অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে কয়েক জন মানুষ এ বঙ্গদেশে এমন ছিলেন বা রয়েছেন, যাঁদের নাম দেশের মানুষের কাছে বার বার বললে আত্মগর্ব হয়। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত... বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে আজীবন যে নামগুলো জড়িয়ে রয়েছে, তাঁরা এ সময়েরও। তাঁরা চিরকালের। এবং বাংলা থিয়েটারকে বিশ্বমঞ্চে মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যিনি নিয়েছিলেন, সেই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁরই সতীর্থ, প্রাণসখা কথা বললেন পত্রিকার সঙ্গে। তিনি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
‘নান্দীকার’-এর দফতরে বসে রুদ্রপ্রসাদ বলছিলেন, “লোকে বলে, আমাদের নাকি খুব ঝগড়া! তারা জানে না, আমাদের বন্ধুত্বের শিকড় কতটা গভীরে পৌঁছেছিল...” ১৯৫৪-৫৫ সাল। তখন জীবনের খোঁজ করতে কলকাতা ছাড়ার কথা ভাবছেন তরুণ রুদ্রপ্রসাদ। আর অজিতেশ আসানসোলে, কলকাতায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দু’জনেই জীবনের ঘটনাক্রমে এসে পৌঁছলেন শ্যামবাজারের মণীন্দ্র কলেজে। তখন কলেজের কমন রুমে দু’জনের ভাললাগার বিষয়গুলোও কমন— ফুটবল, রাজনীতি, থিয়েটার। টাইমলাইন ধরে ফিরে গেলেন রুদ্রপ্রসাদ, “তখন ও অজিতেশ ছিল না। অজিত ছিল। মণীন্দ্র কলেজের ছাত্র ফে়ডারেশনে যোগ দিয়েছিল। ওর সঙ্গে ছিল পরবর্তী সময়ে ‘নান্দীকার’-এর সেক্রেটারি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট লোক। কিন্তু ওদের দলটা মাইনরিটিতে থাকায়, ওরা কখনও জিততে পারত না। আর আমার তখন একটাই কাজ ছিল। কলেজের টিটি রুমে টেবিল টেনিস খেলা! ভালই খেলতাম। আমার তো খেলোয়াড় হওয়ারই কথা ছিল... দূর থেকে ওদের দু’জনের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্ব ছিল।” তখনও বন্ধুত্বের শিকড় গাঢ়ত্ব বোঝেনি। কিন্তু মাটির আশ্রয়টাকে ঠিক চিনে নিয়েছিল। “এক বার ওদেরকে বিরোধী দলের কারা যেন ভোটে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার কাছে এসে বলেছিল সে গল্প। তখন শ্যামপুকুরের পাড়াটা আমার পাড়া। আমি তখন সে পাড়ার মস্তান! ডাকনাম খোকন। সঙ্গের ছাতাটাকেই লাঠি হিসেবে বাগিয়ে কলেজে গিয়েছিলাম, কারা ওদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তার খবর নিতে। তার পর থেকে ছাত্র ফেডারেশনের লোকেরা আমাকে গুন্ডা মনে করত। আর অজিত বলত, ‘খোকন আসলে গুন্ডা নয়, আমি ওকে গুন্ডা বানাচ্ছি’...” হাসতে হাসতে পুরনো গল্প করছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। হাসির ভাঁজে ভাঁজে নরম মমত্ব আটকে আছে এখনও।
সেই শুরু পরিচয়ের। পাতিপুকুরে তখন অজিতেশের বাস। গণনাট্য সঙ্ঘের পাতিপুকুর শাখায় তখন অজিতেশ রীতিমতো চেনাশোনা নাম। রুদ্রপ্রসাদকে পেলেই বলতেন, ‘থিয়েটার করো।’ “আমাকে বলত, আমার চেহারাটা নাকি কৃষ্ণের মতো। আমি কী সুন্দর গান গাই! শ্যামপুকুর মাঠের এ প্রান্তে ও দাঁড়িয়ে আমাকে বলত, ও প্রান্ত থেকে চড়ায় গান ধরতে, আমার গলাটা কত দূর যায় ও দেখবে বলে! আসলে ওর চেহারাটা যেমন বিরাট ছিল, নিজের ভাল লাগাটাকেও তেমন বিরাট করে ফেলতে পারত।” এ দিকে অজিতেশের আট জন ভাইবোন, সংসারের দায়দায়িত্বও ছিল। কিন্তু অজিত বাঁচতে চেয়েছিলেন মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে। বেঁধে বেঁধে থাকবেন বলে রুদ্রপ্রসাদও ঘর ছেড়ে অজিতেশের সঙ্গেই দিবারাত্রির কাব্যে মন দিয়েছেন। “স্টার থিয়েটারের পিছনে স্টার লেনের উপরে একটা বাড়ি নিয়েছিলাম একসঙ্গে থাকব বলে। ভাড়া শেয়ার করে। ঘরটায় একটা চৌকি পাতলে আর কিছুর জায়গা থাকত না... অজিত আসলে খুব বড় করে টানত আমায়। ও ছিল সেই বন্ধু, যার জন্য নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে একসঙ্গে থাকা যায়। তার পর আইএ পরীক্ষায় মণীন্দ্র কলেজ থেকে দু’জন ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল... এক জন আমি, আর এক জন অরুণ সেন। অজিত চেয়েছিল, আমি মণীন্দ্র কলেজেই থার্ড ইয়ারে ভর্তি হই। কিন্তু আমার তখন ইচ্ছে, সিরিয়াসলি পড়াশোনাটা করার। তাই স্কটিশে ভর্তি হলাম। তখন আমি একটু সরেই গিয়েছিলাম ওর জীবন থেকে।”
(বাঁ দিক থেকে) রুদ্রপ্রসাদ এবং অজিতেশ, মঞ্চে একসঙ্গে
সরে যাওয়া মানে অবশ্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুই দ্বীপের গল্প নয়। দুই আলাদা কক্ষপথে বিচরণ করা। অথচ দিশারী সূর্যটি দু’জনের জীবনেই এক— থিয়েটার। “ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ি, তখন ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’কে অ্যাডাপ্ট করেছিলাম আমি এবং আমার এক বন্ধু। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে সেটা করা গেল না। কে করবে ওই মেয়ের পার্ট, ও রকম বাবার পার্টই বা কে করবে, এ সব প্রশ্ন উঠতে লাগল।” তখন ‘নান্দীকার’ সদ্য শুরু করেছেন অজিতেশ। এক দিন গেলেন রুদ্রপ্রসাদের বাড়ি, এ কথা সে কথার পর রুদ্র বন্ধুকে পড়তে দিলেন তাঁর বঙ্গীয়কৃত নাটক ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’, “একটু উল্টেপাল্টে দেখে বলল, ‘আমি চললাম।’ তখন অনেক রাত হয়েছে। ওকে বললুম, ‘বাস পাবে না!’ শুনল না। বাড়ি চলে গেল এবং সারা রাত ধরে ওই অ্যা়ডাপ্টেশন পড়ে এক দিন আমাকে এসে বলল, নাটকটা করবে।”
নাট্যকারের মতো একটা মঞ্চও পেয়ে গেল এ গল্পের চরিত্ররা। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল ‘নান্দীকার’। এক বছরে ১৩১টা শো! অথচ এই নাটক দেখেই নাট্যকার জলধর চট্টোপাধ্যায় উঠতি নক্ষত্রদের বলেছিলেন, ‘বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’ আবার এই নাটক দেখেই তরুণদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন বাংলা নাটকের মসিহা শম্ভু মিত্র। ‘‘শম্ভুদা ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ দেখে অজিতকে একটা বই দিয়েছিলেন। তার উপর লেখা ‘আগামী যুগের শ্রেষ্ঠ নট অজিতকে...’ শম্ভুদা কিন্তু এ রকম কথা চট করে বলার লোক নন,’’ বন্ধুর মঞ্চ-ব্যক্তিত্বে অভিভূত রুদ্রপ্রসাদ, ‘‘ওর সঙ্গে অভিনয় করতে করতে মাঝে মাঝে আমি ভুলে যেতাম যে, আমিও অভিনেতা। তখন হয়তো হাঁ করে ওর অভিনয় দেখছি! দর্শক হয়ে গিয়েছি আর ভাবছি, করছে কী এই বিরাট চেহারার লোকটা!’’ বরাবরই আটপৌরে চরিত্রদের মঞ্চরূপ দিতেন অজিতেশ। এবং শোনা যায়, সেই চরিত্রদের মধ্যে এমন করে নিমজ্জিত হয়ে পড়তেন যে, কে চরিত্র এবং কে অজিতেশ আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ত। আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে তাঁর ধারেকাছে কেউ ছিল না ওই সময়ের প্রেক্ষিতে। ‘‘ওই ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’তেই একটা পর্যায়ের পর অজিত কেমন হাউইয়ের মতো উড়ে চলে যেত... তখন ও আর লালমোহন নয়, নাটকটা আর ‘চেরি অর্চার্ড’ নয়, তখন আর মঞ্চটাও মুক্তাঙ্গন নয়। তখন একটা মানুষ নিজ মর্ত্যসীমা ছাড়িয়ে উড়ছে...’’ বললেন রুদ্রপ্রসাদ।
‘হাটে বাজারে’ ছবিতে অজিতেশ ও অশোককুমার
‘নান্দীকার’ শুরুর আগে গণনাট্য সঙ্ঘে একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন অজিতেশ। রাজনৈতিক মতাদর্শের ধাক্কা। তাতে মন ভাঙলেও থিয়েটারের বোধ এতটুকু টাল খায়নি। ‘‘১৯৫৮ সাল নাগাদ গণনাট্য সঙ্ঘে অজিতেশ ‘চার অধ্যায়’ করতে চেয়েছিল। আর ওখানে তখন সেই পুরনো কমিউনিস্ট ট্যাবু বিরাজ করছে, যে রবীন্দ্রনাথ রিঅ্যাকশনারি। আর ‘চার অধ্যায়’তে টেররিজ়ম সংক্রান্ত যে সব কথা রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ওখানে বলছেন, মরাল শক্তি না থাকলে শুধু বন্দুকের শক্তি দিয়ে হয় না... এই সব নিয়ে অজিতের সঙ্গে ওঁদের খুব গন্ডগোল চলছিল। নতুনরা ওকে পছন্দ করছিল, আর যাঁরা কনজ়ারভেটিভ তাঁরা কিছুতেই ওকে ‘চার অধ্যায়’ করতে দিচ্ছিল না...’’ বহির্দ্বন্দ্বের সঙ্গে বন্ধুর অন্তর্দ্বন্দ্বও তখন উপলব্ধি করছেন রুদ্রপ্রসাদ, ‘‘খুবই টালমাটাল চলছিল ওই সময়টায়। ও ঠিক ভাবে গৃহীত হচ্ছিল না সেখানে।’’ পরবর্তী কালে দু’জনের রাজনৈতিক চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করা হয়নি কি কখনও? ‘‘আমাদের দলে একটা ঠাট্টা চলত দু’জনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। লোকে আমাকে বলত, আমি একটু সিপিআই-ঘেঁষা আর ও একটু সিপিএম-ঘেঁষা! কিন্তু আমরা দু’জনেই মনে করতাম, পার্টি ইজ় নট আওয়ার কনসার্ন। আমাদের পুরো সময়টাই থিয়েটারের জন্য, থিয়েটারের স্বার্থে। আর কোথাও একটা এই বোধটাও কাজ করত যে, আমরা যদি কট্টর পার্টিপন্থী হয়ে যাই, তা হলে আমাদের থিয়েটারও প্রোপাগান্ডা থিয়েটার হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তো এমন থিয়েটার করতে চেয়েছিলাম যেখানে সকলের স্থান আছে,’’ যুগপৎ সিদ্ধান্তের গল্পে ফুটে ওঠে একটা সময়ের মানচিত্র। ‘নান্দীকার’ যখন সেই সময়ের রঙ্গমঞ্চে সোনার খনি!
অশোককুমারের সঙ্গে অজিতেশ
কিন্তু বিপর্যয় তো খনিজ আহরণে অহরহ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়রা চলে গেলেন ‘নান্দীকার’ ছেড়ে, বিভিন্ন সাংগঠনিক কারণে। ‘‘আমি আর অজিতেশ তখন এক দিকে, বাকিরা অন্য দিকে। ওরাই কিন্তু মেজরিটিতে ছিল। ইচ্ছে করলে দলটা দখল করে ফেলতে পারত। কিন্তু বিভাস তো খুব ভদ্রলোক... অজিতেশের তৈরি করা দলটাকে ও নষ্ট করতে চায়নি। ওরা নিজেরা সরে গেল, ইনস্পাইট অব দেয়ার মেজরিটি। ওই সময়টা সকলে থরথর করে ভিতরে কাঁপতাম। তখন অনেকে বলত বটে মরাল গ্রাউন্ডের কথা। কিন্তু মরালিটির তো দুটো দিক রয়েছে, একটা প্রথাগত আর একটা সত্যনির্ভর। যত দূর সম্ভব সত্যটাকেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল। কিন্তু তার পর অজিতেশ নিজে যখন চলে গেল, তখন আবার আর একটা টালমাটাল... তবে ‘নান্দীকার’ চলছিল,’’ বলে চলেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ।
(বাঁ দিক থেকে) এন বিশ্বনাথন, অজিতেশ, কল্যাণী মণ্ডল। ‘থানা থেকে আসছি’ নাটকে
তবে অজিতেশের দল ছাড়ার আগেও তো একরাশ স্তূপীকৃত ঘটনা! গণনাট্য সঙ্ঘে পারেননি, কিন্তু পরে ‘নান্দীকার’-এর সঙ্গে ‘চার অধ্যায়’ করেছিলেন অজিতেশ। তখন কেয়া চক্রবর্তী তাঁর হৃদয়খোঁড়া অভিনয় দিয়ে সাড়া ফেলেছেন বাঙালি দর্শকের মনে। অন্যত্রও। অজিতেশের ‘চার অধ্যায়’-এ তিনি ছিলেন এলা। আর অজিতেশ অতীন্দ্র। ‘‘কেয়া থিয়েটারের গুরু মানত অজিতকে। আর আমি ছিলাম ওর প্রেমিক, ওর স্বামী,’’ বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। কত ধুলোবালি আপাত নিরুচ্চার এই প্রেমজ বয়ানের উপর! অথচ অজিতেশ, কেয়া, রুদ্রপ্রসাদ তখন থিয়েটারি জগতের ‘ডায়নামিক ট্রায়ো’। ‘‘একটা খুব ভাল কম্বিনেশন তৈরি হয়েছিল তখন। কেয়া, অসিত, অজিতেশ, আমি... আসলে থিয়েটারে সাংগঠনিক দক্ষতা আর শৈল্পিক প্রতিভা দুটোরই প্রয়োজন। কোনওটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গোলমালটা হয়, যখন শিল্পী মনে করেন তিনিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সে রকম একটা টেনশন আমাদের মধ্যেও শুরু হয়েছিল।’’ সম্ভবত ১৯৭৭। তখন ‘নান্দীকার’-এ সবে সরকারি অনুদান আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের ‘ছেলেমানুষি’ নির্দেশে, দল থেকে এক বছরে তিনটে প্রযোজনা নামানোর নিয়মও জারি হয়েছে। এ দিকে ভাল নাটক করার ইস্তেহারও সকলের মনে মনে গেঁথে আছে। দলের সিদ্ধান্তে রুদ্রপ্রসাদের সে বারের নির্দেশনা ‘ফুটবল’ মঞ্চস্থ হল। সফলতম নাটকগুলোর মধ্যে একটি। ‘‘তখন দলের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন চলত, ‘ফুটবল’ করে রুদ্রর বেশ নাম হয়েছে, এ বার রুদ্র বোধহয় দলটা দখল করে নেবে! অজিতও একটা দোলাচলে থাকত বলে লক্ষ্য করেছিলাম আমি আর কেয়া। তার পর কেয়ার কথাতেই এক বার মাঝ রাতে আমরা দু’জন অজিতেশের বাড়িতে কড়া নেড়েছিলাম। ওকে বলতে যে, সব ঠিক আছে। আমরা ওর সঙ্গেই আছি। কারণ আমাদের সম্পর্কটায় ওই ভালবাসাটা ছিল,’’ কথাটা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে ঘরের চার দেওয়ালে। ঘটনাচক্রে ’৭৭-এই দল ছেড়েছিলেন অজিতেশ। নিজের দল ‘নান্দীমুখ’ গড়ে নিয়েছিলেন ভাঙনের টুকরোগুলো জড়ো করে।
‘শের আফগান’-এ অজিতেশ
অজিতেশের শিল্পীসত্তার বিস্তার ছিল বটবৃক্ষের মতো। ফলে কোনও একটা শিল্পমাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবেন, এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না। ষাটের দশক নাগাদই সিনেমায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলেন অজিতেশ। প্রায় পঞ্চাশটা ছবিতে কাজ করে ফেলেছিলেন তিনি, যার মধ্যে হিন্দি ছবির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ‘কুহেলী’র সত্যভূষণ বা ‘হাটে বাজারে’র লছমনলালকে কে ভুলতে পারে? তরুণ মজুমদার যখন তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে পর্দার জন্য ‘গণদেবতা’ করেন, অজিতেশ তো সেখানেও থাকেন! আবার থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ এবং সিনেমার গ্ল্যামারের মাঝে মুখ লুকনো যাত্রাতেও অবাধ বিচরণ করেছেন তিনি। কিন্তু বন্ধুর ছবি করা বা যাত্রা করা নিয়ে রুদ্রপ্রসাদ কী ভাবেন? ‘‘অজিতেশ তখন সদ্য দ্বিতীয় সংসার শুরু করেছে, নানা কারণে ওর টাকার দরকার। ফলে সিনেমা করছে, যাত্রা করছে, থিয়েটারটাও করছে। অস্থির হয়ে আছে ও। আমার সঙ্গে নাটকের পেশাদারিত্ব নিয়ে তর্কও বাধছে, প্রকাশ্যে কিংবা ব্যক্তিগত বৃত্তে। অথচ আমার তুলনায় থিয়েটারি মাপে তো অনেক বড় অজিত!’’ এ দিকে বার্নার্দো বার্তোলুচ্চির ‘লিটল বুদ্ধ’য় অভিনয় করেছেন রুদ্রপ্রসাদ, রোলাঁ জফের ‘সিটি অব জয়’ কিংবা ‘গল্প হলেও সত্যি’তে। বলছিলেন, ‘‘টুকটাক ছবি করেছি ঠিকই। লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগারও করেছি। কিন্তু নিজেকে ওই জায়গায় সেটল করতে পারিনি কখনও। অজিতেশ যে ভাবে পেরেছিল। এক বার একটা সভায় অজিতেশ আমার সম্পর্কে বলল, ‘খোকন যদি শুধু থিয়েটারে পুরোপুরি প্রফেশনাল হত, তা হলে ‘নান্দীকার’-এর অনেক উপকার হত।’ আমি পাল্টা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমনটা কোন দিন হয়েছে যে ‘নান্দীকার’-এর কোনও দরকারে আমি ‘না’ বলেছি? কলেজ থেকে দরকার হলে তিন মাস, ছ’মাস, ন’মাস ছুটি নিয়েছি। আবার ছাত্রদের যাতে ক্ষতি না হয়, তার জন্য গরমের ছুটিতে তাদের স্পেশ্যাল ক্লাসও করিয়েছি! এবং সে কারণে আমি ছাত্রদের মধ্যে বেশ পপুলার ছিলাম। অজিতেশকে এটাও বলেছিলাম যে, ওর দশটা ‘বাবু’... ওর ওই প্রোডিউসাররা! আমার একটাই, গভর্নমেন্ট। যাকে চোখেও দেখাও যায় না!’’ হাসতে হাসতেই বলছেন কিন্তু। জানিয়েও দিলেন, এর কোনওটাই ঝগড়া নয়। আলোচনার মতো করেই এগোত দু’জনের তর্কবিতর্ক। ‘‘এত কাজ করল, অথচ হৃদ্রোগে ভুগে মোটে ৫০ বছর বয়সে চলে গেল। আর দেখুন, আমি কিন্তু সেই থিয়েটারটাই করে চলেছি...’’ করুণ হাসেন রুদ্রপ্রসাদ। ম্লান সূর্যের মতো।
সৌমিত্রের সঙ্গে অজিতেশ
খেতে ভালবাসতেন অজিতেশ। রুদ্রপ্রসাদ বলছিলেন, ‘‘আমাদের দলেরই এক জনের বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। সে বার জ্বর হয়েছিল বলে মাত্র এক থালা রসগোল্লা খেয়েছিল অজিত! কখনও কখনও বেশ অমিতাচারী ছিল ও। আবার কখনও প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে একটা মানুষ! আমাকে এক বার বলেছিল, বাসের পিছন দিকে বসলে নাকি প্রেশার বাড়ে!’’ ঘটনাগুলোকে জড়ো করে টেলিস্কোপের মতো নেড়েচেড়ে দেখছেন রুদ্রপ্রসাদ। আর তুলে আনছেন একের পর এক স্মৃতিজাত ধ্রুবতারা। ‘‘আমার জীবনের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটা। অজিতেশ সেই অধ্যায়ের আগাগোড়া জুড়ে...’’ বলছিলেন তিনি। আবার ফিরে গেলেন কলেজ জীবনে। ‘‘তখন শ্যামপুকুরের মোড়ে একটা খাবারের দোকান ছিল। সেখানে চপ-কাটলেট-শিঙাড়া-কচুরি পাওয়া যেত। ওই দোকানে আমি বলে রেখেছিলাম, অজিতেশ এলে যা মনে করবে খাবে, আর তার দাম যেন ওরা আমার নামে খাতায় লিখে রাখে।’’ তরুণ বন্ধুটির প্রতি সেই অনাবিল মায়া এখনও জমিয়ে রেখেছেন প্রবীণ রুদ্রপ্রসাদ। এখনও ক্ষোভের রং ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠে, যখন ফিরে দেখেন অজিতেশের সেই চলে যাওয়ার কাহিনি, ‘‘একটা শো ছিল ওর (‘সেই অরণ্য’)। সেখান থেকে ফিরে এসে ১২টা রুটি খেয়েছিল। সঙ্গে মাংস। কেউ গরম করে দেওয়ার ছিল না বলে ঠান্ডাই খেয়েছিল। তার পর বুকে ব্যথা ওঠে মাঝ রাতে, তখন ওর মনে হয়েছিল বুঝি হজমের গোলমাল! এ দিকে হার্ট ফেল করছে, ওরা কেউই ধরতে পারল না। সারা রাত তাই পেটে একটা তামার পয়সা বুলিয়ে গেল। অথচ সময়ের মধ্যে একটা হাসপাতালে চলে গেলে চিকিৎসা করে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত!’’
এখানেও দুর্ভাগ্যের হাত। যে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, অসময়ে চলে গিয়ে সেই বাংলা নাটককেই রিক্ত করে গেলেন দুর্ভাগা দর্শকের সামনে... এই নিরেট উপলব্ধির মাঝে এখনও বিষণ্ণ নন কি রুদ্রপ্রসাদ? উত্তর আসে, ‘‘আসলে আমরা সকলেই কিলার। আমরা সকলেই সকলকে খুন করি। কিন্তু এটুকুই বলার, যে হি ওয়াজ় আ জায়ান্ট অ্যামং আস!’’
যার ছায়াটা হয়তো সরে যায়, ছোট হয় না!