টিউশনি-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?’
কলেজে ঢুকে গেছি। টিউশনি চাই। পাড়ার জীবনদা টিউশনি বিশারদ। করজোড়ে মনোবাঞ্ছা জানালাম। তথাস্তুর কায়দায় অভয় মুদ্রায় বলল, ‘‘দেখছি।’’
এর আগে পাড়ার দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনদার লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন বলি—
‘দশটা বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি কত গলি পথে/গড়পার পাড়া থেকে চালতা বাগান হয়ে গরান হাটায়/পাইপগান তুচ্ছ করে, বোমার ধোঁয়ায় অন্ধকার নিষিদ্ধ জগতে/কখনও’বা উঠিয়াছি সিঁড়ি পথে ছ’তলার ফ্ল্যাটে/আমি ক্লান্ত প্রাণ এক টিউশনিজীবী জীবন সাধু খাঁ/বড় বেশি ঘুরি বলে ছ’মাসও টেকে না আমার পাদুকা।’
এটা সত্তরের কথা। টেলিফোন-লিফটওলা বাড়িতে টিউশনি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। বোঝাই যাচ্ছে জীবনদা ও সব বাড়িতেও টিউশনিতে যেত। এর আগে আমি টিউশনি বাড়ি গিয়েছি। পড়াতে নয়, পড়তে। স্কুলের ড্রিল স্যারেরা খুব কড়া হতেন। ওরা যত ইংরেজি বলতেন, ইংরেজির স্যারেরাও বলতেন না। তাই ড্রিল স্যারের টিউশন বাড়িতে যেতাম ইংরেজি শিখতে। তখন ক্লাস এইট। গলির ভিতরে ছোট্ট একটা ঘরে মাদুর বিছানো। রকে বসা লোকগুলো বলত যদু মাস্টারের গোয়াল। গোয়াল বলত কেন? আমরা বুঝি গোরু? পরে বুঝেছি, কোচিং বাড়িকে গোয়াল বলাটাই বঙ্গসংস্কৃতির পরম্পরা।
ড্রিল স্যার মানে যদুপতি ঘোষ ক্লাস এইটের পর আর পড়াতেন না। উনি বলতেন, ‘‘ভিতটা আমি পাক্কা করে এক্কেবারে কংক্রিট ঢালাই করে ছেড়ে দিই। বাকি সব কাজ অন্যরা করবে।’’
আমার ভিতটার ঢালাই বোধহয় ভাল হয়নি। টেনশন বানানটা টি আই ও এন, নাকি এস আই ও এন নিয়ে সে দিনও টেনশন হত খুব। ইংরেজির প্রশ্ন তো ড্রিল স্যার করতেন না, সে বার রচনা এসেছিল ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ আ কাউ’। বোঝাই যাচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কিন্তু আমাদের রুখতে পারেনি। আমরা সবাই লিখেছিলাম, ‘আই অ্যাম এ কাউ, লাভ টু ইট গ্রাস, হ্যাভিং ফোর লেগস অ্যান্ড আ টেইল।’ ড্রিল স্যার করিয়ে দিয়েছিলেন।
নিশ্চয়ই কোশ্চেনটা লিক করিয়ে নিয়েছিলেন। টিউশন বাড়িগুলির মধ্যে এই ধরনের একটা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ছিল, পাঁচ পাবলিক যাকে বলত খেয়োখেয়ি।
ক্লাস নাইনে উঠে আমি আরও বড় একটা টিউশন বাড়িতে গেলাম। নাম ‘প্রজ্ঞাতীর্থ’। ওখানে মাদুর নয়, চেয়ার-টেবিল-ব্ল্যাকবোর্ড। কাউন্টারে মাসের মাইনে জমা দিতে হত। প্রত্যেকের একটা হলুদ কার্ড থাকত। ওখানে টিক পড়ত।
কে কোন বিষয়ে পড়বে, সে অনুপাতে বেতন ধার্য হত। এগুলোর নাম ছিল কোচিং সেন্টার। কিন্তু কোচিংগামী বেশির ভাগ ছেলেপুলেই বলত ‘কোচিনে’ যাচ্ছি।
এগুলো হল টিউশন বাড়ির উন্নততর স্তর। যেমন হালুয়ার উন্নততর স্তর মোহনভোগ কিংবা গাধার উন্নততর স্তর খচ্চর।
বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর রাখার তুলনায় টিউশনি বাড়িতে খরচ কম। কোচিং সেন্টারে কী পড়ানো হচ্ছে, কতক্ষণ পড়ানো হচ্ছে, অভিভাবকের নজরে রাখা সম্ভব হত না। তাই সচ্ছলরা বাড়িতে টিউটর রাখতেন।
টিউশনযোগ্য লায়েক হয়ে উঠলে এবং বেকার যন্ত্রণা তীব্র হলে আমরা ওই সুযোগটাই নিতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু যে সব অভিভাবক গৃহশিক্ষক রাখতেন, ওদের ছাত্রদের শরীরের এমন একটা অংশের সঙ্গে শিক্ষককে যুক্ত করে দিতেন, যা এই সংলাপে বোঝা যায়।—
‘‘ছেলের পিছনে তিন-তিনটে ম্যাস্টর রাখলাম…।’’ ‘পিছন’ শব্দটির আরও অসাধু প্রয়োগও তো হয়।
জীবনদাদের মতো ‘ম্যাস্টর’রা ঘুরে ঘুরে টিউশনি পড়াতে যান। বাড়িতেই যদি ব্যাচে ব্যাচে পড়ানো যায়, তা হলে এত ধকল দরকার হয় না। মূলধন বলতে দরকার হয় কয়েকটা মাদুর। ব্যস, তার সঙ্গে অবশ্যই একটা ঘর।
অনেকেরই এই অতিরিক্ত ঘরটা থাকে না বলে ফেরিওয়ালা হতে চায়। ফেরিওয়ালা শব্দটা বললাম একটা ফ্ল্যাট কমিটির মিটিং-এর প্রেক্ষিতে। ‘লিফট’-এর পাশে লেখা ছিল ‘ফেরিওয়ালার প্রবেশ নিষেধ’।
ফ্ল্যাটের এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর দুই সন্তানের জন্য মোট সাত জন গৃহশিক্ষক। ওদের জন্য এত বার লিফট চলাচলে আপত্তি জানান এক আবাসিক। ওঁর যুক্তি এলআইসি-র এজেন্ট যদি মৃত্যুর ফেরিওয়ালা হয়, প্রাইভেট টিউটরও পাশ করানোর ফেরিওয়ালা।— হ্যাঁ, সবারই একটা স্বপ্ন থাকে। খালাসি চায় ড্রাইভার হতে। চামচে চায় নেতা হতে। কাটাকেষ্ট চায় মন্ত্রী হতে। তেমনি পাশ করানোর ফেরিওয়ালা বা প্রাইভেট টিউটররা চায় ‘সত্যদা’ হতে।
মনে আছে, সত্যদার কোচিং?
মাধ্যমিক-হায়ার সেকেন্ডারি তো নস্য মাত্র। কত ছাত্রছাত্রীকে এমএ পারাবার পার করে দিয়েছিলেন সত্যদা। সত্যদা ছিলেন একটা ব্র্যান্ড। যেমন, বেলা দে। বেলা দে’র গৃহিণীর অভিধানের পর কত যে রান্নার বই বের হল বেলা দে’র নামে, আকাশবাণী-র বেলা দে নিজেই জানতেন না। ওঁর মৃত্যুর পরও বেলা দে’র নামে বই বেরিয়েছে। সে দিন বইমেলায় দেখলাম ‘বেলা দে প্রণীত মাইক্রোওভেনে রান্না’।
সত্যদার মৃত্যুর পরও সত্যদার নামে এখানে ওখানে সত্যদার কোচিং গজিয়েছিল। সত্যদার অনুকরণে মিলনদা, তরুণদা, মানিকদাদের কোচিংও দেখেছি। আগেকার যাত্রা-সিনেমায় বঙ্গরমণীর স্বপ্ন দেখার ডায়লগ থাকত— ‘সন্ধেবেলায় শাঁখ বাজাব, তুলসীতলায় প্রদীপ দেব, নাড়ু বাঁধব, উঠোনে থাকবে এক জোড়া নারকোল গাছ…।’
মফস্বলের জীবনদাদের স্বপ্ন হল— ঘরের সামনে থাকবে কত চটি-চপ্পল-জুতো, বাইরের দেয়ালে হেলানো থাকবে কত সাইকেল…। দূর দূরান্তর থেকে ছেলেমেয়েরা সাইকেল চেপে পড়তে আসবে, ব্যাচে ব্যাচান্তরে পড়ানো হবে। দু’চারটে সুন্দরী ছাত্রীর জন্য ও অন্তর-পেটিকার পেটে বাসনা পোরা থাকত। সুন্দরী ছাত্রীদের টানেই তো ছাত্ররা আসবে। সুন্দরী ছাত্রীই তো কোচিং সেন্টারের রানি মৌমাছি।
সার্থক কোচিং সেন্টারের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এক রসিক সংস্কৃত স্যার।—
‘বিভঙ্গিত সাইকেলানি, পাদুকাশ্চ হট্টগোলম/সাইনবোর্ডং, ক্রিং শব্দ— এবম্বিধ পঞ্চলক্ষণম্।’
বড় মাপের কোচিং-এ পিরিয়ড শেষ হলে বেল বাজে। ‘ক্রিং’ শব্দে তারই ব্যঞ্জনা।
পথের পাঁচালী-তে অপুর পড়তে যাওয়া মনে করুন। মুদি দোকানি তার দোকানদারির ফাঁকে ছাত্র পড়াচ্ছেন। বিবর্তিত হয়ে সেই টিউশন ঘরে এখন যান্ত্রিক ক্রিং শব্দ পিরিয়ড শেষে বাজে।
এখন কোচিং চেন হয়েছে। ডাক্তার-আইএএস-আইপিএসও বানানো হয়। দেশের বিভিন্ন শহরে ব্র্যাঞ্চ। ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’।
অপুর পাঠশালার মতো একটা টিউশন ঘরের সাক্ষী থেকেছিলাম। আমার কর্মজীবনের প্রথম দিকে। ভূমি-রাজস্ব দফতরের চাকরিতে গভীর গ্রামে পোস্টিং। সকালবেলায় আমার এক এক আমিনবাবু টিউশনি পড়াতেন মাদুর বিছিয়ে। টাকা নিতেন না। পরিবর্তে সামনে থাকত একটা ধামা।
আমিনবাবু ধামাটির নাম দিয়েছিলেন ‘ধর্মধামা’। যাঁরা পড়তে আসত, বগলে নিয়ে আসত একটা লাউ বা চালকুমড়ো, কেউ একটা ফুল কপি, কেউ বা এক জোড়া ডিম। নইলে এক বাটি চাল। ধামায় ঢেলে মাদুরে বসতে হত।
আমরা সবাই মিলে মেস করে থাকতাম। ওই ধামাকার কারণে মেস খরচ খুবই কম হত। আমিও সুবিধাভোগী। ফলে আমিনবাবু ছুটিতে গেলে আমিই গুরু হয়ে বসে এই গুরুতর কার্যসমাধা করতাম। এই ধামানিষ্ঠ আমিনবাবুটিরও নাম ছিল জীবন। জীবন নস্কর। টিউশনি থেকে জীবন বা জীবন থেকে টিউশনি বাদ দেওয়ার উপায় নেই আমার জীবনে।
জীবন সাধুখাঁর কথায় ফিরে যাই। উনিই আমার টিউশন গুরু। গুরুকে জানাই প্রণাম। ওঁর কৃপাতেই আমি প্রথম টিউশনিটা পেলাম।
ছোটবেলায় মিন্টু দাশগুপ্তর একটা গান, ‘কাজলা নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলোছলে’-র প্যারোডি বেকার মহলে খুবই জনপ্রিয় ছিল।— ‘‘আমি আজ বেকার বলে/বৌদি যে ঝ্যাঁটা তোলে/গালাগালি দেয় পেট ভরিয়া/সকালে বাজারের থলে/তার পর জল তুলে/সারা দেহ ওঠে ঘামে ভরিয়া…।’’
গানের এই বেকারটি তো তবু ভাগ্যবান। বাজার করতে পারত। বাজারে তবু সামান্য কিছু ইনকামের রাস্তা থাকে। বেশিরভাগ বেকারের বাজারের অধিকার ছিল না। বরং রেশন। রেশনে শ্লিপ দেয়। কিচ্ছু করার থাকে না।
জীবনদা ওই প্যারোডিটারই একটা অ্যান্টি প্যারোডি করেছিল— যার মধ্যে টিউশনির জয়গান ঘোষিত হয়েছে।— ‘‘টিউশনি করি বলে/বৌদি তো গেছে গ’লে/মিটিমিটি হাসে মুখ ভরিয়া।/ দুপুরে ম্যাটিনির শোয়ে/বৌদিকে সঙ্গে লয়ে/সিনেমাকে যাই রিক্সা চড়িয়া…।’’
প্রথম প্রেম আর প্রথম টিউশনি কার না মনে থাকে!
ছাত্রর বাবার বাগবাজারে তেলেভাজার দোকান। জীবনদা বলেছিলেন, ছেলে পাশ করে গেলেই ওঁরা খুশি।
ভাল ছেলের টিউশনি ভাল না। ওঁদের বড় খাঁই। অঙ্কে আশি চাই। ইংলিশে ষাট। খারাপ ছেলেদের অত ঝামেলা নেই। কতগুলো টিপস দিয়েছিলেন— ‘‘‘জানিনা’ বলবি না কখনও। বলবি ‘তুমি এখন বুঝবে না, পরে বুঝিয়ে দেব।’’ আরও বলেছিলেন, ছাত্রছাত্রীর মাকে মাসিমা না ডেকে বৌদি ডাকবি, তাতে ওরা খুশি হবেন, ভাল টিফিন পাবি। টিফিন তোর টিউশানিক অধিকার।
প্রথম টিউশনি বাড়িতে টিফিন ছিল ফুলুরি-মুড়ি। সঙ্গে কাঁচালঙ্কা। লসাগু-গসাগু-র অঙ্ক বোঝানোর সময় ছাত্রর ঠাকুরমা এসে বলে, ‘‘পড়াবার সময় এত নোংরা নোংরা কথা কও কেন গো ছোঁড়া?’’
সেই শুরু, ছাত্র অঙ্কে বিয়াল্লিশ। আর কী চাই? প্লেটে দানাদার। ওদের সুপারিশেই আর একটা। ওটা ছাত্রী। ক্লাস এইট। ও বাড়িতে কুকুর ছিল। প্রথম দিন কুকুরকে দিয়ে শুঁকিয়ে নিল। বলল, ভয় পাবেন না। এর পর থেকে ভৌভৌ রবে ওই কুকুরই অভ্যর্থনা করত। ওরা চা দিত, চায়ে খুব বেশি চিনি। উপরে সর। সরভাজা-সরপুরিয়া ভালই। কিন্তু সর-চা’টা খেতে খুবই কষ্ট হত। বিস্কুট দিয়ে মাখিয়ে সর-বিস্কুট করে নিতাম।
ও বাড়িতে ডগ বিস্কুটও খেয়েছি। স্বচ্ছন্দেই পেটে চলে যায়। ছাত্রীটির মা পড়ানোর সময় সারাক্ষণ একটা চেয়ারে বসে আসন সেলাই করতেন। এক দিন ছিলেন না, সে দিন কুকুরটাকে বেঁধে রেখেছিলেন।
কুকুর মানুষের ভাষা বোঝে না বলে ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘তোমার মা কেন রোজ …।’’
ছাত্রীটি বলেছিল, ‘‘আগুন আর ঘি পাশাপাশি থাকলেই নাকি…।’’
আমি বলেছিলাম, ‘‘কে আগুন আর কে ঘি?’’
ছাত্রীটি আঙুল মটকে, ভ্রু পটকে বলেছিল, ‘‘জানি না, যান।’’
আমি ‘দুষ্টু মেয়ে’ বলে ছাত্রীটির থুতনিতে হাত দিতেই কুকুরটা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
ট্রেনিং-প্রাপ্ত কুকুরের কথা যখন উঠলই, ট্রেনিং-প্রাপ্ত বেড়ালের কথাও মনে পড়ল।
একটা পাথরের বাটিতে আমাকে পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড় খেতে দেওয়া হয়েছিল। খাওয়াও প্রায় শেষ।
ছাত্রের পিসিমা হঠাৎ ঘরে এসে আমার বাটিটার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘খেয়ে নিয়েচো বাবা? আর খেয়োনি।’’
আমি বলি, ‘‘এটা বুঝি আপনার বাটি?’’
বিধবা মহিলাদের পাথরের বাটিতে খেতে দেখেছি আগে। উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন। ওঁর গলা শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘‘বলি ও খ্যাঁদার মা, ম্যাস্টরকে বেড়ালের বাটিতে খেতে দিয়েছ?’’
পরে জেনেছি, ওটা বেড়ালের খাওয়ার বাটি ছিল না। ট্রেনিংপ্রাপ্ত গৃহপালিতটি ওই বাটিতেই পটি করত।
টিউশনি এমন একটা জিনিস, যা চলে যায়, আবার আসে। শুধু যাওয়া-আসা।
একটা টিউশনি পেলাম, যেখানে কোনও টিফিন দেয় না। জীবনদার কাছে টিপস চাইলাম। জীবনদা বললেন, ‘‘গিয়ে জল চেয়েছিস? জল চাইলে গেরস্ত বাড়িতে জলের সঙ্গে একটা দানাদার বা গুজিয়া, নিদেন বাতাসা দেয়।’’
বললাম, ‘‘চেয়েছিলাম। তবু শুধু জল দিয়েছে।’’
জীবনদা বললেন, ‘‘তা হলে এক কাজ কর। ওদের বাড়ি গিয়ে মাথা ধরে বসে থাক। বল মাথা ধরেছে। তখন মাথা ধরা ছাড়াবার জন্য চা দেবে। নইলে তো ওদের লস।’’
তাই করলাম। ছাত্রের মা ওঁর ছেলেকে বললেন, ‘‘মাস্টারমশাইয়ের থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে শিগগির নীচের দোকান থেকে স্যারিডন কিনে নিয়ে আয়।’’
জীবনদা বললেন, ‘‘আর কিছু করার নেই। ও বাড়ির খাওয়াটা ধরে নে বরাতে নেই।’’
আমি অতঃপর নিজবুদ্ধি প্রয়োগ করি। এক ঠোঙা ডালমুট নিয়ে যাই। ভাবি বলব, খুব খিদে পেয়েছে। নিজে নিজে খেতে থাকব। এর পর থেকে নিশ্চয়ই ওরা কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা রাখবে। ঠোঙাটা দেখেই ছাত্রটি নিজের বোনকে ডেকে নেয়, বলে, ‘‘ও টুনি, আয় আয়। মাস্টারমশাই আমাদের জন্য ডালমুট নিয়ে এয়েচে।’’
খাবার কথা উঠল বলে বলি, থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় একটা টিউশনি পেলাম। শ্যামবাজারের বিখ্যাত গোলবাড়ির কষামাংসর মালিকের বাড়িতে।
ওদের মালিকের নাম যদ্দুর মনে পড়ে রতনলাল অরোরা। ওঁরা শিখ পঞ্জাবি নন। আর্য প়ঞ্জাবি। ওঁর দুই নাতিকে পড়াতাম। ইংলিশ মিডিয়াম। পাঁচ মাথার মোড়ের ওই ছোট্ট দোকানে রান্নাঘর ছিল না।
রান্নাটা হত ওঁদের বাসগৃহে। এক তলায় ছিল রান্নার কারখানা। নানাবিধ সুগন্ধে বাতাস আমোদিত ছিল। আশা ছিল, ভালবাসাও ছিল (মাংসের প্রতি) কিন্তু হায়! ছাত্রের বাড়ি থেকে গাঠিয়া, গজা, সেউ ভাজা, বরফি… এই সব পেতাম।
ওঁরা নিরামিশাষী ছিলেন। কোনও দিন কষা মাংস পাইনি। আমার জীবনের আপশোস লিস্টে এটা একটা বড় আইটেম। কিন্তু যত দিন পড়িয়েছি, অর্ধভোজন করেছি ওই কষা মাংস, ঘ্রাণে।
ওঁদের বাড়ি থেকে পঁচাত্তর টাকা পেতাম। সে সময় ওটা অনেক টাকা। ইচ্ছে হলেই বাগবাজারের রামগোপালের দোকানের রাধাবল্লভী, লড়াইয়ের চপ প্যাঁদাচ্ছি। বন্ধুদেরও খাওয়াচ্ছি। সিনেমা দেখতে হলে পঁয়ষট্টি পয়সার লাইন নয়, দেড় টাকার টিকিট কাটছি।
ওখানে সপ্তাহে তিন দিন। আরও চার দিন ছিল হাতে। এমন সময় আর একটা টিউশনি এল। ছাত্রের বাবার গেঞ্জির কল। ছেলেটি ক্লাস এইট। আমাকে বললেন, পরে কমার্স পড়াতে চান। কিন্তু অঙ্কে কাঁচা। তখনই কাব্যরোগে ধরে গেছে। ছেলেটার দিকে তাকাই। ঠোঁটের ওপর সদ্য ওঠা গুম্ফরেখা! গোঁফ গজালেই তো বাঙালির কবিতা গজায়, ঠিকই তো আছে। মনে মনে বলি।
গেঞ্জিকল বললেন, ‘‘দেখুন, মাস্টারমশাই, ওকে পাটিগণিতটা খুব ভাল করে শেখাবেন। বিশেষ করে সুদ কষা, লাভ ক্ষতির অঙ্ক। অনেক কষ্টে বিজনেসটা দাঁড় করিয়েছি। আমার একটিই ছেলে। দুটো মেয়েও অবশ্য আছে। কিন্তু ছেলেটাকেই তো কারবারটা দেখতে হবে। ছেলের ও দিকে হুঁশ নেই। ওকে আলাদা ঘর দিয়েচি, ভাল করে পড়ালেখা করবে বলে। কিন্তু পরীক্ষায় টায়েটুয়ে পাশ। অঙ্কে সাতাশ। এ দিকে রাত এগারোটা পর্যন্ত লাইট জ্বলছে। কী করছে দেখতে গেলুম, দেখি কোব্তে লিখছে। আরে রামপেসাদ হিসেবের খাতায় কোব্তে লিখেছিল বলে তুইও লিখবি? সেটা ছিল রাজার আমল। আপনার প্রথম কাজ হবে, ওর মাথা থেকে কোব্তের ভূত ছাড়ানো। এ বার বলুন, আপনাকে কী দিতে হবে? আপনাকে কিন্তু ডেলি আসতে হবে। ওয়াচ রাখতে হবে যেন ও সব না লেখে। আমি বলি, এখন আমি সেভেনটি ফাইভে করি, এ বার যা ভাল বোঝেন…।’’
উনি বললেন, ‘‘আমি ফিফ্টির বেশি পারব না।’’
আমি মাথা চুলকে বলি, ‘‘সিক্সটির কমে আমিও পারব না।’’
উনি বললেন, ‘‘সিক্সটি? মানে ডেইলি দু’টাকা? ঠিক আছে, পড়িয়ে, নীচে ম্যানেজারের কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। আমি বলে রাখব।’’
আমি ভাবলাম, ভালই হল। দু’টাকায় আমার দিব্য হাতখরচা হয়ে যাবে আর ছাক্কা পঁচাত্তর টাকা রয়ে যাবে।
তখন কলেজ যাওয়া-আসার ট্রাম ভাড়া চল্লিশ পয়সা, সিগারেট তিরিশ পয়সা, কলেজ ক্যান্টিনে ষাট পয়সার পাঁউরুটি-আলুর দম। ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’ গানটার আবেদন মরমে ঢুকল রোববার।
রোববার ছুটির দিন। টিউশনি হীন। চারটে রবিবার না গেলে আট টাকা বাদ। ভদ্রলোক বুদ্ধিবলে কী ভাবে কারবারটা দাঁড় করিয়েছেন বোঝা গেল।
ছেলেটাকে ভাল লেগে গিয়েছিল। ভাবও হয়েছিল। বুদ্ধিমান ও। ওর নাম ছিল নয়ন। বুঝিয়েছিলাম অঙ্কের সঙ্গে কবিতার বিরোধ নেই। বিনয় মজুমদারের কথা বলেছিলাম। হাফ ইয়ারলিতে অঙ্কে চুয়াল্লিশ পেল। ও আমাকে ওর লেখা কবিতা দেখাল— সঙ্কোচে।—
‘অ্যালজ্যাবড়া হ্যাবরাজ্যাবড়া/ পচাবেগুনের ঘ্যাট লাবড়া/ তার উপরে ভনর ভনর মাছি/আমরা এখন এমনি ভাবেই আছি।’
আমি বলি, ‘‘বেশ তো হয়েছে।’’
এর পর পুরো খাতা দেখি। মন্দ লেখে না। ও বলে, ‘‘বাবাকে একদম বলবেন না।’’
ছেলেটাকে একটা কবিতার বইও উপহার দিয়েছিলাম। তুষার রায়ের ব্যান্ডমাস্টার। ওই দোষে, মানে, বই দোষেই আমার টিউশনিটা গেল। ওর বাবার কাছে ধরা পড়ে গেলাম।
বলেছিলেন, ‘‘সারা দেশ জুড়ে সর্ষের মধ্যেই ভূত। এ দেশের কিস্সু হবে না।’’
আর একটা টিউশনির কথা বলি। মেয়েটির বাবা অর্থনীতির অধ্যাপক। আমাকে বললেন, ‘‘আপনি শুধু কেমিস্ট্রিটা পড়াবেন। রেফারেন্স বই বেশ কিছু এনে রেখেছি— ফিনার, ফাইজার, থমসন।’’
মেয়ে সবে নাইন। অনার্সেও এত বই লাগে না। অধ্যাপক বললেন, ‘‘ম্যাথস্ আর ফিজিকস্-এর জন্য আলাদা দু’জন আছে। ওরা এমএসসি স্টুডেন্ট। আগে কেমিস্ট্রির জন্য একটা স্কুল মাস্টার রেখেছিলাম, কিন্তু মাস্টারটা বড্ড কামাই করত। তাই তোমার মতো ইয়ংম্যান রাখছি। অধ্যাপক ভদ্রলোকটি মাস্টারের আর্টিকেল হিসেবে ‘টা’ ব্যবহার করেছিলেন। আলুটা বেগুনটার মতোই। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ ভালই, কিন্তু মাস্টারের সঙ্গে?
মেয়ের স্কুলের খাতা দেখি। বলি, ‘‘ওরে ব্বাবা, তুমি লরেটোতে পড়ো?’’
মেয়েটি বলে, ‘‘লরেটো নয়, লোরেটো।’’
ওই লোরেটোকে আমি বেশিদিন পড়াতে পারিনি। কারণ ওর বাবাই আমাকে পড়াতেন বেশি। কী করে ভাল করে পড়াতে হয় তা নিয়ে পড়াতেন।
‘হাউ টু বি এ গুড টিচার’ নামে একটা বই আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং পড়া ধরতেন। হয়তো মৌলিক পদার্থ পড়ছি, ওর কলেজ লাইব্রেরি থেকে আনা ফিলোজফি অব ম্যাটার এগিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘‘বাড়ি নিয়ে গিয়ে পড়ে নিয়ো। নিজেকে আপডেট রাখা খুবই জরুরি।’’
এ টিউশনি ক’দিন চালানো যায়?
প্রতিটি টিউশনির স্বাদ আলাদা আলাদা। একটা টিউশনির সময় নিয়ে টানাপড়েন। চিত্রহার যখন হয়, আসা যাবে না। মা-মেয়েতে ‘চিত্রহার’ শোনে। ‘তেরো পার্বণ’ যখন চলছে, তখনও চলবে না। তখন টেলিভিশনের প্রথম যুগ। যাঁদের বাড়িতে টেলিভিশন, তাঁদের সবার ঘরেই ‘চিত্রহার’। কাকে বাঁচাবো? ও বাড়িতে একটা সমঝোতা হল— ‘চিত্রহার’-এর শেষ পনেরো মিনিট অন্তত দেখতে দিতে হবে।
কলেজের এক সহপাঠিনী বলেছিল, ও পাটিগণিতের অঙ্ক করাচ্ছে কোনও টিউশন বাড়িতে। একটা কাজে পুরুষ ও নারী শ্রমিক নিযুক্ত হল। নারী শ্রমিকের মজুরি পুরুষের অর্ধেক। টাকার পরিমাণ দেওয়া আছে। নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা বলতে হবে।
ছাত্রীর বাবা অঙ্কটা শুনেছিলেন। পড়ানো শেষ হলে উনি বলেছিলেন, ‘‘ম্যাডাম, একটা জরুরি কথা আছে। আপনি নিজেই তো পড়ালেন নারীর মজুরি পুরুষের হাফ। আগে অজয়বাবুকে হান্ড্রেড দিতাম। তাহলে আপনাকে ফিফটি দিই?’’
এটা ‘জোক’ নয়। তবে টিউশনি নিয়ে জোকস্ বাজারে আছে। একটা হল, ছেলে রেজাল্ট নিয়ে এসেছে, এগ্রিগেটে ফেল। বাবা চ্যাঁচালেন, ‘‘এতগুলো মাস্টার তোর পিছনে লাগালুম, তবুও ফেল। ছেলে আরও জোরে চ্যাঁচালো, ‘‘অ্যাগ্রিগেটের জন্য মাস্টার ছিল?’’
সময় হল টুথপেস্ট। যা বেরোয়, তা ঢোকে না আর। সামাজিক ‘টিউশানি বাজি’-র সেই অধ্যায় শেষ হল আশির দশকে। সন্তান সংখ্যা কমে যাওয়া, নব আনন্দে জেগে ওঠা, নব মধ্যবিত্তের নব প্রার্থনা হল ‘ওগো বিধি, ফার্স্ট বয় হয় যেন নিধি।’
অনেক অভিভাবক ভাবলেন যে শিক্ষক যে স্কুলে পড়াচ্ছেন, তার কোচিং-এ ছেলে থাকলে বেশি নম্বর। তখন বেকার ছেলেরা টিউশনি পেত না। ২০০২ সালে স্কুলে শিক্ষকদের টিউশনি বন্ধ করার সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল যা অচিরেই ঠোঙা হয়ে যায়, অনেকেরই প্রচুর স্টুডেন্ট। ব্যাচ থেকে ব্যাচান্তর। এঁরা একটি বা দুটি বিষয় মাত্র পড়ান। তাই স্কুল থেকে ফিরে ছাত্রা স্যার থেকে স্যারান্তর।
জীবনদা লোকান্তর। গেঞ্জিকলের নয়নকে মনে পড়ে। ও কি কবিতা লেখে আর? দেখা হলে বলা যেত, মনে পড়ে টিউশন? অনেক অন্ত্যমিল হয়— মনের মতন, অমূল্য ধন, হারানো রতন।
অলংকরণ: দেবাশীষ দেব