নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায়। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি দেবলীনা কুমার পরিচালিত লাইহারাওরা— প্রাচ্য নাচের পাঠশালার ১১তম বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল উত্তম মঞ্চে। পাঠশালার ছোটরা নটরাজকে বন্দনা করল শুরুতে, গানের সঙ্গে নৃত্যের তালে তালে। তার পরে গুণিজন সংবর্ধনায় পার্থ ভৌমিক, সুদেব গুহঠাকুরতা, জহর সরকারকে সংবর্ধিত করলেন দেবলীনা। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানালেন পরিবারের সদস্য দেবাশিস কুমার, দেবযানী কুমার, মহুয়া চট্টোপাধ্যায়, সুমনা চট্টোপাধ্যায় এবং গৌরব চট্টোপাধ্যায়কে। এর পরে সরাসরি মূল অনুষ্ঠান রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’। বাংলা ১৩০৬ সনে ‘পরিশোধ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ এবং ১৯৩৯ সালে তারই রূপান্তর ঘটান তিনি ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মধ্য দিয়ে। জাতকের মহাবস্তু অবদান থেকে এর কাহিনির প্রেরণা পান তিনি। রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্যের ফসল ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬)। তার পর ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮) এবং শেষ রচনা ‘শ্যামা’ (১৯৩৯)। এই তিনটি প্রযোজনাকে ‘নৃত্যনাট্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ তার পর থেকে সৃজনশীল নৃত্যের আঙিনায় গত ৯০বছর ধরেই এই নৃত্যনাট্যগুলি দেশবিদেশের রবীন্দ্র-অনুরাগী দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে। দেবলীনা কুমারের পরিচালনায় সে দিন ‘শ্যামা’ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করা হয়। শ্যামার ভূমিকায় দেবলীনার নৃত্য উপস্থাপনা ও অভিনয় দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। বজ্রসেন, উত্তীয় এবং কোটালের নৃত্যাভিনয়ও যথাযথ। সখীদের নৃত্যাভিনয় ভালই বলা যায়। সে কালের নৃত্যশিল্পী সুকৃতি চক্রবর্তী (হাসুদি— প্রথম ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে সখীর ভূমিকায় নেচেছিলেন) লেখায় সে কালে নৃত্যশিল্পীদের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এখন নৃত্যশিল্পীর অভাব নেই। বিভিন্ন আঙ্গিকের শাস্ত্রীয় নৃত্যের তালিম নেন নৃত্যশিল্পীরা। তাঁরা যখন রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য উপস্থাপনা করেন, তখন টেকনিক্যালি তা দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই তা শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার অনুসারী হয় না। শিল্পীরা রাবীন্দ্রিক নৃত্যধারার প্রতি যত্নশীল হলে সৃজনশীল নৃত্যের এই নৃত্যধারাটি একটি মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে ভারতীয় নৃত্যের ইতিহাসে। সে দিন ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা সশরীর উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করায়, অনুষ্ঠানটি আরও আকর্ষক হয়েছিল। শ্যামার ভূমিকায় গানে ছিলেন অর্পিতা রায়। বজ্রসেন দীপাঞ্জন পাল। উত্তীয় অরূপ সরকার। বন্ধু কোটাল শ্রায়ন চন্দ। শ্যামা ও বজ্রসেনের গানে কোথাও কোথাও মূল স্বরলিপি থেকে সরে গেলেও, শিল্পীরা সাফল্যের সঙ্গেই নৃত্যনাট্যের উপযোগী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীতে ছিলেন, তবলায় বিপ্লব মণ্ডল, কি-বোর্ডে সুমন মুখোপাধ্যায়, সেতারে শুভময় ভট্টাচার্য, এস্রাজে ঋতম বাগচী। সকলেই তাঁদের ভূমিকা যথাযথ পালন করেছেন। মঞ্চসজ্জা অবশ্য হতাশ করেছে। অকারণে ছবির সাহায্যে দৃশ্যপট পরিবর্তন ও ‘এই দ্যাখো রাজ অঙ্গুরী’ গানের সঙ্গে স্ক্রিন জুড়ে আংটির ছবি বিসদৃশ লাগে।
অনুষ্ঠানের সংযোজনায় ছিলেন মধুমিতা বসু ও বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়। বিপ্লব রবীন্দ্রনাথের চারটি নৃত্যনাট্যের উল্লেখ করলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য তিনটি— ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’ এবং ‘শ্যামা’। এই প্রসঙ্গে জানাই, রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীর অনুরোধে ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যটিকে নৃত্যনাট্যে রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। গীতবিতানে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যের গানের উল্লেখ আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তা মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয়নি। ষাটের দশকে আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচালনায় নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে সুরঙ্গমা সঙ্গীত শিক্ষায়তন থেকে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যটি একবার মঞ্চস্থ করা হয়।