সুমিত্র বসাকের ‘পক্ষীরূপী ধর্ম’। ছবি সৌজন্য: সিমা আর্ট গ্যালারি
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সিমা গ্যালারি একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনীর উপস্থাপনা করেছে, যা আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত দর্শকের জন্য খোলা থাকবে।
‘কালার্স অব ফ্রিডম’ নামে এই প্রদর্শনীতে ৭৫ বছরের স্বাধীনতার এই যাত্রা কী ভাবে শিল্পীরা শুরু করেছিলেন এবং কোথায় এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তার সমূহ পরিচয় পাওয়া যায়। এই যাত্রায় আমাদের পরিচয় হয়েছে নানা রীতি, শৈলী এবং বিভিন্ন ঘরানার শিল্পকর্মের সঙ্গে। শিল্পকর্মের বিকাশ এবং আধুনিক ধ্যানধারণা যে ভাবে পশ্চিমি প্রভাব কাটিয়ে নিজেদের উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে, জনজাতির শিল্পসংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক নতুন শিল্পসংজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়েছে, সেটি লক্ষণীয়। প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিক ভারতের চিত্রকর্ম এক নতুন শৈল্পিক রীতি সৃষ্টি করছে।
বিকাশ ভট্টাচার্যের ‘উন্ডেড ফ্যামিলি’। ছবি সৌজন্য: সিমা আর্ট গ্যালারি।
এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, গ্যালারির কর্তৃপক্ষ কিছু চিত্তাকর্ষক শিল্পগত পরীক্ষানিরীক্ষা উপহার দিয়েছেন এবং শুরুই করেছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবির কিছু অংশ দিয়ে। সত্যজিৎ রায় ৫০ দশকের গোড়ায় ছবির জগতে সম্পূর্ণ এক নতুনত্ব নিয়ে এসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, সমস্ত বিশ্বকে এবং স্বদেশকে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি উপহার দেওয়ার পরে। ওই ছবিটির জন্য শিল্পীর হাতে করা কিছু স্কেচ দেখা গেল প্রদর্শনীতে। বড়ই মনোহর এবং বিরল এই ধরনের স্কেচগুলি।
শিল্পী এম এফ হুসেন ওই ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু পরস্পরসদৃশ ছবি এঁকেছিলেন। সেখান থেকে দু’টি ছবি রয়েছে প্রদর্শনীতে। একটি ছবিতে বয়স যেন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বয়স্ক মানুষটির অসহায়তা ফুটিয়ে তুলেছে। গ্রামবাংলার ইন্দির ঠাকরুণকে যেন আর একবার দেখা গেল। অন্য ছবিটিতে অপু ও দুর্গার শিশু বয়সের খেলাধুলোয় যেন আনন্দের ঢেউ বইছে।
বিকাশ ভট্টাচার্যের বিশাল ক্যানভাসের ছবিটিতে নিম্নবর্গীয় একদল মানুষের অবচেতন মনের অভিব্যক্তি। কোথাও যেন ভাগ্যের পরিহাসে কারও মুখের সামান্য ব্যঙ্গাত্মক হাসিটি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে দর্শকমনে।
স্বাধীনতার পর ভারত তখন শিশুরাষ্ট্র। এই শিশুরাষ্ট্রের নানা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা— তার সঙ্গে নতুন কিছু করার বা নতুন কোনও লক্ষ্যে পৌঁছনোর ব্যাকুলতা নিয়ে যে সব শিল্পী কাজ করেছেন, তাঁরা হলেন গাইতোন্ডে, হোসেন, রাজা, গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, মনজিৎ বাওয়া, তৈয়ব মেহতা, বেন্দ্রে, সুজা, সনৎ কর, শর্বরী রায়চৌধুরী, লালুপ্রসাদ সাউ, মীরা মুখোপাধ্যায়, হিম্মত শাহ, প্রভাকর কোলটে, সমীর আইচ, জয়দেব ওয়াগেল এবং আরও অনেকেই।
এর পর বলা যায় সোমনাথ হোরের শিল্পকথা। তিনি প্রথম জীবনে দেশভাগের প্রবল কষ্ট এবং নিপীড়ন দেখেছেন। মন্বন্তরে দু’-তিন লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী ছিলেন। তাঁর অন্তরাত্মায় সেই নিপীড়ন এবং মানুষের দুর্দশার কাহিনি গভীর ছাপ ফেলেছিল। তবে যত বয়স বেড়েছে, তাঁর ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যগুলিতে অস্তিত্ববাদী অথচ আবেগমুক্তির আভাস দেখা যায়। একটি সমানুভূতির ছায়াও দৃশ্যমান হয়। তিনি যেন স্থিতধী হয়েছেন কিছুটা। সুব্রহ্মণ্যম খুবই শ্রদ্ধেয় শিল্পী। কারণ তিনি তো শুধুমাত্র শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক, ঐতিহাসিক এবং সুবোধ্য লেখার লেখকও। নানা প্রকাশ মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন, যেমন অ্যাক্রিলিক, তেলরং, টেরাকোটা। এ ছাড়াও গ্রাফিক্সে তাঁর অত্যন্ত দখল ছিল। এখানে ছবির জমিটিকে খাড়া অংশে ভাগ করে, কাঠামোটিতে একটু যেন কথ্য ভাষায় নতুন মজাদার এক আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছেন। শর্বরী রায়চৌধুরী ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে বাস্তবধর্মী শিল্পকলাকে ত্যাগ করে সংক্ষেপিত রূপের আনুগত্য গ্রহণ করেছিলেন। এই কাজে সরলতা এবং গতির মধ্যেও ধরা পড়ে সামান্য যৌনতার ইঙ্গিত।
সিমা-র এই প্রদর্শনীতে সবচেয়ে মনজয়ী ছবি গণেশ পাইনের ‘রথচালক’ বা ‘সারথি’। আগের অনেক ছবিতেই আমরা দেখেছি, শিল্পী পাইনের শীর্ণ অস্থিচর্মসার সব মানুষ, অথচ তাঁর রঙের ব্যবহার এবং ছবির গ্রন্থনা ও রচনাশৈলীর পারদর্শিতায় ছবি থেকে চোখ সরানো যায় না। তাঁর ছবিতে আমরা দেখেছি, বহুশ্রুত পৌরাণিক কাহিনি কিছুটা যেন শিল্পীর আপন সংকল্প বা চিন্তন থেকে উঠে এসে, এক অলীক গল্প সৃষ্টি করে দর্শককে বিহ্বল করে। এখানে কৃষ্ণ যেন নিছক এক ছায়ামূর্তি। অর্জুন বিব্রত, প্রশ্নরত নন। নিজের মনোজগতের এক চোরাকক্ষে তাঁর অস্তিত্ব।
জানগার সিংহ শ্যামের ‘লীলাহরি কোঠি’। ছবি সৌজন্য: সিমা আর্ট গ্যালারি।
এছাড়া লালুপ্রসাদের নিজস্ব ঢঙে করা পিরিয়ড রচনাশৈলী অনেক সময়েই বাঙালিয়ানায় ঋদ্ধ। রঙের বৈচিত্র এবং বৈসাদৃশ্য শ্লেষাত্মক, খুবই মনোগ্রাহী। মীরা মুখোপাধ্যায়ের ব্রোঞ্জমূর্তি শিবের নৃত্যের ছন্দ, যেন স্থির হয়ে গিয়ে অন্য জগতের উপভাষায় কথা বলছেন। এখানে তাঁর গঙ্গা দুর্যোগগ্রস্ত, ভাগ্যনিপীড়িত, অশান্ত তরঙ্গের হিল্লোলে বিব্রত। হিম্মত শাহ-র শৈলীতে টেরাকোটা, কাগজ এবং ধাতুর মিশ্রণ দেখা যায়। ওঁর কাজে অনেক ক্ষেত্রেই বিমূর্ততা লক্ষণীয়। এখানে একটি মাথা থেকে সমস্ত অংশ ছেঁটে কেটে—মাথাটি শীর্ণ, এক ন্যূনতম, ক্ষুদ্রতম রূপে মূর্ত।
নতুন প্রজন্মের সুবোধ গুপ্ত, পরেশ মাইতি, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্র বসাক, শাকিলা, কিংশুক সরকার, স্বর্ণ চিত্রকর এবং তারও পরের প্রজন্মের জানগার সিংহ শ্যাম, যোগেশ নায়েক, অনির্বাণ সাহা, হরেন্দ্র কুশওয়াহা, স্বপ্নেশ ওয়াই গানকর, জগদীশকুমার রায়, সোহম গুপ্ত, চন্দ্রপাল রে, সুমন চন্দ্র প্রমুখ শিল্পী নতুন এক দিগন্তের সন্ধান করেছেন। ব্যাকরণসম্মত সমস্ত নিয়মকে অস্বীকার করে, অপ্রয়োজনীয়তা থেকে বার করে, খণ্ডখণ্ড করে, পুরোটা দেখার থেকে বিভিন্ন ছোট ছোট অংশেও যে সামগ্রিকতাকে উপলব্ধি করা যায় তা দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে লোককাহিনি, বিভিন্ন অঞ্চলের জনজাতি শিল্পের, যেমন পটচিত্র, কাঁথার কাজ ইত্যাদির মিশ্রণ ঘটিয়ে, নিজের নিজের শিল্পসত্তা তৈরি করেছেন। শিল্পকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন নতুন যুগে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।