চপল ভাদুড়ী।
বাড়ির প্রায় সবাই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আমি অভিনয়ে আসার অনুপ্রেরণা মা-বাবার কাছে খুব একটা পাইনি। মা প্রভাদেবী সব সময় চাইতেন, আমি অভিনয়ে না এসে পড়াশোনা করি। তবে মা যেহেতু থিয়েটার করতেন, তাই ছেলেবেলা থেকেই আমি স্ক্রিপ্ট হাতে ধরে মা’র পার্ট মুখস্থ ধরতাম। কোথায়ও ভুলত্রুটি হলেই মাকে মনে করিয়ে দেওয়াই ছিল আমার প্রধান ও একমাত্র কাজ। মা তখনই বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন আমার অভিনয়ের প্রতি টান। মা একদিন বললেন, ‘তুই অভিনয়ে এলে ভাল করবি। কিন্তু তুই যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতিস...’ আমি ছোট থেকেই মেয়েলি স্বভাবের। পাড়ার ছেলেরা তাই অনবরত খেপাত।
জন্মেছি ১৯৩৯ সালের ২৯ জুলাই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উল্টো দিকে কালী দত্ত স্ট্রিটে। ১৯৪২ সালে চলে আসি গোয়াবাগানের ডালিমতলা লেনে। বাবা, মা, আমরা চার ভাই, দুই বোন— সবাই থাকতাম। বড় হয়েছি ওখানেই। বাড়ির ছোট ছিলাম বলে বড়দের কাছে খুব আদর পেতাম। মনে পড়ে, মা সেই সময়কার বিখ্যাত অভিনেতাদের ইংরেজি সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করতেন। অবধারিত ভাবে আমি বাড়ির ছোট বলে মা আমাকেই সঙ্গে নিতেন। টিকিটের মূল্য দশ আনা। মর্নিং শো সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা।
এ ছাড়া মায়ের সঙ্গে প্রায়ই থিয়েটারে যেতাম। উইংসের পাশে বসে থিয়েটার দেখতে যে কী ভাল লাগত! তখন ভাবতাম, এ রকম পোশাকআশাক পরে কবে আমি স্টেজে পারফর্ম করব! তবে ফিমেল পার্ট করব, এই ভাবনাটা তখন ছিল না। যা-ই হোক, তখন শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে একটা নাটক হত, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিন্দুর ছেলে’। তাতে দুটো বাচ্চার রোল ছিল, অমূল্য আর নরেন। এই ‘ছোট অমূল্য’র পার্টটা একটি ছেলে করত। একদিন হল কী, ছেলেটির বাড়ি থেকে জানাল, ওর খুব জ্বর, তাই পার্টটা করতে পারবে না। তখন সবার মাথায় হাত! কোথায় পাওয়া যাবে ওই রকম একটি বাচ্চা ছেলে? খোঁজ খোঁজ। মা বলল, ‘দেখি, আমার ছোটটাকে রাজি করানো যায় কি না। ও তো রোজই থিয়েটার দেখে।’ মা থিয়েটারের লোকদের দিয়ে আমায় ডাকতে পাঠিয়ে দিল। ৪৫ মিনিট বাকি ছিল শো শুরু হতে। এলাম। মা বললেন, ‘অমূল্যর পার্টটা তুই করতে পারবি?’ জোর গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারব।’ আসলে এই থিয়েটারটার প্রায় প্রত্যেক শো-ই আমার দেখা, তাই ওর কম্পোজিশন সব মুখস্থ। তা পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে দিল। আর বলে দিল, প্রম্পটার যা যা বলবে, তা-ই শুনে শুনে বলে দিবি। বলতে পারেন, এটাই আমার প্রথম মঞ্চে অভিনয়।
নান্দীপট-এর ‘রমণীমোহন’ নাটকে চপল ভাদুড়ী
তখনকার দিনে এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল। সে কারণেই বোধ হয় তখন একজন প্রম্পটারকে বড় আর্টিস্টদের সমতুল্য ভাবা হত। সত্য ডাক্তার বলে একজন প্রম্পটার ছিলেন, তিনি বললেন, ‘আমি যখন বলব, শুনে চোখগুলো বড় বড় করে বলে দিবি।’ তাই করলাম, অভিনয় খুব ভাল হল। পাঁচ টাকা পেয়েছিলাম। সে কী আনন্দ! থিয়েটার থেকে বেরিয়ে মশালের মতো টাকাটা ওড়াতে ওড়াতে দৌড়ে বাড়ি এসেছিলাম। সবাইকে দেখিয়েছিলাম। যা-ই হোক, রেগুলার অ্যাক্টর ছেলেটি অসুখ থেকে সেরে উঠে, আবার কাজ করতে লাগল। অতঃপর, কর্মচ্যুত হয়ে আমিও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলাম।
মা মিনার্ভাতে চলে গেলেন। আমি ‘ধাত্রীপান্না’ নাটকে ‘উদয়’-এর চরিত্রটা করতাম, আর মাধবী চট্টোপাধ্যায় ‘কনক’। দু’জনের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। এখনও দেখা হলে আমরা পুরনো সেই সব দিনের কথা স্মৃতিচারণ করি। মিনার্ভা ছেড়ে মা আবার চলে এলেন ‘রংমহল’ থিয়েটারে। ১৯৫১ সালে ‘নিষ্কৃতি’ নাটক শুরু হল। সেখানে অনেক ছোট ছোট ছেলের রোল ছিল। আমি, সুব্রত রায়, সত্যব্রত রায় এবং আরও অনেকে মাস মাইনে হিসেবে সেখানে যোগ দিলাম। ১৯৫২ সালের ৮ নভেম্বরে মা মারা গেলেন। ওখানে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তবুও কয়েক মাস বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিয়েছিল। ৫০ টাকা মাইনে ছিল। তার পর একদিন বলল, তোমাদের আর আমরা রাখতে পারছি না— হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে কাজ দেখো। চলে এলাম। ক্লাস এইটে পড়ি। ওই বয়সে বেকারত্বের জ্বালা বুঝতাম না ঠিকই, তবে দ্বিতীয় বার কাজ হারিয়ে ‘অসহায়তা’ উপলব্ধি করেছিলাম। কারণ, বাবা তারাকুমার ভাদুড়ী চাকরি করতেন না। শুধু থিয়েটারটাই করতেন। তখনকার দিনে থিয়েটার করে কত আর রোজগার হত! স্বাভাবিক ভাবেই সংসারে আর্থিক টানাটানি লেগেই ছিল। আসলে বাবা মেজাজি লোক ছিলেন। যতই হোক, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সহোদর তো! তাই তাঁর ‘মেজাজটাই আসল রাজা’ গোছের ছিল আর কী! বাবা শেষের দিকে দু’একটা সিনেমা করেছেন, তাও আবার জমিদার গোছের রোল পেলে তবেই...
আমি ‘দাঙ্গা’, ‘মন্বন্তর’ নামে দুই বিধ্বংসী ঝড় দেখেছি। দেখেছি দেশভাগও! এক-একটা অঞ্চল জ্বলছে, আর গুজবে পুড়ছে অন্য অঞ্চল। আমি ভেবে অবাক হই, একই সংস্কৃতি, একই ভাষা, তবু কেন আমাদের মধ্যে এত ভেদাভেদ! এই জাতপাতের বিভেদ আমায় খুব নাড়া দিত। হিন্দু-মুসলমান মারামারি করছে, খুনোখুনি করছে। এ সব দেখে কষ্ট হত। পাশাপাশি দেশভাগের মতো আমাদের সংসারটাও টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমি পড়লাম ছোড়দির ভাগে। ছোড়দি কেতকী দত্ত তখন স্টার থিয়েটারে, ভাল ভাল অভিনয় করছে। ছোড়দি বলল, ‘এ বার কাজটাজের কিছু চেষ্টা কর।’ সাঙ্ঘাতিক আর্থিক দুরবস্থা চলছিল মা মারা যাওয়ার পর। তখন আমার বড় জামাইবাবু প্রস্তাব দিলেন, ‘তুই যদি মেয়ে সেজে অভিনয় করতে পারিস, তা হলে একটা চাকরি পেতে পারিস।’ ভাবলাম, আমার গলা মেয়েলি, শরীরের ভাবও মেয়েলি, মানছি। কিন্তু আমি তো একজন পুরুষ! কী করে সম্ভব? উনি বললেন, ‘তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই করবি কি না বল।’ ইস্টার্ন রেলওয়েতে উনি কাজ করতেন, আমাকে ওখানে নিয়ে গেলেন। ওঁদের রিক্রিয়েশন ক্লাবের ‘আলিবাবা’ নাটকে মর্জিনার পার্ট। আদ্যোপান্ত নাচ-গান-অভিনয়। ষোলো দিন রিহার্সাল হল। অ্যামেচার দল। অভিনয় খুব ভাল হল। কমবয়সি ছেলেরা তো আমায় দেখে প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল। সত্যিই চাকরি হল। আড়াই টাকা রোজে মাসে ৭৫ টাকা। বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের কাজ। আমার পদ ‘চেনম্যান’। অর্থাৎ কাজটা হল, কোনও জায়গা মাপার সময় চেন ধরতে হবে। তবে ভাগ্য ভাল, কাজটা কোনও দিন করতে হয়নি। কারণ কর্তৃপক্ষ ভাবতেন, রোদে বের হলে যদি গায়ের রং কালো হয়ে যায়, অ্যাপিলের ব্যাপারটা মাটি হয়ে যাবে! রেলের সব ডিপার্টমেন্টেই অভিনয় করতাম। তখনকার দিনে কিন্তু পুরুষরাই নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন। এটাই রেওয়াজ ছিল। প্রভাত ঘোষ, সুধাংশু চট্টোপাধ্যায় আরও অনেকে নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন। আমি অভিনয়ের সঙ্গে গানটাও করতে পারতাম ভাল।
যা-ই হোক, এ সব ছোটখাটো রোলে অভিনয় করে আমার ঠিক মন ভরত না। এতটাই তখন আমার অভিনয়স্পৃহা বেড়ে গিয়েছিল যে, ম্যানেজারকে বারবার বলতাম, আমাকে ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ নাটকে মনোরমা-র পার্টটা দিন না। আমি তো লম্বাচওড়া আছি, মানিয়ে যাবে। কিন্তু তিনি বলতেন, ‘এখনও তোর মনোরমা করার মতো অভিনয় ক্ষমতা আসেনি। তুই বরং মায়ার বন্ধুর রোলটা কর।’ কী আর করা! এর পর আস্তে আস্তে কাজের দরজা খুলতে লাগল। থিয়েটার-যাত্রায় সাজসজ্জা ভাড়া-দেওয়া পোশাক কোম্পানিগুলোর মারফত আমরা কাজ পেতে থাকলাম। আমরা মানে সত্যব্রত, সুব্রত, আমি, আরও অনেকে। প্রথম গিয়েছিলাম দেওঘরের আশ্রমে। তখনকার দিনে আশ্রমটাশ্রমে মেয়েদের নিয়ে অভিনয় করা হত না। এখন এ নিয়ম আছে কি না বলতে পারব না। ‘পথের শেষে’ বলে একটা ভাল নাটক ছিল নিশিকান্ত বসুরায়ের লেখা, তাতে পারুল নামে একটা চরিত্র ছিল। আমি সেটা করলাম। খুব নামযশ হল। ‘সম্রাট অশোক’ নাটকেও আমি। দেখতে খুব ভাল ছিলাম বলে আমায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘আম্রপালি’ সিনেমার নামভূমিকায় সুপ্রিয়ার মতো। বক্ষবন্ধনী, নাভির নীচে শাড়ি, বড় চুল। পরে অবশ্য নিজে নিজেই সাজতাম।
একটি নাটকের দৃশ্যে চপল ভাদুড়ী
টাটানগরে অভিনয় করতে গিয়ে এক মজার ঘটনা ঘটল।
সেই সময় ‘চাঁদের মেয়ে’ নাটকে ‘সোনা’ চরিত্রটা করতাম। আমার চরিত্রে একটা জায়গায় আমি বিধবা হয়ে যাব। অথচ আমি জানতামই না। তখন বাড়ির লোকেদের কেঁদে কেঁদে বলব, ‘তোমরা কেন বলোনি, এই সাজ রাখার আর কোনও দরকার নেই?’ স্টেজ থেকে গ্রিনরুম একটু দূরে। গ্রিনরুমে গিয়ে সব খুলে যখন সাদা থান পরে আবার স্টেজে আসছি, তখনই হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। পরক্ষণেই ঝপাং করে একটা জিপ গাড়ির ভিতরে। অনেকটা সেই ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে পুকুরের জলে পড়ার দৃশ্যটার মতো। তার পর হইহই-রইরই কাণ্ড! এক কমবয়সি ছোঁড়া বলে, ‘আমি তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব।’ কী কাণ্ড বোঝো! আমি যত বলি, আমি একজন পুরুষ মানুষ, এটা অভিনয়। কে শোনে কার কথা! তার একটাই বুলি, ‘আমি তোমায় বাড়ি নিয়ে যাব, বিয়ে করব!’ শেষে অনেক কসরত করে জিপ থেকে নেমে যেই লম্বা পরচুলাটা তার সামনে খুলে দিলাম, অমনি ছোঁড়া পাথরের মতো শান্ত!
তখন নট্ট কোম্পানির বিরাট নাম। সেই সময় ছবিরানি (শ্যামাপদ রায়) নট্ট কোম্পানি ছেড়ে চলে গেলেন গণেশ অপেরায়। নট্ট কোম্পানি আমাকে ডাকল, হাঁটিয়ে দেখল, গলা শুনল, একটা ডায়লগ বলতে বলল, বললাম। মানে একদম কনে দেখার মতোই! দেখেটেখে বলল, ‘গলা বড্ড নিচুতে, আমাদের দলে তো সবচেয়ে উঁচুতে অভিনয় হয়।’ আসলে আমি তো পেশাদার জগতে একদম আনকোরা। মাত্র অ্যামেচার অভিনয় করি। দর্শক, লোকজন সবই পেশাদারদের চেয়ে আলাদা। অ্যামেচার তখন ব্রাত্য।
শেষমেশ নট্ট কোম্পানি আমাকে নিল। অগ্রিম বাবদ দিল ১ টাকা। ঠাকুরের পায়ের থেকে নিতে হয়। এটা নট্ট কোম্পানির ঐতিহ্য, রীতি। মাস-মাইনে ১০০ টাকা, আর যে দিন রান্না হবে না, সে দিন খোরাকির জন্য দেওয়া হবে ১ টাকা। ১৯৫৮ সালে আমার কাছে ১০০ টাকার মূল্য তো অনেকটাই, আবার ১ টাকাও অমূল্য! ১৮-১৯ বছরের টগবগে যৌবন। চলতে লাগল। মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, আসানসোল, খনি এলাকা, উত্তরবঙ্গ, অসম...
আমার ‘চপলরানি’ হওয়ার মূলে কিন্তু তিন জনের নাম বলতেই হবে। মাখনলাল দত্ত, সূর্য দত্ত ও ব্রজেন্দ্রকুমার দে। এই তিন জন মিলে আমায় ঠেলে তুলে দিয়েছিলেন প্রশংসার তুঙ্গে। সূর্যবাবুই আমার অভিনয়ের শিক্ষাগুরু। কারণ, মাকে তো আমি সে ভাবে পাইনি। তবে মায়ের অভিনয় চিরদিনের মতো আমার স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছিল।
তখন মাইক ছিল না, ইলেকট্রিক ছিল না। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে যাত্রা করেছি। চার দিক খোলা। কাদামাটিতে স্টেজ, তার উপর ত্রিপল বা চাদর পাতা। দু’দিকে দুটো চেয়ার। এই চেয়ার দুটোকেই ফ্রন্ট, রাইট, লেফট, ব্যাক ভেবে নিয়ে বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের অভিনয় করতে হত।
তখন যাত্রাদলগুলোর পরিবহণ ব্যবস্থাও ছিল তথৈবচ! লজ্ঝড়ে বাস বা লরিতেই যাতায়াত করতে হত। ড্রাইভারের পাশে হিরো-হিরোইনদের জায়গা হত। আমাদের সব বাক্সপ্যাঁটরার উপরে। সেখানেও অনেক সারি। প্রথম সারিতে রাজা-মন্ত্রীরা। আমার জায়গা হত দ্বিতীয় সারিতে। বিচিত্র পেশা, বিচিত্র প্রভেদ! একেক দিনে দুটো-তিনটে পালা করেছি। রাজা-রানির সাজেই লরিতে উঠে বসতে হত। পরদিন সকাল সাতটায় শো ভাঙত। তার পর কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম। তবে কষ্ট হলেও সয়ে গিয়েছিল সবই।
অভিনয় করে আমার নামযশ বাড়ছিল। গলাটা ভাল ছিল, বয়স কম, দেখতে ভাল ছিলাম। তাই খুব রেষারেষি, বিদ্বেষ, ঈর্ষা পোহাতে হয়েছে। এক বার কোথায় একটা যাত্রা করতে যাওয়া হবে। দলের সবাই জানে, শুধু আমিই জানি না, আশ্চর্য! প্রত্যেকেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আমি বসে আছি। সূর্যবাবু বললেন, ‘আরে, তুমি এখনও বইস্যা আছ। চলো চলো।’ বললাম, ‘কোথায়?’ উনি বললেন, ‘যাত্রা করতে।’ আমাকে তো কেউ বলেনি। তখন উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘শোনো, এটা হল যাত্রাদল। এখানে কেউ কারও বন্ধু হয় না। এখন থেকে নিজের স্বার্থ নিজে বুঝে চলবে, কেমন?’
মা শীতলার চরিত্রে
আর একটা জিনিস হত, নট্ট কোম্পানিতে শুরুর সময়। যে যে যাত্রাপালাগুলো ছবিরানি এত দিন অভিনয় করে গিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে কোনও পালা যদি আয়োজকরা বুক করে, তা হলে আয়োজকদের কেউ গোপনে খবর দিয়ে যেত, ‘এই বইতে কিন্তু ছবিরানি নেই, খবরদার বইটা করাবেন না!’ অথচ আয়োজকরাই আমার অভিনয় দেখার পর বলতেন, ‘কই, ছবিরানির অভাব তো বুঝতে পারিনি।’ ‘চাঁদবিবি’ পালায় তো খুব নাম হয়েছিল। তার পর ‘মহীয়ষী কৈকেয়ী’, ‘সুলতানা রিজিয়া’-তেও। ১০ বছর যাত্রা করার পর নট্ট কোম্পানি ছেড়ে দিই।
নবরঞ্জন অপেরায় যোগ দিলাম। স্বপনকুমার মহানায়ক ছিলেন। স্বপনবাবু ‘মাইকেল মধুসূদন’ পালা করছেন। ওখানে ‘জাহ্নবী’র পার্টটা করেছিলাম। চার বছর চলেছিল। প্রচুর দর্শক-প্রশংসা পেয়েছি। জাহ্নবী করতে গিয়েই উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে আলাপ হয়। রবীন্দ্রসদনে শো ছিল। উত্তমবাবু স্বপনবাবুর বন্ধু ছিলেন। ওঁরা উইংসের পাশে বসে যাত্রা শুনলেন। অভিনয় দেখলেন। দেখার পর বললেন, ‘জাহ্নবী চরিত্রে যে মেয়েটি অভিনয় করল, তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।’ আমি প্যান্টশার্ট পরে চুল আঁচড়ে উত্তমবাবুর সামনে এলাম। ক্যাপ্টেন গোছের ছিলাম তো! উনি আমায় দেখে বললেন, ‘না, না, এঁকে ডাকছি না, ওই মহিলাকে ডাকুন।’ দলের একজন বললেন, ‘দাদা, উনিই সেই মেয়ে, যিনি জাহ্নবীর রোলে অভিনয় করেছেন। কেতকী দত্তের ভাই চপল ভাদুড়ী।’ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি বিয়ে-থা করেছ?’ না, বিয়ে করিনি। ‘তুমি বিয়ে করোনি! তবে কী ভাবে নারী চরিত্রে মাতৃত্বের রূপ ফুটিয়ে তুলছ? তোমার কী চাই বলো?’ বললাম, ‘কিছু চাই না দাদা। আপনার পায়ের ধুলো আর আশীর্বাদ দিন শুধু।’
এর পর থেকেই দলে বেশি করে মেয়েরা অভিনয়ে আসতে লাগল। ফলে আমি কোণঠাসা হতে থাকলাম। তাও প্রায় বছর পাঁচেক কাজ চালিয়ে গেলাম। মাইনেও ধীরে ধীরে কমছিল। একদিন ম্যানেজার বললেন, ‘চপলদা, আপনাকে আর রাখতে পারছি না। আপনার জায়গায় নতুন মেয়ে নিচ্ছি।’ বসিয়ে দিল! ওই বয়সে বেকারির জ্বালা কি আর ভাল লাগে!
সব ছেড়েছুড়ে ১৯৭৮ সাল নাগাদ তারাপীঠে চলে গেলাম। কোনও দিন খাওয়া জুটত, কোনও দিন জুটত না। কোনও রকমে চলে গেল আরও চার বছর।
তার পর এক বন্ধু বলল, ‘আমার বাড়িতে থাকো, তোমার কোনও অসুবিধে হবে না।’ ভাল কথা। থাকতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছু দিন বাদে আমারই মনে হল, এটা ঠিক নয়। একজন পুরুষ হয়ে কাজকর্ম করছি না, এ রকম বসে বসে খাওয়া ঠিক হবে না। ছোড়দিকে বললাম, ‘কী করব?’ ছোড়দি বলল, ‘দ্যাখ, যারা অভিনয় করে, তাদের অভিনয়ই অক্সিজেন। বাঁচার জন্য ওটা জরুরি। এ বার ভেবে দ্যাখ, কী করবি? ’
ছোড়দির কথা মতো আবার অভিনয়ে ফিরলাম। তবে এ বার স্টেজে নয়। বস্তিতে, অলিগলিতে, মন্দিরের চাতালে! ফাল্গুন-চৈত্রে যে শীতলাদেবীর পালা হয়, তা করতে শুরু করলাম। ‘মা শীতলা’, ‘মায়ের পায়ে রক্তজবা’ এই সব নামগান করা হত। যে দিন পুজো হত, সে দিন রাতে অভিনয় হত। রাজা বিরাট বা রানি সুদেষ্ণা-র পার্ট করতাম। এর কোনও স্ক্রিপ্ট হয় না। অন স্টেজ বানিয়ে বলতে হয়। তিন-চার ঘণ্টা খেটে ৫০-৬০ টাকার মতো রোজগার হত। এই করতে করতেই আলাপ হল নবীন কিশোর-এর সঙ্গে। একজন পুরুষ কী ভাবে মহিলাতে রূপান্তরিত হচ্ছে, মূলত এই গল্প নিয়ে তিনি ‘পারফর্মিং দ্য গডেস’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানালেন। দিল্লি, মুম্বই, পুণে, ঢাকা, কানাডায় গিয়েও বেশ কিছু অনুষ্ঠান করলাম।
ছোড়দি একটা গ্রুপ করেছিল ‘মঞ্চপ্রভা’। তাতে ‘নিজভূমে’-তে অভিনয় করি। আভাষ-এর ‘সুন্দরীবিবির পালা’, যাদবপুর মন্থন-এর ‘অর্ধেক আকাশ’-এও অভিনয় করেছি। এ ছাড়া দুটো টেলিফিল্ম করেছি ‘শবরীর প্রতীক্ষা’ ও ‘উষ্ণতার জন্য’। একটি ধারাবাহিক ‘ঘরে ও বাইরে’ এবং ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ও ‘মায়ামৃদঙ্গ’ ছবিতে অভিনয়ও করেছি। থিয়েলাভার্স-এর ‘খোলা জানালা বন্ধ চোখ’-এ অভিনয় করি।
কয়েক বছর আগে একদিন নান্দীপট-এর প্রকাশ ভট্টাচার্য এসে বললেন, ‘যে ছেলেটি রমণীমোহন করছে, ওর অসুবিধে হচ্ছে। আপনি যদি ওকে একটু দেখিয়ে দেন।’ বললাম, যদি আমি করি, তা হলে? উনি বললেন, ‘সে তো খুব ভাল কথা।’ পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ মিলিয়ে মোট ৬৯টা শো করেছিলাম। আপাতত এটাই শেষ মঞ্চাভিনয় বলতে পারেন।