অর্থবহ: দেবভাষার উপস্থাপনায় শিল্পমেলা ২০২১-এর চিত্রকর্ম
শিল্পমেলা অনেক রকম। সরকারি, বেসরকারি, গ্যালারি আয়োজিত, কোনও ব্যক্তিগত সংস্থা, শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়োজনেও শিল্পমেলা হয়। শিল্পসামগ্রীর প্রাচুর্য ও মাধ্যম গত দিকের নব সংযোজিত বেশ কিছু শিল্পবস্তুরও দেখা মেলে নানা ধরনের মেলায়। ড্রয়িং, পেন্টিং, প্রিন্ট মেকিং (গ্রাফিক্স), ভাস্কর্য, সেরামিক, টেরাকোটা ইত্যাদি কাজই বেশি থাকে। পটচিত্র, পুতুল, মুখোশ, সরাচিত্র প্রভৃতি ও নানাবিধ হস্তশিল্পের সমাবেশও শিল্পমেলার আকর্ষণীয় দিক। প্রদর্শনী ও মেলার মধ্যে কিছু সীমারেখা ও পার্থক্য থাকে। দর্শক দু’ভাবেই তা উপভোগ করেন। ব্যবসায়িক দিকটিও আয়োজকদের কাছে প্রধান একটি দিক। শিল্পরসিক দর্শক-ক্রেতাও দু’ধরনের। প্রদর্শনীতে শিল্পকলা দর্শন ও শিল্পমেলার দর্শন— দুই-ই আলাদা। দু’ক্ষেত্রেই ক্রেতা থাকেন, কিন্তু বিক্রয়ের দিক থেকে দু’ক্ষেত্রের এক বিরাট ফারাকও থেকে যায়।
‘শিল্পমেলা ২০২১’ নামে ‘দেবভাষা’র উপস্থাপনায় এ বার প্রায় ৩০০-র কিছু কম কাজ ছিল। তাদের প্রকাশিত কিছু গ্রন্থ-সহ অন্যান্য গ্রন্থও ছিল। শিল্পকলা সম্পর্কিত বই-ই বেশি। সম্প্রতি শেষ হওয়া মেলাটিতে গ্রন্থ-সহ শিল্পবস্তু, চিত্র-ভাস্কর্যের বেশ কিছু কাজও শিল্পরসিক দর্শক আগ্রহে ক্রয় করেছেন।
প্রয়াত ও প্রবীণ শিল্পীদের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ ছাড়াও শিল্পমেলায় সমকালীন নবীন শিল্পীদেরও কিছু অন্য ধরনের দৃষ্টিনন্দন কাজ চোখে পড়েছে। হরেন দাসেরই ১৬টি কাজ ছিল। এ ছাড়াও সোমনাথ হোর, রেবা হোর, রবীন মণ্ডল, বুদ্ধদেব গুহ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী, লালুপ্রসাদ সাউ, শুভাপ্রসন্ন, সনৎ কর, কাত্যায়ুন সাকলাত, হিরণ মিত্র প্রমুখের অসামান্য কয়েকটি নিদর্শন এ প্রদর্শনীর অহঙ্কার। তার মধ্যে অনেক কাজই শিল্পরসিক দর্শক সংগ্রহ করেছেন।
গৌতম চৌধুরীর চারটি কাজই বিস্ময়কর। বর্ণপ্রয়োগ ও ব্রাশিং, ড্রয়িং ও কম্পোজ়িশন, এক্সপ্রেশন যথেষ্ট জোরালো, অর্থবহ। মিশ্র মাধ্যমের কাজ। প্রদীপ মৈত্রর তিনটি জলরং, অলয় ঘোষালের মিশ্র মাধ্যম ও চারকোলের ড্রয়িং, পরাগ রায়ের লিনোকাটের যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতি, রঞ্জন সরকারের বোর্ডে রঙিন কোলাজ, তাপস কোনারের দু’টি মিশ্র মাধ্যম, পার্থ দাশগুপ্তের সেরামিকের লৌকিক দেবীমুখের স্টাইলাইজ়েশন, মৈনাক চক্রবর্তীর ক্যানভাসে হ্যাচিং করা ও মিশ্র মাধ্যমের কাজ, লোকশিল্পের অনন্য নিদর্শন সৌমিত্র করের চারটি কাজেই। সবই বোর্ডে টেম্পারায় করা চারটি ‘ভাস’-এর বর্ণ, রূপবন্ধ, রচনা ও লৌকিক ঘরানার একটি নির্দিষ্ট শৈলীকে প্রতিফলিত করে। এই কাজ প্রদর্শনীর অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ।
মানুষের শ্রম, শক্তি, কর্মক্ষমতা, পতাকা বহনের বিভিন্ন মুহূর্তকে ছত্রপতি দত্ত কায়িক শ্রমের এক দৃশ্যায়নে রূপান্তর ঘটিয়েছেন পোস্টকার্ডে কয়েকটি অসাধারণ ড্রয়িংয়ে। সিপিয়া ও কালোর শক্তিশালী রিয়্যালিস্টিক ড্রয়িং। কিছু ড্রয়িং কিশোর কবির কবিতার লাইনকে মনে পড়ায়। তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্রোঞ্জের ‘বুল’, সুশোভন অধিকারীর মিশ্র মাধ্যম, পেন-ইঙ্ক, অমিত ঘোষের জলরং, বিমল কুণ্ডুর ড্রয়িং, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, টুকরো রচনায় ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে পৃথ্বীশ দাঁ-র এনায়েত খাঁ ও মুঘল অনুচিত্রের কিছু ঐতিহাসিক দৃশ্যকল্পনার চিত্রায়ণ, কৃষ্ণেন্দু চাকীর দেবদেবীর অনুপুঙ্খময় রঙিন দৃশ্যায়নের সিরিজ়, মনোজ বৈদ্যর লিথোগ্রাফ, কাগজে মিশ্র মাধ্যমের কাজ দু’টি মনোগ্রাহী। প্রদীপ রক্ষিত নিসর্গচিত্রে প্রায়শই নিরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা করে থাকেন। বর্ণপ্রয়োগ ও তাঁর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় শৈলীগত একটি দৃষ্টিনন্দন অভিব্যক্তি ছবিকে মহার্ঘ করে, সন্দেহ নেই। তবু এখানে তাঁর কিছু কাজে বড্ড গণেশ হালুইকে মনে পড়েছে। অতীন বসাকের টেম্পারা, শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের বেড়াল, পেঁচকের তীব্র চাউনি, বুদ্ধদেব গুহর বাটিক প্রিন্টের মতো বিমূর্ততা ও রাবীন্দ্রিক শৈলীর কাজটি, রচিতা ভৌমিকের এচিং ও ড্রয়িং সমন্বয়ের নিসর্গ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উড়ন্ত পাখি ও ড্রাই প্যাস্টেলের সাদাকালো ড্রয়িং, রবীন মণ্ডলের মিশ্র মাধ্যমের মুখ, ১৯৭৫-এ করা সনৎ করের সাদাকালো লিথোগ্রাফ, ২০০৩-এ রেবা হোরের প্যাস্টেলের কালো কুকুর, ১৯৭০-এ লালুপ্রসাদ সাউয়ের কাট-আউট এচিং, সোমনাথ হোরের ১৯৭৪ জুন মাসের রবিবার ৯ তারিখের এক ডায়েরির পাতায় ২৯ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ আঁকা ইঙ্কের অতি দ্রুত ব্রাশিংয়ে কুকুরের একটি ড্রয়িং, কাত্যায়ুন সাকলাতের ক্যানভাসে মিশ্র মাধ্যমে করা চমৎকার একটি অরণ্যের দৃশ্যকল্পও দেখা গিয়েছে।
তরুণ শিল্পী ছন্দক মজুমদারের লোকশিল্পের আদলে গোয়াশে করা একচালা দুর্গা, ব্রাশ ও ইঙ্কে করা এক হাতে উত্তোলিত তরবারি হাতে কালীর প্রোফাইল কাজটিও চমৎকার। এ ছাড়াও সুজিত দাস, রজতশুভ্র হালদার, শেখর রায়, প্রমুখের বেশ কিছু ভাল কাজ ছিল শিল্পমেলায়।