অলংকর়ণ: সুমন চৌধুরী
সময় বড় রসিক। যে মেয়ে একদিন লিখেছিল, ‘‘মনের কথা জানাইবার লোক জগতে নাই,’’ আজ দেখা যাচ্ছে তার কথা শুনে শুনে লোকের আর মন ভরছে না।
যাত্রা থেকে গ্রুপ থিয়েটার, সিনেমা থেকে টিভি সিরিয়াল, সমাজবিজ্ঞানীর গেরামভারী গবেষণা থেকে সঙ্গীত-গবেষকের সংকলিত ‘বিনোদিনী রচনাসমগ্র’ উইথ ফ্রি মিউজিক সিডি, সবেতেই ওই একটা মেয়ের কথা। শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী। সাম্প্রতিকতম সংকলনটি, যার সম্পাদনা করেছেন দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ফের বিনোদিনীকে নিয়ে চিন্তা উস্কে দেয়।
তার সময়ের মেয়েরা, এমনকী তার চাইতে অনেক পরের মেয়েরাও সেই কবে সেকেলে হয়ে গেল। তাদের ন্যাপথালিন-নিমপাতা দিয়ে তুলে রাখা যায়।
কিন্তু বিনোদিনী? জ্বলন্ত মশাল আলমারিতে তুলে রাখবে, এত সাহস কার? মেয়েদের মধ্যে কে প্রথম গ্র্যাজুয়েট, প্রথম ডাক্তার, প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, প্রথম হ্যানোত্যানো, সব কুইজের বইতে রয়ে গিয়েছে। বিনোদিনী কোনও কিছুতে প্রথম না হয়েও অদ্বিতীয়া। মাত্র বারো বছরের অভিনয় জীবন, স্রেফ দুটি গদ্য লেখা প্রকাশিত। তাতেই অলটাইম সুপারহিট।
বক্স অফিসে, বেস্ট সেলার লিস্টে গত দু’পাঁচ বছর কাদম্বরী বৌঠান একটু কম্পিটিশন দিচ্ছে বটে, তবে সে নিতান্তই রবীন্দ্রনাথের ধোঁয়াটে ‘রোম্যান্টিক ইন্টারেস্ট’-এর সাইড রোলে।
বিনোদিনী কারও স্যাটেলাইট নয়, হয়নি কোনও দিন। বিনোদিনীর কথা উঠলে গিরিশ ঘোষের কথা ওঠে ঠিকই। তা বলে গিরিশকে চিনলে মোটেই চেনা হয় না বিনোদিনীকে। বরং বিনোদিনী গিরিশকে বেশ কিছুটা চিনিয়ে দিতে পারে।
বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীর জন্য গিরিশকে ভূমিকা লিখতে বলেছিল, কিন্তু সে লেখা তার পছন্দ হয়নি। বিনোদিনীর মনে হয়েছিল, সত্যি কথাগুলো চেপে গিয়েছেন গিরিশ। গিরিশের ভূমিকা স্রেফ বাদ দিয়ে নিজের বই ছাপিয়ে দিয়েছিল বিনোদিনী। পরের বছরই সেই বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ বার হয়েছিল।
খ্যাতির চূড়ায় যখন ছিলেন সুচিত্রা সেন, তখন তাঁর এমন দাপট ছিল বটে। স্টার ভ্যালুতেও সুচিত্রার খানিক তুলনা চলে বিনোদিনীর সঙ্গে। কিন্তু মৃত্যুর ছয় দশক পরে সুচিত্রাকে ক’জন মনে রাখবে, নাটক-সিনেমা করবে তাঁকে নিয়ে, কে জানে?
বিনোদিনীর ভূমিকায় কে না অভিনয় করেছেন— নান্দীকারে মঞ্জু ভট্টাচার্য, কেয়া চক্রবর্তী, যাত্রায় বীণা দাশগুপ্ত, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় সীমা বিশ্বাস। অমল এবং নিসার আল্লানার নাটকে বিনোদিনীর ভূমিকায় পাঁচজন অভিনয় করেছিলেন, চরিত্রের নানা দিক তুলে ধরতে।
‘ছবির মধ্যে ছবি’ ধাঁচে বিনোদিনীর জীবনের ফিল্ম বানানো নিয়ে ‘আবহমান’ করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেখানে বিনোদিনী করেছিলেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ষাটের দশকে সুচিত্রার অভিনয় করার কথা হয়েছিল বিনোদিনীর ভূমিকায়। তার মেক আপ টেস্ট-ও হয়েছিল। অসিত সেন শেষ অবধি ছবিটা করেননি। সুচিত্রার ভূমিকায় অভিনয় করতে কারও খোঁজ যত দিন না পড়বে, তত দিন মহানায়িকাও ছাড়াতে পারবেন না বিনোদিনী দাসীকে।
স্বামীর সঙ্গে।
অথচ সুচিত্রার টানা টানা চোখ, টিকোল নাক, টোল-পড়া হাসি, তন্বী চেহারার পাশে বিনোদিনীর ছবি দেখলে আশ্চর্য লাগে। বিনোদিনীর রং কালো। চেহারা সেই ২২-২৩ বছর বয়সেই বেশ ভারী। কালো রং, ভরাট গাল, সুগোল বাহু, পুষ্ট কোমর। দুধে-আলতা বর্ণ কি পানপাতা মুখ, কোনওটাই ছিল না। অথচ সে মেয়ের আকর্ষণ ছিল এমন যে লাহোরে থিয়েটারের পর বাড়ির সামনে লেঠেল খাড়া করতে হয়েছিল। আর কলকাতায় রংপুরের জমিদারের সঙ্গে কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর লেঠেলদের লাঠালাঠি হয়ে গিয়েছিল।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিনোদিনীর অ্যাফেয়ারটা নাকি নেহাত গুজব। তা বলে চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর, যার নামে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ, তিনি যে বিনোদিনীকে রুপোর ফুল, কাচের পুতুল উপহার দিয়েছিলেন, সে তো আর মিথ্যে নয়।
বাবুরা কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও টাকা দিয়ে বশ করতে চেয়েছে বিনোদিনীকে। সেকেলে সেই মেয়ে তাদের একজনকে সপাটে বলেছিল, ‘‘টাকা আমি উপার্জন করিয়াছি বই টাকা আমাকে উপার্জন করে নাই।’’
বিনোদিনী তৈরি হয়েছে এমন নানা গল্প দিয়ে।
এক প্রণয়ী তাকে তরোয়াল দিয়ে কাটতে গিয়েছিল, কেবল কথায় ভুলিয়ে তাকে নিরস্ত করার গল্প। হ্যাট-কোট পরে সাহেব সেজে অসুস্থ রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে দেখা করার গল্প। স্টার থিয়েটারের নাম যে তার নামে ‘বি থিয়েটার’ হওয়ার কথা ছিল, এ কথা বাঙালি ভোলেনি। আর কোনও না-দেওয়া নাম এত নাম করেছে কিনা, কে জানে!
চিত্তরঞ্জন ঘোষের ‘নটী বিনোদিনী’ (নান্দীকার যা অভিনয় করেছিল ২১০ রজনী) নাটকে গিরিশ বলছেন, ‘‘তুমি রেজিস্ট্রির দিন পর্যন্ত জানতে, না হবে বি থিয়েটার। ... তোমায় একটু ছলনা করা হয়েছে। আমিও অপরাধী।’’ উত্তরে বিনোদিনী বলছে, ‘‘তা কেন বলছেন? সবাই যা ভাল বুঝেছেন, তাই নাম রেখেছেন। এতে অপরাধের কিছু নেই।’’ বিনোদিনীর কেবল ভয়, ‘‘যার শুরু বিশ্বাসভঙ্গে, ছলনায়, তার শেষ কোথায়?’’ উত্তরে গিরিশ কিছু বোঝাতে গেলে বিনোদিনী বলে, ‘‘এ কথা এখন থাক। আমার বড় ক্লান্ত লাগছে।’’
আবার যখন গিরিশ তাকে শ্রীচৈতন্যের মহলা দেওয়াচ্ছেন, তখন বিনোদিনী বলছে, ‘‘স্টেজেও নিজেকে শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলে পরিচয় দিতে পারব না। আমি জাতবোষ্টমের মেয়ে। আমি বেশ্যা। ...আমি পাপী। আমায় দেখে তো লোকের পাপ-কথাই মনে হবে।’’
বিনোদিনী-গীতির ‘সা-পা-র্সা’ এ ভাবে যে বেঁধে দেওয়া হল, তারপর থেকে সব কথা সেই সুরেই বাঁধা পড়েছে। ধরতাইয়ে বিনোদিনীর বেশ্যাজন্মের পাপবোধ, মধ্যে ব্রাহ্ম মহিলা-ধাঁচের আত্মমর্যাদা, ধনমানে ঔদাসীন্য, আর তারসপ্তকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কৃপালাভ।
চিত্তরঞ্জন ঘোষের এই স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে ব্রজেন্দ্রকুমার দে যাত্রাপালা লেখেন, যা থেকে নট্ট কোম্পানির সুপারডুপার হিট ‘নটী বিনোদিনী।’ সেই বয়ানের ছাপ যোগেন চৌধুরীর আঁকা ছবিতেও। সেখানে বিনোদিনীর স্তন অনাবৃত, কিন্তু মুখ বিষণ্ণ, আয়ত চোখের দৃষ্টি অন্তর্মুখী।
এর উপাদান বিনোদিনীই জুগিয়েছে। সে বারবার নিজেকে পতিতা, পাপীয়সী বলছে। আবার ‘আমার কথা’-র প্রথম সংস্করণের গোড়াতেই নিজের যে ছবিটি ছাপিয়েছে, তাতে মাটন চপ-হাতা ব্লাউজ, শাড়ি-চুলের ধরন, চেস্ট অব ড্রয়ার্সে হাত দিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি, সবই সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ছবির জন্য পোজ দেওয়ার মতো। রামকৃষ্ণদেবের আশীর্বাদে আশ্বাস মেলার কথাও লিখেছে। ‘আমার কথা,’ ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’-এ এই সব রসদই আছে।
‘বিবাহ বিভ্রাট’ নাটকে।
কিন্তু ওই দুটি অসামান্য লেখা বারবার পড়লে মনে হয়, কোথাও ঢুকতে গেলে যেমন ব্যাজ দেখাতে হয়, পতিতার তকমা বিনোদিনীর কাছে তেমনি পাঠকের কাছে যাওয়ার উপায়। নইলে কি সে মেয়ে লিখতে পারে, ‘‘বারাঙ্গনা জীবন কলঙ্কিত, ঘৃণিত বটে। কিন্তু তাহা কলঙ্কিত, ঘৃণিত কোথা হইতে হয়? ... যাঁহারা লোকালয়ের ঘৃণা দেখাইয়া লোকচক্ষুর অগোচরে পরম প্রণয়ীর ন্যায় ....ছলনা করিয়া বিশ্বাসবতী অবলা রমণীর সর্বনাশ সাধন করিয়া থাকেন .... তাঁহারা কিছুই দোষী নহেন!’’
আজ এ কথাগুলো খুব নতুন মনে হয় না। কিন্তু বিনোদিনীর আগে, তার সময়ে, মেয়েদের যে সব লেখা বেরোচ্ছিল, তার পাশে এর তীব্রতা চোখ ধাঁধানো। স্বর্ণকুমারী দেবী, কৃষ্ণভাবিনী দাস কিংবা রোকেয়া সাখাওয়াত বিস্তর যুক্তি, দৃষ্টান্ত দিয়ে সেই সময়ে যা লিখছেন, তা হল মেয়েরা মোটামুটি পুরুষদের মতোই বুদ্ধিমান, সক্ষম। আর বিনোদিনী পুরুষের শয়তানি, ঠকবাজি নিয়ে সোজাসাপটা লিখছে। যেটা গিরিশেরও একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল— ‘‘নিজের জীবনীতে উক্তরূপ কঠোর লেখনীচালন না হইলেই ভাল ছিল।’’
ঠিক কঠোরতা নয়। বিনোদিনীর লেখা থেকে যা স্পষ্ট হয়, সে তার আবেগের তীব্রতা। শিল্পীদের মধ্যে যেটা প্রায়ই দেখা যায়। নাচ-গান-অভিনয়-ছবি আঁকায় যারা তন্ময়, তারা প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙে গড়েন। নিজেকে অন্যের কাছে বিতরণ, অন্যের থেকে আহরণ এঁদের কাছে হৃদপিণ্ডের স্ফীতি-সংকোচনের মতোই স্বাভাবিক। সম্পর্কে একের পর এক ঘাত-প্রতিঘাত, কখনও পরম পাওয়ার উচ্ছ্বাস, কখনও সব খুইয়ে অন্যকে, ভাগ্যকে তিক্ত দোষারোপ। ভিতরের রক্তক্ষরণ থেকে শিল্পের স্ফুরণ। এ একা বিনোদিনীর কথা নয়। তার বারাঙ্গনা পরিচয় দিয়েও এর সবটা ব্যাখ্যা চলে না।
বিনোদিনীর পরিচয় সে প্রাইমা ডোনা। সর্বকালে হিরোইনের যা স্বভাব, তা দিয়ে সে অজস্র উৎপাত করেছে নির্দেশক, সহ-অভিনেতাদের ওপর।
গিরিশের নাটকে অন্য নায়িকা বেশি হাততালি পেলে জ্বলে উঠেছে। একই নাটকে অন্য থিয়েটারে অন্য নায়িকা বেশি লোক টেনেছে, তা-ও সহ্য করতে পারেনি। বিনোদিনী শুধু প্রতারিত হওয়ার জ্বালায়, মালিকদের সঙ্গে সংঘাতের জন্য থিয়েটার ছাড়েনি। দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিনয়ের ক্ষেত্রেও পাশে সরে যাচ্ছিল বিনোদিনী। বাবু থিয়েটার সব সময়েই নতুন মুখ চায়। বনবিহারিণীর ‘নিতাই’ তখন গানের প্রতিভায় ‘নিমাই’ বিনোদিনীকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বীণা থিয়েটারে ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ নাটকে কুসুমকুমারী স্টারের ‘প্রহ্লাদ’ বিনোদিনীর চাইতে বেশি দর্শক টানছে। শেষের দিকে বিনোদিনী কম গুরুত্বের চরিত্র, পুরুষ চরিত্র পাচ্ছিল বেশি।’’ বিদায়ের সময় হয়েই আসছিল।
থিয়েটার ছেড়ে এক ধনীমানী ব্যক্তির সঙ্গে ‘সংসার’ শুরু করল বছর তেইশের বিনোদিনী, একটি মেয়েও হল তার। মধ্যচল্লিশে ফের বিপর্যয়, ১৩ বছরের কন্যা মারা গেল। পরপর চলে গেলেন জীবনসঙ্গী, গুরু গিরিশ। শোকের আঘাতে জীবনের সব খেদ, আক্ষেপ যেন দলা পাকিয়ে উঠে এল কলমে – ‘‘ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয়-জ্বালার ছায়া! এ পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা, শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরতা।’’
আর এই প্রথম লাইনেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে বিনোদিনীর সত্য পরিচয়, যা বিনোদিনী নিজেও হয়তো টের পায়নি, দাবিও করেনি। জীবনের উনপঞ্চাশতম বছরে বিনোদিনী চিনিয়ে দিল, সে এক অসামান্য লেখক। পাঠককে ঘাড় ধরে গোটা একটা লেখা পড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতা খুব কম লেখকের থাকে। বুকে মোচড় দেওয়ার শক্তি থাকে হাতে-গোনা কয়েকজনের।
একত্রিশ বছরের জীবনসঙ্গীর অকস্মাৎ মৃত্যুর আঘাতের যে বর্ণনা বিনোদিনী দিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি তার তুলনা মেলে না—
‘‘পৃথিবীর ভাগ্যবান লোকেরা শুন, শুনিয়া ঘৃণায় মুখি ফিরাইও। আর ওগো অনাথিনীর আশ্রয়তরু, স্বর্গের দেবতা, তুমিও শুন গো শুন। দেবতাই হোক আর মানুষই হোক, মুখে যাহা বলা যায় কার্যে করা বড়ই দুষ্কর। ভালবাসায় ভাগ্য ফেরে না গো, ভাগ্য ফেরে না!! ওই দেখ চিতাভস্মগুলি দূরে দূরে চলে যাচ্ছে, আর হায়-হায় করিতেছে।’’
এ যদি গুমরে-ওঠা কান্না হয়, তো রয়েছে বুক-ফাটা আর্তনাদও—
‘‘ওগো! আমার আর শেষও নাই, আরম্ভ নাই গো! ... আর তো একেবারে মৃত্যু হবে না গো, হবে না! এখন একটু একটু করিয়া মৃত্যুর যাতনাটিকে বুকে করিয়া চিতাভস্মের হায়-হায় ধ্বনি শুনিতেছি!’’
বিনোদিনীর বাড়ি এখন।
এ যে বিনোদিনীর প্রায় প্রথম গদ্য লেখা, তা বিশ্বাসই হতে চায় না। সে তৈরি করে নিয়েছে নিজের ভাষা, যা একান্ত মেয়েলি মুখের ভাষা অথচ বলিষ্ঠ, সতেজ। ফের ৬২ বছর বয়সে বিনোদিনী যখন ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ লিখছেন, তখন তাঁর ভাষা চলিত বাংলা, লেখনী আরও ঝরঝরে, গল্প বলার ভঙ্গি সরস। গরুর গাড়ির উপর বাঘ কেমন হামলা করেছিল, বাঁদরেরা কেমন ঘিরে ধরে খাবার কেড়ে নিয়েছিল, কিংবা ট্রেনে মুমূর্ষু সঙ্গীকে এক ফোঁটা জল দিতে না পেরে কীভাবে বুকের দুধ নিয়ে তার মুখে দিয়েছিলেন দলেরই এক মহিলা, সে সব ছবির মতো মনে গেঁথে যায় একবারটি পড়লে।
অথচ বিনোদিনীর লেখা কোনও ভাল পত্রপত্রিকায় বেরোয়নি। রবীন্দ্রনাথের চাইতে দু’বছরের ছোট, একই বছরে দু’জনের মৃত্যু। কলকাতায় দু’জনের বাসগৃহের দূরত্ব মেরেকেটে দু’ কিলোমিটার। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব অকল্পনীয়।
বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ পরপর দু’বছর (১৯১২-১৩) বেরিয়ে নিঃশেষিত। তা বলে ভারতী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, নারায়ণ লিখতে ডাকবে, তা কি ভাবা যায়? থিয়েটারের দুটি কাগজে তার আত্মকথা শুরু হয়, দুটোতেই মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়।
আজ বিনোদিনীর কথা লিখতে বসলে আরেক মেয়ের কথা বড় মনে হয়। সে তসলিমা। ‘‘মেয়েটা কী না জানি বলে ফেলবে,’’ সেই ভয়ে দু’জনকেই চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে অনবরত। তসলিমা প্রবাসে লেখালেখি চালাচ্ছেন। বিনোদিনী নিজভূমে পরবাসী হয়ে রয়ে গেলেন। শেষ বয়সে চাদরে গা ঢেকে স্টার থিয়েটারের উইংসের ধারে বসে নাটক দেখত ‘মুন অব স্টার থিয়েটার।’
১৯৪১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুর পর এক লাইনও লেখেনি কোনও কাগজ।
সময় এই রকমই বেইমান।