বিস্ময়কর: বি আর পানেসরের কাজ
পঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে জন্মানো বলদেব রাজ পানেসরকে কলকাতার শিল্পরসিক মহল সহজে বিস্মৃত হবেন না দু’টি কারণে। তাঁর সুমিষ্ট, অত্যন্ত নম্র ব্যবহার, তরুণ শিল্পীদের যে কোনও ধরনের কাজে সাহায্য করা ছাড়াও তাঁর শিল্পকর্মের অবিশ্বাস্য সব মাধ্যমের সৃষ্টিতে। বিশেষত কোলাজ। সাদা-কালো ও বিভিন্ন প্রিন্ট সম্বলিত নানান রঙিন কাগজ ছিঁড়ে, কেটে, কম্পোজ় করে তিনি যে সব অনন্য সৃষ্টি রেখে গিয়েছেন, তা আজও বিস্ময়কর। তাঁরই নামাঙ্কিত গ্যালারিতে সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস তাঁকে স্মরণ করেই বি আর পানেসরের ২০টি কাজের একটি প্রদর্শনী সম্পন্ন করলেন। ২০১৪-তে ৮৭ বছরে প্রয়াত পানেসরের এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল কোলাজ, অয়েল, অ্যাক্রিলিক, মিক্সড মিডিয়া, ইঙ্ক, ইন্তাগ্লিয়ো, ড্রাই পয়েন্ট, কালারড এচিং ও ড্রয়িং। গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের নির্বাচিত কাজ।
দৃশ্যগ্রাহ্য প্রকৃতিকে এক-একটি স্তর হিসেবে ভেঙে দেখিয়েছেন বারবার। সমান্তরাল আনুভূমিক ভাবে কাগজ কেটে, ছিঁড়ে তাঁর এই প্রয়াস। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ক্যানভাস ও কাগজে প্রধানত নিসর্গকে অ্যাক্রিলিক ও অয়েলের এই ভাঙাগড়া কিন্তু এক নির্দিষ্ট যাত্রাপথেরই দিক নির্দেশ করে। বর্ণের চাপা বৈচিত্রের মধ্যে আপাতসরল নিস্পৃহতার গভীরে থাকা আশ্চর্য সব ফর্মেশন ও রূপারোপের খণ্ডচিত্র যেন!
নিসর্গকে এ ভাবে নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি জলরং ও তেলরঙের কাজ এবং কোলাজের কাজের মাধ্যমগত প্রক্রিয়ায় যে বিভ্রম তৈরি করেছিলেন, তা এক কথায় বিস্ময়কর। দু’টি মাধ্যমকেই কখনও একই পটে বিধৃত করে চমৎকার সমীক্ষায় মগ্ন থাকতেন।
যখন ব্রাশের গভীর টানটোনের দৃঢ় ও সরল ভাবকে বর্ণের একক বা মিশ্র বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন, সেখানে সচেতনতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন রূপ ও অরূপের দ্বন্দ্ব ও সাহচর্যকে। যা একই সঙ্গে একটি সংগঠিত রূপকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
ছায়াতপ ও গভীর বর্ণের রোমাঞ্চকর আবহের মধ্যে থেকে যাচ্ছে তাঁর প্রত্যয়ী তুলির অসাধারণ বর্ণবিন্যাস ও মিশ্র বিভাজন। তাঁর কোলাজগুলিতে এই পরিণত নির্দিষ্টতার মধ্যেই উপলব্ধি করিয়েছেন অতি হালকা নম্র বর্ণ, উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল গাঢ়ত্বের মধ্যে ভিন্ন কাগজের প্রিন্ট সম্বলিত ছেঁড়া টুকরোর ব্যবহার। যা একই সঙ্গে নিসর্গের মায়াবী মগ্নতার সঙ্গে মিশে গিয়েছে প্রিন্টের কোনও ধাতব, যান্ত্রিক, মেকানিক্যাল ফর্মেশনের রূপারোপ। এই কৌশলী ব্যবহার তাঁর এ সব কাজকে কতটা মহার্ঘ করেছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার ব্রাশিংয়েও ছেঁড়া কাগজের টুকরোর বিভ্রম এনেছেন অবিশ্বাস্য।
ইঙ্ক ও মিক্সড মিডিয়া ড্রয়িংয়ের বিভিন্ন কাজে নৈঃশব্দ্যের নিসর্গকে যখন প্রতিফলিত করছেন একটি মাত্র বা একাধিক বর্ণে, সেখানে স্পেসের শূন্যতার মন কেমন করা অনুভূতিটাই প্রখর। আবার যখন ওই স্পেসকেই দূরের প্রেক্ষাপট, আকাশ, ভূমির নিম্নাংশ ও ঢালু অংশেও রেখার গভীর টানটোনের মধ্যে মানুষের চলাচলকে দেখিয়েছেন, সেও এক নির্জনতা ও চমৎকারিত্বের কথাই বলে। রং এখানে প্রধান নয়। তুলির সাবলীল সঞ্চালন ও ধাতব নিবের প্রাবল্য ও সরলতা কিন্তু আলো-অন্ধকারের তারতম্যের মধ্যেও নিসর্গের নতুন কাব্য রচনা করেছে।
কিছু ড্রয়িংয়ে ব্যবহারিক কালোর হালকা ও গাঢ় প্রতিচ্ছায়ার বিভিন্ন ক্রম, আবার ঘষামাজার মধ্যে তৈরি হওয়া এক অবর্ণনীয় আবহের মধ্যেও উপস্থিত করেছেন আর এক রকম বিভ্রম। এ তাঁর নিজস্ব স্টাইলকে যেন টেকনিকের আরও গভীরে নিহিত কৌতূহলের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। কখনও রেখার সূক্ষ্মতা, জমাট বুনোট, নষ্ট হওয়া ফোটোকপির বিভ্রম, প্রিন্টের অসংলগ্নতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এ সব পরীক্ষাগত বিশ্লেষণের মধ্যেও তাঁর শিল্পগুণের রং-রেখার প্রত্যয়ী ধারাবাহিকতাও এক সময় প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে।
তাঁর বেশ কিছু কাজে জ্যামিতিকে আর এক রকম ভাবে অনুভব করা যায়। যে কোনও মাধ্যমেই এই জ্যামিতিক বিন্যাসকে তিনি ফর্ম ও ফর্মলেস আবহের মধ্যেই আহ্বান করেছেন। দিকচিহ্নহীন নির্জনতার মধ্যেও সম্মুখভাগের বিমূর্ততার ড্রাই পয়েন্টে যেমন রেখার আঁকিবুকি ও ছায়াতপের আংশিক বিস্তার—আবার একই মাধ্যমে অন্ধকার ও সলিড, ঘষামাজা ফর্মের প্রায় অলৌকিক আবহ। একই রকম ভাবে বেশ কিছু কোলাজেও ওই জ্যামিতির টুকরো সমীকরণকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। হলুদ বিস্তৃত বালিয়াড়ি, কখনও মানুষের অবাধ গতির পথ চলা, জল, ছায়া, গরু মোষ, নৌকো, বিমূর্ত প্যাটার্ন— সব মিলিয়ে অনন্যসাধারণ!