Sambhunath Pandit

রেকর্ড কিপার থেকে বিচারপতি, এক পণ্ডিতের কাহিনি

কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম দেশীয় বিচারপতি। বিদ্যাসাগরের সমর্থনে বিধবা বিবাহের আসরেও তিনি হাজির। শম্ভুনাথ পণ্ডিতকে নিয়ে লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় শম্ভুনাথ প্রথম থেকে নারীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন। মেয়ে মালতীকে বেথুনের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। বেথুন সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই শুরু। দু’জনের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া হত

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

ভবানীপুরের পুরনো এক বাড়ির একফালি অন্ধকার কুঠুরি। সদর আদালতের এক তরুণ মুহুরি থাকেন সেখানে। প্রায়ই বিকেলের পর কিছু বন্ধুবান্ধব আসেন। কিন্তু আড্ডা, ঠাট্টা, পরনিন্দা বা খাওয়াদাওয়ার চেনা বিনোদনে গা ভাসানো পছন্দ নয় তাঁদের। তার বদলে বিচিত্র এক কর্মকাণ্ডে তাঁদের সন্ধে কাটে!

Advertisement

অপরিসর সেই ঘরেই তাঁরা কাল্পনিক আদালত বসান। হঠাৎ করে বাইরের কেউ সে ঘরে ঢুকে পড়লে কোর্টরুম বা আইনপড়ুয়াদের শিক্ষাকেন্দ্র বলে ভুল করতে পারেন। আইন সম্পর্কে সেখানে তুমুল বাদানুবাদ চলে। আইনের বিভিন্ন ধারা, বিধান, শর্ত ও বিশ্লেষণ উল্লেখ করে কাল্পনিক আদালতের চরিত্রেরা পরস্পরকে প্রবল আক্রমণ করেন। একে অপরের শানানো যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেন।

এহেন বায়বীয় আদালতে কাল্পনিক অথচ জটিল সব মামলায় বাদী-বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর ভূমিকা নেন মূলত তিন জন। সেই তরুণ মুহুরি, যাঁর নাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত, তিনি তখন আইন পাশ করার জন্য দিন-রাত ভুলে পরিশ্রম করছেন। তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু দেশহিতৈষী হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর সদর হাসপাতালের উকিল অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। আইনের পাশাপাশি ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনায় তিন মূর্তির প্রবল উৎসাহ। তবে কল্পিত আদালত পরিচালনায় উদ্যম সবচেয়ে বেশি।

Advertisement

হরিশচন্দ্রের এক বন্ধু ছিলেন গিরিশচন্দ্র। তাঁর লেখায় পাওয়া যায়— ‘‘ওই ক্ষুদ্র ঘরটিতে আইন সম্পর্কে যে বাদানুবাদ হইত তা অতি উচ্চদরের। তর্কবিতর্কের স্রোত এরূপ বেগে প্রবাহিত হইতেছে যে অবিশেষজ্ঞের পক্ষে মস্তক বিঘূর্ণিত হইয়া যায়। উভয়পক্ষই যে রূপ উৎসাহের সহিত বাকযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন তাহা প্রকৃত বিচারালয়ের যুদ্ধ অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন নহে.... প্রতিভাশালী বন্ধুগণের সহিত তর্ক-বিতর্ক দ্বারা শম্ভুনাথ তাঁহার তর্কশক্তি যথেষ্ট পরিমাণ বর্ধিত করিয়া ভবিষ্যৎ উন্নতির সূত্রপাত করিয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই।’’

অপ্রয়োজনীয় হাসিঠাট্টায় অবসর কাটানোর বদলে দিনের পর দিন এমন অভিনব আইনচর্চাই দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা আইনজ্ঞের ভবিষ্যতের ভিত রচনা করে দিয়েছিল। আদালতের ১৬ টাকা মাইনের অ্যাসিস্ট্যান্ট রেকর্ড কিপার থেকে কর্মজীবন শুরু করে সেরেস্তায় আইনি কাগজের অনুবাদক ও পরে কোর্টের মুহুরি হয়েছিলেন। সেখান থেকে হলেন নামী সরকারি উকিল, তুঙ্গ পসারযুক্ত ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। তার পর মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ১৮৬৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রথম দেশীয় বিচারপতি হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত। তৈরি হয় ইতিহাস!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মবছর ১৮২০ সালেই জন্ম শম্ভুনাথের। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি এ বছর তাঁরও জন্মের দুশো বছর পূর্ণ হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আমৃত্যু সুসম্পর্ক ছিল তাঁর।

পণ্ডিতেরা এলেন কলকাতায়

শম্ভুনাথের ঠাকুরদা মনসারাম পণ্ডিত ছিলেন কাশ্মীরের বাসিন্দা। আফগান শাসকদের ভয়ে ও অত্যাচারে হিন্দু পণ্ডিত দুই ছেলে সদাশিব ও শিবপ্রসাদকে নিয়ে গোপনে কাশ্মীর ছেড়ে পালালেন। পৌঁছলেন লখনউয়ে। ছেলেদের ভাল করে ফার্সি ও উর্দু শেখাতে লাগলেন। কিন্তু লখনউয়ে ভাল কাজ জুটছিল না তাঁদের। শেষে কাজের সন্ধানে সদাশিব চলে আসেন কলকাতায়। শিবপ্রসাদ গেলেন বারাণসীতে। কলকাতায় আদালতের সেরেস্তায় তখন উর্দু-ফার্সি জানা লোকের খুব চাহিদা। দেওয়ানি আদালতে চটপট ভাল কাজ জুটে গেল সদাশিবের। কলুটোলা স্ট্রিটে বাসা নিলেন। কিছু দিন পরে শিবপ্রসাদও চলে এলেন দাদার কাছে। দেওয়ানি আদালতে তাঁকেও কাজ পাইয়ে দিলেন সদাশিব। এই শিবপ্রসাদেরই প্রথম সন্তান শম্ভুনাথ। কিছু সূত্র অনুসারে, তাঁর জন্ম হয়েছিল বারাণসীতে। আর কেউ কেউ বলেন, জন্মেছিলেন কলকাতাতেই। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আদালতের যোগাযোগের সূত্র অনেক আগেই সৃষ্টিকর্তা রচনা করে দিয়েছিলেন।

ছোটবেলায় অসম্ভব রুগ্‌ণ ছিলেন। তাঁর প্রতি আলাদা করে নজর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে, পাঠিয়ে দেওয়া হয় লখনউয়ে মামার বাড়িতে। সেখানে মামা-ই তাঁর বাবার ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই পরবর্তীতে প্রতি বছর আদালতে ছুটি পড়লেই লখনউয়ে মামাকে দেখতে যেতেন শম্ভুনাথ। মামার কাছেই উর্দু ও ফার্সি ভাষা শেখেন খুব ভাল করে। তার পর ইংরেজি শেখার জন্য বারাণসী পাঠানো হয় তাঁকে। চোদ্দো বছর বয়সে কলকাতায় বাবার কাছে আসে শম্ভুনাথ।

স্কুল, জেফ্রয় সাহেব, অঙ্কে ভয়

ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন নিয়ে তখন বাংলার যুবসমাজ উত্তাল। হিন্দু কলেজে ইংরেজি-শিক্ষিত ছাত্ররা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি বিশ্বাসকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে মদ-মাংস খাচ্ছে। হিন্দু আচার-ধর্ম মানছে না। গোঁড়া রক্ষণশীলেরা তাদের প্রতি খড়্গহস্ত। হিন্দু কলেজে আর ছেলেদের ভর্তি করতে চাইছেন না কেউ। সমাজের কয়েক জন মাথা বিকল্প স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব ও কালীকৃষ্ণ দেব, নড়াইলের জমিদার রাম রতন রায়, নিমতলার দত্তবাড়ির সাহায্যে গৌরমোহন আঢ্য ১৮২৯ সালে নিমতলার মানিক বসু ঘাট স্ট্রিটের এক বাড়িতে ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। শম্ভুনাথকে তাঁর বাবা সেই স্কুলেই দিলেন।

ছাত্রদের ইংরেজি লেখা ও বলার ভিত প্রথম থেকে শক্ত করতে গৌরমোহন খুঁজে আনলেন হার্মান জেফ্রয় নামে এক ফরাসি সাহেবকে। ইংরেজি-সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি ভাষায় সাহেব তুখোড়। এসেছিলেন ব্যারিস্টারি করতে। কিন্তু অতিরিক্ত মদের নেশায় ডুবে সেটি আর হয়নি। টাকাপয়সা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে একশো টাকা বেতনে ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ইংরেজির শিক্ষক নিযুক্ত করা হল। গৌরমোহনের মান রেখেছিলেন জেফ্রয়। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছিলেন শম্ভুনাথ, ক্ষেত্রচন্দ্র ঘোষ (হিন্দু পেট্রিয়ট, বেঙ্গলি পত্রিকার সম্পাদক গিরিশচন্দ্র ঘোষের দাদা), গিরিশচন্দ্র, কৈলাসচন্দ্র বসু-রা। জেফ্রয়ের সবচেয়ে প্রিয় দুই ছাত্র ছিলেন ক্ষেত্রচন্দ্র ও শম্ভুনাথ। অঙ্কে বরাবর কাঁচা হলেও শম্ভুনাথ ইংরেজিতে দুর্দান্ত। তাঁর বুদ্ধি, যুক্তি, বাগ্মিতা ও উপস্থিত বুদ্ধি তাক লাগানো। তার উপর সুন্দর চেহারা আর ভদ্র স্বভাব। পরবর্তী কালে ক্ষেত্রচন্দ্র আত্মচরিতে লিখেছেন—‘হার্মান জেফ্রয় প্রায়ই বলিতেন, ক্ষেত্রচন্দ্র ও শম্ভুনাথ এই দুই জন ছাত্র জগতে যশোলাভ করিবেন।’

জেফ্রয় প্রতি সপ্তাহে একবার ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কের সভা বসাতেন। যাতে তাদের ভাষা, ভাবনা, যুক্তি দিয়ে কথা বলার ক্ষমতায় শান দেওয়া যায়। তর্কসভায় বাগ্মিতা ও যুক্তিসম্মত তর্কশক্তিতে বারবার সবাইকে মুগ্ধ করার জন্য জেফ্রয় সাহেব ক্ষেত্রচন্দ্রকে ‘ডিমস্থিনীস’ ও শম্ভুনাথকে ‘ফোশিয়ন’ নামে ডাকতেন।

তাঁর সাহসের প্রমাণও স্কুলে পাওয়া গিয়েছিল একাধিকবার। টিফিনের সময়ে এক মাতাল সাহেব খোলা তরোয়াল নিয়ে শিক্ষক আর ছাত্রদের দিকে তেড়ে এল। চার দিকে হুলস্থুল। প্রাণভয়ে সবাই ছুটছেন। শম্ভুনাথ সকলকে অবাক করে সেই মদ্যপ সাহেবের কাছে গিয়ে নানা কথায় তাকে অন্যমনস্ক করে তরোয়াল কেড়ে নিলেন। আর এক বার এক ভয়ঙ্করদর্শন ফকির স্কুলে ঢুকে ছাত্রদের অপমান করছিল। শম্ভুনাথই কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে তাকে ধরে ফেলেন আর বেঁধে নিয়ে আসেন স্কুলের মাঠে।

সময়ের আগে স্কুলছুট ও বিয়ে

কিন্তু পড়াশোনা বেশিদূর এগোল না। তখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়ছেন। প্রায় জোর করেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন লখনউয়ের স্বজাতীয় মেয়ে মালো রানির সঙ্গে। তার পরই হঠাৎ কলেরায় মারা গেলেন তিনি। পড়াশোনা মাথায় উঠল শম্ভুনাথের। ঘাড়ে এসে পড়ল সংসারের দায়িত্ব। ইংরেজি-উর্দু-ফার্সি ভাষার জ্ঞান পুঁজি করে নামতে হল রোজগারের পথে। স্কুল ছাড়ার আগে গৌরমোহন আঢ্য প্রিয় ছাত্রের চরিত্রের শংসাপত্রে লিখলেন—‘শম্ভুনাথ ওরিয়েন্টাল সেমিনারির অন্যতম সেরা ছাত্র ছিলেন। স্যর এডওয়ার্ড রায়ান, ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন, ও অন্য উপযুক্ত ব্যক্তিগণ তাঁকে পরীক্ষা করেছেন ও তাঁর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে যথেষ্ট জ্ঞান জন্মেছে স্বীকার করেছেন। তিনি পারস্য ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছেন আমি অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি। তাঁর স্বভাবচরিত্র সবসময় শিক্ষকদের প্রশংসা অর্জন করেছে।’

কাজের শুরু

আদালতেই কাজ শুরু হল।১৬ টাকা মাস মাইনেতে সদর আদালতের সহকারী রেকর্ড কিপার। পাশাপাশি বাংলা ও ফার্সি ভাষায় লেখা দলিল ইংরেজিতে অনুবাদ করেও কিছু রোজগার করতেন। সেই অনুবাদ দেখে আদালতের ইউরোপীয়রা মুগ্ধ হতে লাগলেন। সুনাম ছড়িয়ে পড়ল শম্ভুনাথের। স্যর রবার্ট বার্লো তাঁকে ডিক্রি জারি করার মুহুরি পদে চাকরি দিলেন। শম্ভুনাথের বিচারপতি হওয়ার পথে এই বার্লো সাহেবের প্রভূত অবদান রয়েছে।

এই সময়েই তিনি ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও স্বরূপ’ নামে একটি বই লেখেন। সতীর্থ ভবানীচরণ দত্তের সহযোগিতায় ১৮৪৬ সালে বেকনের প্রবন্ধাবলির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করেন, যা ইউরোপীয় মহলে অসম্ভব প্রশংসিত হয়। লেখার প্রাপ্তিস্বীকার করে মেজর ডিএল রিচার্ডসন লিখেছিলেন—‘এটি উচ্চ প্রশংসার যোগ্য। তুমি টাউনহলে যে চমৎকার পরীক্ষা দিয়েছিলে সে কথা আমার মনে আছে।’ ডিক্রিজারি আইন সম্পর্কেও একটি ইংরেজি বই লেখেন তিনি যা দেখে বার্লো সাহেব উচ্ছ্বসিত হন। সদর কোর্টের বিচারপতিদের অনেকেই এর ফলে শম্ভুনাথের নাম জানতে পারেন।

ঘটনাচক্রে তখন সদর আদালতে রিডারের (তখন বলা হত মিসিলখাঁ) পদ খালি হয়। শম্ভুনাথ সেই পদের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু এই কাজে খুব পরিশ্রম আর শম্ভুনাথের হাঁপের টান রয়েছে বলে পিতৃপ্রতিম বার্লো তাঁকে পরীক্ষায় বসতে বারণ করেন। তাঁর কথা ফেলতে না পারলেও কাজটা না-পাওয়ার দুঃখ ভুলতে পারছিলেন না শম্ভুনাথ। সে কথা আপশোস করে জানিয়েছিলেন চব্বিশ পরগনার সদর আমিন হরচন্দ্র ঘোষকে। তিনি তখন তাঁকে দুঃখ না করে আইন পড়ে ওকালতি করার পরামর্শ দেন। আর সেটাই শম্ভুনাথের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ।

উকিল থেকে হাইকোর্টের প্রথম দেশীয় বিচারপতি

১৮৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর সদর কোর্টে ওকালতি করার অনুমতি পেলেন। কিছু দিনের মধ্যে হয়ে উঠলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। উপার্জন হতে লাগল প্রচুর। সে যুগে কোনও কোনও মাসে দশ হাজার টাকা আয় হত। ভবানীপুরের বাড়ি নতুন করে তৈরি করলেন। ১৮৫৩ সালে ২৮ মার্চ জুনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার নিযুক্ত হলেন। এর জন্য তিনি কোনও আবেদন করেননি। জে আর কালভিন (পরে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর) তাঁর আইনজ্ঞান আর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে এই পদ দেন। এর কিছু দিনের মধ্যে একটি মামলার কাজে তাঁকে মুর্শিদাবাদ যেতে হয়। সেখানকার নবাবের প্রাসাদ থেকে সোনাদানা চুরি হয়। তাঁর কর্মচারীরা চোরদের হাতেনাতে ধরে এমন মার মারেন যে, তারা সবাই মারা যায়। মামলা শুরু হয় নবাবের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। আসামি পক্ষের ব্যারিস্টার ক্লার্ক ও মন্ট্রিউ। সরকার পক্ষের আইনজীবী মিস্টার ট্রেভর ও শম্ভুনাথ। এই মামলায় তাঁর আইনজ্ঞান ও পক্ষপাতহীন আচরণে ধন্য ধন্য পড়ে যায়।

১৮৫৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক শম্ভুনাথকে সেখানে আইন-অধ্যাপকের পদ নিতে অনুরোধ করেন। মাসিক ৪০০ টাকা মাইনেয় পড়ানো শুরু করেন। প্রায় দু’বছর ওই পদে ছিলেন।

১৮৬১ সালে সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার রমাপ্রসাদ রায় অসুস্থ হয়ে অবসর নেন। সেই জায়গা পান শম্ভুনাথ। কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য। লর্ড ক্যানিং প্রথম থেকেই মনে করতেন, দেশীয় বিচারপতিরা ইংরেজদের পাশাপাশি কাজ করার যোগ্য। ১৮৬২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট তৈরির পরেই রাজা রামমোহন রায়ের ছোট ছেলে রমাপ্রসাদ রায় মহারানি ভিক্টোরিয়ার অনুমোদনে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু ভাগ্য যাবে কোথায়! যখন নিয়োগপত্র এল, তখন জটিল রোগে রমাপ্রসাদ মৃত্যুশয্যায়। হাইকোর্টের প্রথম ও প্রধান বিচারপতি স্যর বার্নস পিকক শম্ভুনাথের প্রতিভায় আগে থেকেই মুগ্ধ ছিলেন। তিনিই শম্ভুনাথকে রমাপ্রসাদের জায়গায় নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

একটু ইতস্তত করছিলেন শম্ভুনাথ। তাঁকে সাহস জোগান বাংলা সরকারের তৎকালীন সেক্রেটারি স্যর অ্যাসলি ইডেন। লর্ড এলগিনও এই নিয়োগকে সমর্থন করেন। ১৮৬২ সালের ১৮ নভেম্বর ভারতবর্ষের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট স্যর চার্লস উড মহারানি ভিক্টোরিয়ার অনুমোদন-সহ নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেন।

কিছু প্রতিবাদ... সমালোচনা

যখন বিচারপতির পদে বসলেন তখন তাঁর বয়স মোটে তেতাল্লিশ। এত অল্পবয়সি বিচারপতি দেখতে ভারতবাসী অভ্যস্ত ছিল না। আদৌ তিনি কাজ করতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন উঠল। অনেকেই প্রতিবাদ করলেন। কয়েকটি খবরের কাগজও বিরুদ্ধপ্রচার করল। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। শম্ভুনাথের সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করলেন হাইকোর্টের অন্যতম সরকারি উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়। সেখানে হইহই করে উপস্থিত হয়েছিলেন কৃষ্ণকিশোর ঘোষ, অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। শম্ভুনাথকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছিল।

মধুসূদনকে সাহায্য

প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ছেলে জ্ঞানেন্দ্রমোহন প্রথম ব্যারিস্টার হয়ে আসেন। কিন্তু তিনি ভারতে ব্যারিস্টারি করেননি। ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে এসে প্রথমে বাধা পেয়েছিলেন। কপর্দকশূন্য মধুসূদনকে ব্যারিস্টারি করে কলকাতা হাইকোর্টে উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন শম্ভুনাথ।

বন্ধু বেথুন

ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন তখন স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কলকাতায় মেয়েদের স্কুল খুলেছেন হস্টেল-সহ। শম্ভুনাথ প্রথম থেকে নারীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন। মেয়ে মালতীকে বেথুনের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। বেথুন সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই শুরু। দু’জনের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া হত। এই রকমই একটি চিঠিতে দেখা যায়, মালতী নিজের হাতে চটি তৈরি করে উপহার দিয়েছেন বেথুনকে। অন্য একটি চিঠিতে বেথুন লিখেছেন— ‘মিসেস রিড সডেলের কাছে শুনলাম, মালতী তাঁর অন্যতম সেরা ছাত্রী এবং তাঁর পড়ার আগ্রহ দেখে তিনি আনন্দিত। শনিবার বা রবিবার ছাড়া অন্য কোনও দিন আমার বাড়িতে আপনি অবসর মতো সাক্ষাৎ করলে আমি আনন্দিত হব। আপনার বিষয়ে অতি উচ্চমত পোষণ করি।’ ১৮৫১ সালের ৮ এপ্রিল লেখা চিঠিতে বেথুন তাঁকে ‘কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রকাশিত পিয়ার্সন সাহেবের বাক্যাবলির নতুন সংস্করণে আইন সংক্রান্ত বাংলা শব্দ ও তার ইংরেজি প্রতিশব্দের তালিকা তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। শম্ভুনাথ সাগ্রহ সেই কাজের ভার নিয়েছিলেন। বেথুনের মৃত্যুর পর তৈরি হওয়া ‘বেথুন সোসাইটি’ নামে সাহিত্য সভার অন্যতম সহকারী সভাপতি ছিলেন শম্ভুনাথ।

বিদ্যাসাগর-সখ্য

দু’জনের জন্ম একই বছর। প্রথম দেখা বেথুন স্কুলে এবং তখনই বন্ধুত্বের সূচনা। বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের প্রথম পুরস্কার বিতরণী সভায় শম্ভুনাথ সফল ছাত্রীদের দিয়েছিলেন সোনার বালা আর বিদ্যাসাগর সোনার চিক। বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক যাবতীয় কাজে সমর্থন করে এসেছেন শম্ভুনাথ। ১৮৫৫ সালের ৫ ডিসেম্বর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে প্রথম বিধবাকন্যার বিয়ে আয়োজন করলেন। বরের পাল্কির বেহারা হয়েছিলেন শম্ভুনাথ। উপস্থিত ছিলেন বিয়ের আসরে। বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় ১৮৬৩ সালে ‘সুরাপান নিবারণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করলেন। অধিকাংশ শিক্ষিত বড়লোকের অতিরিক্ত মদের নেশা দূর করা ছিল সভার উদ্দেশ্য।

১৮৫১ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব ও আরও কিছু গণ্যমান্যদের নিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হল, যা ছিল ভারতে প্রথম রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতার অঙ্কুর। ভারতীয় জনসাধারণের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারকে জানানো এবং তা আদায়ের জন্য দরবার করা ছিল এই সভার কাজ।

পরিবার, পছন্দ

প্রথম স্ত্রী মালো রানির মৃত্যুর পর ভালবেসে বিয়ে করেন বাঙালি মেয়ে হরিদাসীকে। এতে জ্ঞাতিরা তাঁকে ত্যাগ করেন। তখন হরিদাসী তাঁকে অনুরোধ করেন স্বজাতীয় কাউকে বিয়ে করার জন্য। সেই অনুরোধ রেখে বিয়ে করেন স্বরূপ রানিকে। প্রায়ই স্কুলের বন্ধুদের একজোট করে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতেন। গিরিশচন্দ্র এক জায়গায় লিখেছিলেন, সহপাঠীদের এমন ভাবে খুঁজে একজোট করতেন যে মনে হত, স্কুলের পুরনো হাজিরা খাতা তিনি চুরি করে নিজের কাছে রেখেছেন। প্রচুর দান করতেন বিভিন্ন কাজে। মাছ ধরতে খুব ভালবাসতেন। ‌শুধু মাছ ধরার জন্য বেশ কয়েকটি পুকুর কিনেছিলেন শম্ভুনাথ। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী। কিছু দিন ভবানীপুর ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর অনেক ক’টি সন্তানের মধ্যে, এক ছেলে প্রাণনাথ পণ্ডিত অত্যন্ত কৃতী ছাত্র ছিলেন। তিনিও হাইকোর্টের উকিল হয়েছিলেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর বৃত্তি পেয়েছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় তাঁর অনেক লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তিনিও অকালে মারা যান।

তাঁর নামে হাসপাতাল

শম্ভুনাথের বাঙালি স্ত্রী-র ছিল দুই ছেলে। রাধাগোবিন্দ ও শঙ্করনাথ। রাধাগোবিন্দ-র নাতির মেয়ে চিন্ময়ী পণ্ডিত দত্ত ও তাঁর স্বামী অমলেশচন্দ্র দত্ত দু’জনেরই বয়স আশির কাছাকাছি। দীর্ঘ দিন শম্ভুনাথকে নিয়ে তাঁরা গবেষণা করছেন। একাধিক বইও লিখেছেন। তাঁদের কাছেই শোনা গেল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল তৈরি ও তার নামকরণের গল্প।

এখন যেখানে হাসপাতাল, সেখানে আগে ছিল একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। আর শম্ভুনাথ থাকতেন এখন যেখানে বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি, তার উল্টো দিকে। বিকেলের দিকে প্রায়ই দাতব্য চিকিৎসালয়ে এসে বসতেন। গরিব রোগীদের ওষুধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করতেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, এই এলাকায় শুধু ভারতীয়দের জন্য নিখরচায় চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল হোক। তাঁর অকালমৃত্যুর পরে একটি শোকসভার আয়োজন হয়, যেখানে বহু বিশিষ্ট মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁর স্মৃতিরক্ষা কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত হয় এবং ওই দিনই ২৫ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। তার মধ্যে ৪ হাজার টাকা দিয়ে শম্ভুনাথেরএকটি তৈলচিত্র আঁকানো হয়, যা এখনও হাইকোর্টে রয়েছে। বাকি টাকা ভবানীপুরের সেই দাতব্য চিকিৎসালয়ের কমিটিকে দেওয়া হয়। সেই টাকায় চিকিৎসালয়ের পাশে কমিটি ন’ কাঠা জমি কেনে।

১৮৭৭ সালে দাতব্য চিকিৎসালয়ের বহির্বিভাগ তৈরি হয় । ১৮৮৯-এ তা কলকাতা পুরসভার হাতে আসে। ১৮৯৩ সালে সেখানে সরকারি হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ৬৪ হাজার টাকা দিয়ে ১২৯ কাঠা জমি নেয় সরকার। কলকাতা পুরসভাও দেয় ৫ হাজার টাকা। ১৮৯৬ সালে হাসপাতাল ভবন তৈরি শেষ হয়। ১৮৯৮ মতান্তরে ১৯০২ সালে শম্ভুনাথের নামে হাসপাতালের নাম রাখা হয় ‘শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল’ এবং তা কাজ শুরু করে।

একটি ফোঁড়া, তা থেকে মৃত্যু

জ্বর কমছিল না কিছুতেই। শম্ভুনাথের একটা ফোঁড়া হয়, যার অনেক মুখ। প্রথমে কবিরাজ দেখিয়েছিলেন। তার পর বেথুনের জোরাজুরিতে প্রেসিডেন্সি হাসপাতালের সার্জন এসে দেখে যান। তিনি জানান শম্ভুনাথের কার্বাঙ্কল হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। কিন্তু অপারেশনে শম্ভুনাথ রাজি নন। ফোঁড়া থেকে বিষক্রিয়া ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। বুঝলেন, আর সময় নেই। ১৮৬৭ সালের ৫ জুন সন্ধ্যায় উইলে সই করলেন। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের খাটের পাশে ডেকে উপাসনা করতে বললেন। নিজে চোখ বুজে শুয়ে রইলেন। সেই ভাবেই পরদিন ৬ জুন সকাল সাড়ে সাতটায় চিরনিদ্রায় গেলেন, মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement