরে উঠে লিখতে শুরু করতেন। এক এক দিন লেখা আসত না যখন খুব মনমরা হয়ে থাকতেন। বুঝতে পারতাম তার ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে।
জ্যোৎস্না রাতে বারান্দায় বসে থাকতেন একা। খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে। সেই রাতে আড়বাঁশি বাজাতেন।
কোনও দিন তাঁর কোনও লেখা আমাকে পড়ে শোনাননি। প্রকাশ পাবার পর আমি পড়তাম। পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা-র চরিত্রদের আমার আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। আমি সব সময়েই চেয়েছি আমার স্বামী ওই সময়কার অথবা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরূপে গণ্য হোন।
ঋণ: কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমার স্বামী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ রচনা থেকে গৃহীত ও সম্পাদিত